আমিন সাহেব প্রিসিলাকে কোলে নিয়ে বসলেন। প্রিসিলা রিন রিনে গলায় ইংরেজিতে বললো, ‘গণ্ডগােল হচ্ছে কেন?’
ঃ গণ্ডগােল হচ্ছে, কারণ আমরা বাঙালিরা বলছি—আমরা মানুষের মত বাঁচতে চাই। পাকিস্তানীরা মানছে না। ওদের ধারণা আমরা মানুষ না।
রহেলা বিরক্ত মুখে বললেন, “থাক, রাজনৈতিক বক্ততা মেয়েকে না শোনালেও হবে।‘ | না শোনালে হবে না। এরা আন্দোলনের মধ্যে বড় হবে। এদের জানা দরকার এসব কি জন্যে হচ্ছে।
এখন না জানলেও হবে। এখন দয়া করে চুপ করে থাক।
আমিন সাহেব চুপ করে গেলেন। প্রিসিলা বললো, এ রকম বামেলা কতদিন চলবে?’
বলা মুশকিল। অনেকদিন ধরে চলতে পারে। তবে শুরু যখন হয়েছে, তখন একদিন না একদিন শেষ হবে। শুরু হওয়াটাই শক্ত।
তােমার কথা বুঝতে পারছি না বাবা, ইংরেজিতে বল। আমিন সাহেব ইংরেজিতে বললেন, তারপর হাসি মুখে বললেন, ‘এখন থেকে তােমাকে বাংলায় কথা বলা শিখতে হবে মা। ভাল করে বাংলা শিখে নাও।’
হোয়াই ডেডি ? ও কারণ তুমি বাঙালি মেয়ে, সেই জন্যে।
রাহেলা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘বাংলায় কথা বলা শিখতে হবে না। তুমি কথাবার্তা ইংরেজিতেই বলবে। নয়তো ইংরেজি ভুলে যাবে।
সূর্যের দিন খন্ড-৬
রাত আটটার দিকে একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেল, যেটা বিদেশীদের হোটেলে পৌছে দেবে। আটকেপড়া বাঙালিদের সম্পর্কে
কারো কোনাে মাথা ব্যথা নেই। আমিন সাহেব কথা বলতে গেলেন। ওদের সঙ্গে। একজন পাকিস্তানী মিলিটারি অফিসারের দায়িত্বে বাসটি যাবে। আমিন সাহেবকে মিলিটারি অফিসারটি শান্ত ভাবে বললো-ব্যবস্থাটি ফরেনারদের জন্যে। | কিন্তু আমার মেয়েটি অসুস্থ।
অসুখ হোক আর যাই হোক, আমার কিছু করার নেই। এই অবস্থার জন্যে দায়ী আপনারা বাঙালিরা। এর ফল ভােগ করতে হবে আপনাদের।
দিয়েছেন। সব কটি জানালাও বন্ধ করা হয়েছে। চারদিকে গা চমকানো একটা অন্ধকার। বুড়ো লোকটি সাজ্জাদের দিকে তাকা লেন। তাঁর চোখে মােটা ফ্রেমের একটা চশমা। একটু রাগী চেহারা। গায়ে সাদা রঙের একটা চাদর। নুয়ে নুয়ে হাঁটেন।
তোমার নাম কি? সাজ্জাদ। ও আর তোমার নাম ? শাহজাহান। ও তোমাদের ভয় লাগছে ? ও জ্বি না। সাজ্জাদ তোমার পা কেটে গিয়েছে দেখছি, ব্যথা করছে? ও জি না। এসো আমার সাথে, পা ধুইয়ে ডেটল লাগিয়ে দিচ্ছি। আমার কিছু লাগবে না।
ও বাজে কথা বলবে না। বাজে কথা আমি পছন্দ করি না। নীলু। নীলু।
সাজ্জাদ এবং টুনু দেখলে ওদের বয়েসী একটি মেয়ে এসে দরজার ও পাশে দাঁড়িয়েছে। বুড়ো ভদ্রলােক বললেন, এই মেয়েটি আমার নাতনি, ওর নাম নীলাঞ্জনা। আর এদের একজনের নাম শাহজাহান। অন্য জনের নাম সাজ্জাদ। বলতো নীলু কার নাম সাজ্জাদ ?
সাজ্জাদ এবং শাহজাহান মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। বুড়োটা পাগল নাকি? মেয়েটি কিন্তু ঠিকই সাজ্জাদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো। বুড়ো মহাখুশি।
ঠিক হয়েছে, এখন যাও ডেটল নিয়ে এস। তুলা আন। আর সাজ্জাদ, তুমি বাথরুমে গিয়ে গা ধুয়ে এস। নীলুর সঙ্গে যাও। নীল দেখিয়ে দেবে।
সূর্যের দিন খন্ড-৬
আমার কি লাগবে না। : একটা চড় লাগাবো। যা বলছি কর।
সাজ্জাজ উঠে পড়লো। বাথরুমটা বাড়ির একেবারে শেষপ্রান্তে। নীলু বললো, “দাদুমণির রাগ খুব বেশি। তিনি যা বলেন তা সঙ্গে সঙ্গে না করলে খুব রাগ করেন। সাজ্জাদ মুখ গোমড়া করে বললো, “আমি কাউকে ভয় পাই না।
জিনিস আমি খুব অপছন্দ করি সেটা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। কেউ যদি মিথ্যা কথা বলে আমি তা সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারি।
এই সময় বাইরের রাস্তায় খুব হৈ চৈ হতে লাগলো। ঘন্টা বাজিয়ে একটা দমকল গেল। লোকজন ছোটাছুটি করতে লাগলো। একটা ভারী ট্রাক গেল। সম্ভবত মিলিটারি ট্রাক। বুড়ো ভদ্রলােক বললেন, ‘মনে হচ্ছে আজ রাতটা তোমাদের এখানেই কাটাতে হবে। শােন, নীলু আমাকে দাদুমণি ডাকে। তােমরাও তাই ডাকবে। এখন যাও, নীলুর সঙ্গে গল্প-টল্প কর। পরে তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। দাদুমণি খাতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা সূর্যের দিন খন্ড-৭