হুমায়ূন আহমেদের লেখা সূর্যের দিন খন্ড-১০

একদিন সাজ্জাদ গেল সেখানে। এবং আশ্চর্য লোকগুলো খুবই যত্ন করলো তাকে। বারিন বাবু বলে এক ভদ্রলোক বললেন–তুমি চিন্তা করবে না। এই কারখানাতেই তোমার একটা ব্যবস্থা করব। পড়াশোনা যা করছিলে তাই করবে, অবসর সময়ে কাজ শিখবে।

ফেরার সময় বারিন বাবু বললেন—“তােমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে একবার পঞ্চাশ টাকা ধার করেছিলাম, সেটা ফেরত দেয়া হয়নি তোমার কাছে দিয়ে দিই, কেমন?” তখন দেখা গেল অরাে অনেকেই একই কথা বলছে। কেউ দশ টাকা ধার নিয়েছিলো। কেউ কুড়ি টাকা।

সূর্যের দিন 

সাজ্জাদের মনে হলাে লোকগুলো মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মিথ্যে কথা এমন মধুর হয় কি করে কে জানে। তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলাে। 

বারিন বাবু তাকে কোলে করে একটি রিকশায় এনে তুলে দিলেন। ভরাট গলায় বললেন—তোমরা কোথায় থাকো জানতাম না। জানলে আরাে আগে এসে খোঁজ নিতাম। এখন থেকে খোজ খবর রাখব। তোমার কোন ভয় নেই। 

সাজ্জাদ বাড়ি ফিরে দেখে দাদুমণি ও নীলু বসে আছে তাদের বাসায়। নীলুর মুখ দারুণ হাসি হাসি। এবং আশ্চর্য, বহুদিন পর 

সূর্যের দিন খন্ড-১০

ও জি না। তুমি আজ ঘর থেকে বেরুবে না। কেন চাচা? 

 শহরের অবস্থা ভাল না। শহরে মিলিটারি নামবে, এ রকম একটা গুজব শোনা যাচ্ছে। 

খোকন কিছু বুঝতে পারলো না। মিলিটারি তাে নেমেই আছে। নতুন করে নামবে কি? বড়চাচা বললেন—তােমার ঐ বন্ধুটি, সাজ্জাদ যার নাম—ও কোথায় আছে ? 

 ও আছে দাদুমণির বাসায়। কার বাসায় ? 

 একজন বুড়ো ভদ্রলোকের বাসায়। ওনাকে আমরা দাদুমণি ভকি! 

করেন কি উনি? 

আমি জানি না চাচা। তাঁর বাসায় আমাকে একদিন নিয়ে যাবে। আমি ঐ ছেলেটির জন্যে কিছু করতে চাই। 

 জি আচ্ছা, আমি নিয়ে যাব। এখন যাও দারোয়ানকে ডেকে নিয়ে এসাে। 

দারোয়ান আসামাত্র বড় চাচা বললেন কবীর যখন ফিরবে, তাকে ঢুকতে দেবে না। বলবে এ বাড়িতে তার জায়গা নেই। সে যেন তার নিজের পথ দেখে নেয়। বুঝলে? 

আমিন চাচা সন্ধ্যাবেলা মুখ কালো করে ঘরে ফিরলেন। চা খেতে খেতে বললেন শেখ মুজিবুর রহমান যে প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন সেটা বাতিল হয়ে গেছে। ব্যাপার কি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। 

খোকনরা যখন ফাস্ট ব্যাচে খেতে বসেছে তখন দারোয়ান এসে খবর দিল কবীর ভাই এসেছে, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় চাচা বললেন–তুমি এই খবরটি আমাকে দিতে এসেছ কেন? তােমাকে বলে দিয়েছি না ওকে ঢুকতে দেবে না? যাও, যা বলেছি তাই কর। বড়চাচী বললেন—সে কোথায় থাকবে রাত্রে ? যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকবে, এ বাড়িতে না। তুমি এটা ঠিক করছ না।আমি যা করছি ঠিকই করছি। না ঠিক করছ না।  

সূর্যের দিন খন্ড-১০

বাবার মুখের দিকে। কেন, হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে না কেন? বাবা শান্ত স্বরে বললেন-পাকিস্তানী মিলিটারিরা আক্রমণ শুরু করেছে খােকন। রাস্তায় মিলিটারি ছাড়া আর কিছু নেই। আজ রাতে কাউকে পাওয়া যাবে না। অাজ রাতে কিছুই করার নেই। 

খোকন নিজেও শুনতে পেলো প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। ট্যাংক নেমে গেছে রাস্তায়। বড়চাচা মৃদু স্বরে কি যেন বললেন। কেউ শুনতে পেলো না! নার্স অবির বললো–একজন ডাক্তার দরকার। সবাই চুপ করে রইলো। বাবা বললেন, “খােকন মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াও। 

শুরু হলো একটি অন্ধকার দীর্ঘ রাত। মানুষের সঙ্গে পশুদের একটা বড় পার্থক্য আছে। পশুরা কখনো মানুষের মত হৃদয়হীন হতে পারে না। পঁচিশে মার্চের রাতে হৃদয়হীন একদল পাকিস্তানী মিলিটারি এ শহর দখল করে নিল।  তারা উড়িয়ে দিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলেও প্রতিটি ছাত্রকে গুলি করে মারলো।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টুকে হত্যা করলো শিক্ষকদের। বস্তিতে শুয়ে থাকা অসহায় মানুষদের গুলি করে মেরে ফেললো বিনা দ্বিধায়। “বাঙালি সের বেঁচে থাকা না থাকা কোনাে ব্যাপার নয়। এরা কুকুরের মত প্রাণী, এদের মৃত্যুতে কিছুই যায় আসে না। এদের সংখ্যায় যত কমিয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। এদের মেরে ফেল। এদের শেষ করে দাও।” 

সূর্যের দিন খন্ড-১০

 এক রাত্রিতে এ শহর মৃতের শহর হয়ে গেল। অসংখ্য বাবারা তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে ফিরে গেল না। অসংখ্য শিশু জনিলাে। না বড় হয়ে ওঠা কাকে বলে। বেঁচে থাকার মানে কি? 

শহরের জনশুন্য পথে দৈত্যাকৃতি ট্রাক চলল। ধ্বংস ও মৃত্যু। স্বজনহারা মানুষের কান্নার সঙ্গে ঠাঠা শব্দে গর্জাতে লাগলাে মেশিনগান। জেনারেল টিক্কা খান বাঙালির মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। যেন এরা দ্বিতীয়বার আর পাকিস্তানীদের মুখের ওপর কথা বলার স্পর্ধা না পায়। 

পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তানের জনদরদী ভুট্টো চলে গেল পাকিস্তানে। সে মহা উল্লসিত। প্লেনে ওঠার আগে হাসি মুখে বলে গেল—যাক শেষ পর্ষন্ত শদের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেল। 

জিজ্ঞেস করলেন–একা একা বসে আছ কেন? এসাে আমার সঙ্গে এসে 

বস। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা সূর্যের দিন খন্ড-১১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *