হুমায়ূন আহমেদের লেখা সূর্যের দিন খন্ড-১১

ও ভয়ের কিছু নেই নীলু। ও আমার ভয় করছে না।সাজ্জাদরা কোথায়? ও জানি না। রান্নাঘরে বোধ হয়। আমি কি বসব তােমার সঙ্গে? ও জানি না, ইচ্ছে হলে বসেন।

সূর্যের দিন 

দাদুমণি বসলেন। নীচু স্বরে বললেন—আমরা গ্রামে চলে যাব। সুযোগ পেলেই চলে যাব। নীল কিছু বললো না। দাদুমণি বললেন কাফু ওদের এক সময় তুলতেই হবে। হবে না? 

 তুলতেই হবে কেন? না তুললে কে কি করবে ? 

দাদুমণি এর উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তার হাতে একটি ট্রান জিষ্টার। তিনি বিদেশের রেড়ি ষ্টেশনগুলো ধরতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। এই ট্রানজিষ্টারটি বেশি ভাল । ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এখনাে হামদ অার নাতে রসূল হচ্ছে। মাঝে মাঝেই ইংরেজি বাংলা ও উর্দুতে বলা হচ্ছে 

“শহরে কারফিউ বলবত অাছে।” 

সূর্যের দিন খন্ড-১১

সাজ্জাদ ও সাজ্জাদের বোন চুপচাপ রান্নাঘরে বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। রান্না-বান্না হয়ে গেছে। শুধু ভাল ভাত। কিন্তু কেউ খেতে বসছে না। কারো খিদে নেই। এক সময় সাজ্জাদের বোন কি বললো। সজ্জাদ জবাব দিল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এটা এমন একটা সময় যখন কারোর কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

সাজ্জাদ দেখলো দাদুমণি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি নরম স্বরে বললেন-~  সাজ্জাদ, তোমরা রান্নাঘরে বসে আছ কেন? এসাে সবাই এক সতে বসি। নীলুকেও ডেকে নিয়ে এসো, ও খুবই মন খারাপ করছে। 

নীল এলো না। তার নাকি কিছুই ভাল লাগছে না। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দাদুমণি এলেন তাকে নিতে। 

ও একা একা থাকলে আরাে খারাপ লাগবে। : না লাগবে না। 

 কেউ কি দেখতে যাবে না ওর কি হয়েছে ? 

দাদুমণি সে কথার জবাব দিতে পারলেন না। নীলু দ্বিতীয়বার বললাে, “কেউ কি যাবে না? 

সাতাশ তারিখ চার ঘন্টার জন্যে কাফু তোলা হল। মানুষের ঢল নামলো রাস্তায়। বেশির ভাগই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। করুণ অবস্থা। যানবহন সে রকম নেই। সময়ও হাতে নেই। যে অল্প কয়েক ঘন্টা সময় পাওয়া গেছে তার মধ্যেই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। পথে পথে মানুষের মিছিল, কিন্তু এই মিছিলের চরিত্র ভিন্ন। * বড় রাস্তার সব কটি মোড়ে সৈন্যবাহিনী টহল দিচ্ছে।

সূর্যের দিন খন্ড-১১

তাদের চোখে মুখে ক্লান্তি ও উল্লাস। তাদের ধারণা যুদ্ধে তাদের জয় হয়েছে। তারা অলস ভঙ্গিতে নতুন ধরনের মিছিল দেখছে। এই মিছিলে আকাশ। ফাটানো ধ্বনি নেই। এই মিছিলের কেউ পাশের মানুষটির সঙ্গেও কথা, বলে না। শিশু কেঁদে উঠলে মা বলেন—চুপ চুপ। শিশুরা কিছুই বোঝে না, তারা কাদে এবং হাসে। নিজের মনে কথা বলে। বয়স্ক মানুষেরা বলে—চুপ চুপ। 

যারা পালিয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেককেই কঁদিতে দেখা যায়। তাদের কি হয়েছে? প্রিয়জন পাশে নেই? যার রাতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল সে কি ফেরেনি? প্রশ্ন করবার সময় নয় এখন। যে চার ঘন্টা সময় পাওয়া গেছে, এর মধ্যেই শহর ছাড়তে হবে। সময় ফুরিয়ে আসিছে। সবাই দ্রুত যেতে চেষ্টা করে। শিশুরা হাসে ও কাঁদে। কৈানাে কিছুই তাদের বিচলিত করে না। 

সূর্যের দিন খন্ড-১১

মিলিটারিরা দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিলিন্তি ভঙ্গিতে জনস্রোত দেখে। তাদের চকচকে বন্দুকের নল রোদের আলোয় ঝকমক করে। তারা মাঝে মাঝে কথা বলে নিজেদের মধ্যে, মাঝে মাঝে হেসে ওঠে। নিশ্চয়ই কোনো আশা ও আনন্দের গল্প। মজার কোন স্মৃতি নিয়ে তামাশা। ওদের উচ্চস্বরের হাসির শব্দে শুধু শিশুরাই অবাক হয়ে তাকায়। আর কেউ তাকায় না। 

কাফু শুরু হয় চারটায়। রাস্তাঘাট অবির জনশূন্য হয়ে যায়। শহরের অবস্থা যারা দেখতে বেরিয়েছিলো,তারা ঘরে ফিরে অসম্ভব গম্ভীর হয়ে যায়। দাদুমণি ঘন্টাখানিকের জন্যে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরেই শান্ত স্বরে বললেন—শহর ছাড়তে হবে। কালই আমরা শহর ছাড়ব। তারপর আর কোনো কথা বলেন না। বিকেল চারটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি তার ঘরে একা একা বসে থাকেন। 

দেশের দুঃখ বড় হয়ে ওঠে। আমরা মহাপুরুষ নই। আমাদের কাছে আমাদের কষ্টটাই বড় কষ্ট। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা সূর্যের দিন শেষ খন্ড

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *