বড়চাচীর কান্নার শব্দ ক্রমেই বাড়তে লাগলাে। বাবা চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রসঙ্গ বদলবার জন্যে বললেন—তোমার কি মনে হয় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন ?
আমি জানি না। ও সে ততাে কেউ জানে না। কিন্তু তোমার কি মনে হয়? আমার কিছু মনে-টনে হয় না।
এভাবে কথা বললে তাে হবে না খােকন। এখন থেকে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। খুব খারাপ সময় আমাদের সামনে।
খোকন চুপ করে রইলো। বাবা শান্ত স্বরে বললেন
এখন ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবে। সেই যুদ্ধ অনেকদিন পর্যন্ত হয়তাে চলবে। এর মধ্যেই তোমরা বড় হবে। কি খােকন, চুপ করে আছ কেন? কিছু বল।
কি বলব । ও ওদের সঙ্গে যুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। কে বলেছে?
ও বোঝা যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি। তােমার কি মনে হয় হচ্ছে না?
খোকন, এই যুদ্ধে কে জিতবে? উত্তর দেবার আগেই ছোটচাচী এসে বললেন খাবার দেয়া হয়েছে।
রাহেলাকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর জীবনের ওপর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গত দু’রীতে এতটুকুও ঘুমতে পারেননি। তাঁর চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ ফ্যাকাশে। বাবা বললেন, “আমরা একটু পরে আসি?”
সূর্যের দিন শেষ খন্ড
না, এখনই চলে আসেন। ঝামেলা সকাল সকাল চুকে যাক। ঃ আসছি, আমরা অাসছি।
খাবার টেবিলে বড়চাচা বললেন-“আমাদের এখন কি করা উচিত, গ্রামে যাব? আমিন চাচা গম্ভীর মুখে বললেন—গ্রামে পালিয়ে গিয়ে কি হবে?
এখানে এ রকম আতঙ্কের মধ্যে থাকা। সবার মনের ওপর খুব চাপ পড়ছে।
তুমি ওদিকে তাকিও না। ওদের যা ইচ্ছে করুক। সাজ্জাদের বোন বললাে, ওরা আমাদেরকে ধরবে ? না, আমাদের ধরবে না।
ওরা সত্যি সত্যি কিছু বললো না। তবে বাস থেকে প্রতিটি লোককে নামালাে। এবং কোনো কারণ ছাড়াই বুড়েমিত একটা লোকের পেটে হাটু দিয়ে প্রচণ্ড গুতাে দিল। লোকটি উলটে পড়ে কে কোঁ শব্দ করতে লাগলো। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মিলিটারির সেই জোয়ান হাত নেড়ে সবাইকে বাসে উঠতে বললো। সবাই বাসে উঠলো। বুড়ো লোকটি উঠতে পারল না। তার সম্ভবত খুব লেগেছে। সে মাটিতেই গড়াগড়ি খেতে লাগলো। নীলু ফিস ফিস করে বললো, ওকে মারলো কেন দাদুমণি। ও কি করেছে ?
ও জানি না। কিছু করেছে বলে তাে মনে হয় না। ? তাহলে শুধু শুধু মারলো কেন?
ও মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চায়। এই জন্যেই এইসব করছে। কিংবা হয়ত অন্য কিছু। আমি জানি না।
আরিচাঘাটে পেঁৗছে খুব মুশকিল হলাে। ফেরী নেই। নৌকায় করে কিছু লোকজন পারাপার করছে। কিন্তু নৌকার সংখ্যা খুবই কম। নৌকা জোগাড় হলো না। মাথার ওপর কড়া রোদ। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। নীলু বললো—তার শরীর খারাপ লাগছে।
সূর্যের দিন শেষ খন্ড
দাদুমণি চিন্তিত মুখে বললেন, ‘ঢাকায় ফিরে যাওয়াই বোধ হয়। ভাল। সাজ্জাদ কি বল ?
ঃ না, ঢিাকায় যাব না।
নীলু তুমি কি বল ? নী থেমে থেমে বললো-অামার শরীর খুব খারাপ লাগছে।
সন্ধ্যার দিকে একটা ট্রাক এলো, সেটি আবার ঢাকা ফিরে যাবে। ট্রাকের ড্রাইভার বললো—আপনারা যাবেন ঢাকায়?
না গিয়েই বা উপায় কি ? রাত কাটানোর একটা জায়গার দরকার। ট্রাকে উঠেই নীলুর প্রচণ্ড জ্বর এসে গেল। সে দু’বার বমি করে নেতিয়ে পড়লো।
আকাশের অবস্থা ভাল না। ঝড় বৃষ্টি হবে হয়তাে। দুরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছি। সাজ্জাদের বোন নীলুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আরো চারজন মহিলা আছেন ওদের সাথে। ওরা সবাই বসেছে পাশাপাশি। তাদের সঙ্গে তিন-চার বছরের দুটি ফুটফুটে বাচ্চা। এরী ঘুমিয়ে সে রাতে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। সুখানপুকুরের কাছাকাছি আসতেই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো।
সূর্যের দিন শেষ খন্ড
ঠিক এই সময় রোগমত একটি ছেলে চেঁচিয়ে বললো—“চুপ চপ। শুনেন সবাই শুনেন। ছেলেটির হাতে একটি ট্রানজিসটার। সে। বেতারের ট্রানজিসটার উচু করে ধরলো। চেঁচিয়ে বললো—স্বাধীন : বাংলা অনুষ্ঠান। স্বাধীন বাংলা বেতার।
ঘােষকের কথা পরিস্কার নয়। ট্রানজিসটারে ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। তবু সবাই শুনলাে ।
“ওরা জানে না অামরা কি চীজ। জানে না ইবিআরকি জিনিস। আমরা ওদের দুটি টিপে ধরেছি। তুমুল যুগ্ধ চলছে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।”
ঘোষকের কথা শেষ হওয়া মাত্র রোগী ছেলেটি বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো—“যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর আমাদের ভয় নাই। বলেন ভাই সবাই মিলে, জয় বাংলা।” নৌকার প্রতিটি মানুষ আকাশ ফাটানো ধ্বনিদিল। ছেলেটি বললাে
আবার বলেন। জয় বাংলা।
বলেন, ‘জয় বঙ্গবন্ধ। জয় বঙ্গবন্ধু ।
নীলু আচ্ছনের মত পড়ে ছিল। সে বিড় বিড় করে বললো, “কি হয়েছে ?
সাজ্জাদ হাসতে হাসতে বললো, নীলু, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর আমাদের ভয় নেই। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বললো।
ঃ কে যুদ্ধ করছে? ও বাঙালি মিলিটারিরা। ঃ শুধু ওরা ? : না আমরাও করব। আমিও যাবাে। : তোমাকে কি ওরা নেবে। সাজ্জাদ দৃঢ় স্বরে বললাে, নিতেই হবে।
যুদ্ধ শুরু হলো। রুখে দাড়ালো বাঙালি সৈন্য, বাঙালি পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী। তাদের সঙ্গে যোেগ দিল এ দেশের
Read More