ফরিদা আমাকে দেখে যে রকম খুশি হয় তার ছেলে ইমরুলও খুশি হয়। এই খুশির কোনােরকম ন্যাকামি সে দেখায় না। বরং ভাব করে যেন আমাকে। চিনতে পারছে না। শুধু যখন আমার চলে যাবার সময় হয় তখন মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার ফাকে ফাকে বলে– হিমু যাবে না। হিমু থাকবে।
ইমরুল বারান্দায় বসে ছবি আঁকছিল। আমাকে দেখেই ফিক করে হেসে অন্য দিকে ঘুরে বসল। দু’হাত দিয়ে ছবি ঢেকে ফেলল।
আমি বললাম, অন্য দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার দিকে তাকা। ইমরুল তাকাল না। গভীর মনোেযােগে ছবি আঁকতে থাকল। সে সাধারণ ছবি আঁকতে পারে না। রাক্ষসের ছবি আঁকে। তবে ভয়ঙ্কর রাক্ষস না। প্রতিটি রাক্ষস হাস্যমুখী। আমাকে চিনতে না পারা হলাে ইমরুলের স্বভাব। তার সঙ্গে যতবার দেখা হয় ততবারই প্রথম কয়েক মিনিট ভাব করে যেন আমাকে চিনতে পারছে না।
আমি বললাম, তাের খবর কী রে ?
সে আসে ধীরে খন্ড-৬
ইমরুল জবাব দিল না। আমাকে চিনতে পারছে না— এখন সে এই ভাবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
কিসের ছবি আঁকছিস ?
রাসের।
কোন ধরনের রক্ষস? পানির রাক্ষস না-কি শুকনার রাক্ষস? পানির রাক্ষস।। রাক্ষসটার নাম কী ? নাম দেই নাই। নাম না দিলে হবে ? তাের নিজের নাম আছে আর রাক্ষসটার নাম থাকবে না। তুমি নাম দিয়ে দাও।
রাক্ষসটা কেমন এঁকেছিস দেখা, তারপর নাম ঠিক করব। চেহারার সাথে তার নামের মিল থাকতে হবে। কানা রাক্ষসের নাম পদ্মলােচন রাক্ষস দেয়া যাবে না। তাের বাবা কি বাসায় আছে।
আমি তাের বাবার কাছে যাচ্ছি। ছবি আঁকা শেষ হলে আমার কাছে নিয়ে আসবি। আকিকা করে নাম দিয়ে দেব।
আকিকা কী ?
আছে একটা ব্যাপার। নাম দেয়ার আগে আকিকা করতে হয়। হেলে রাক্ষস হলে দুটা মুরগি লাগে, মেয়ে রাক্ষসের জন্যে লাগে একটা। তুই যে রাক্ষসটা আঁকছিস সেটা ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
ঠিক আছে, এঁকে শেষ কর। ততক্ষণে তাের বাবার সঙ্গে জরুরি কিছু আলাপ করে নেই।
সে আসে ধীরে খন্ড-৬
হাবিবুর রহমান সাহেবের বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। গত ছ’মাস ধরে তাকে দেখাচ্ছে পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়ের মতাে। মাথার চুল খাবলা খাবলাভাবে পেকে গেছে। মুখের চামড়া ঝুলে গেছে। গলার স্বরেও শ্লেমা মেশানাে বৃদ্ধ ভাব এসে গেছে। শুধু চোখে ছানি পড়াটা বাকি। চোখে ছানি পড়লে মােলকলা পূর্ণ হয়।
গত ছ’মাস ধরে ভদ্রলােকের চাকরি নেই। তার স্ত্রী ফরিদা গুরুতর অসুস্থ। গত দু’মাস ধরে হাসপাতালে আছে। হার্টের ভাষে সমস্যা হয়েছে। দূষিত রক্ত, বিশুদ্ধ রক্ত হার্টের ভেতর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের মিলমিশ বন্ধ
হলে ফরিদা জীবিত অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বের হতে পারবে এমন মনে হয় না। এক লক্ষ টাকার নিচে হার্টের অপারেশন হবার সম্ভাবনা নেই। বিশ হাজার টাকা কয়েক দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে।
হাবিবুর রহমান ঠাণ্ডা মেঝেতে বালিশ পেতে শুয়েছেন। তাঁর গা খালি। লুঙ্গি অনেকদূর গুটানাে। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মানুষ যেমন কিছুক্ষণ হকচকানাে অবস্থায় থাকে, কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না— তার সে-রকম হলাে। তিনি বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে ?
আমি বললাম, আমি হিমু।
সে আসে ধীরে খন্ড-৬
ও আচ্ছা আচ্ছা, আপনি কিছু মনে করবেন না। সরি। আমার মাথা পুরাপুরি আউলা অবস্থায় চলে গেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে এসেছেন। বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
হচ্ছে না। তবে হবে। আপনি ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে আছেন কেন?
হাবিবুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, হিমু ভাই, শরীর চড়ে গেছে। সারা শরীরে জ্বালাপােড়া। সিমেন্টের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকলে আরাম হয়। তা-ও পুরােপুরি জ্বলুনি কমে না। বরফের চাঙের উপর শুয়ে থাকতে পারলে ভালাে লাগত।
আমি বললাম, মাছপট্টি থেকে বরফের একটা চাঙ কিনে নিয়ে আসেন। দাম বেশি পড়বে না।
সত্যি কিনতে বলছেন ? হ্যা। সব চিকিৎসার বড় চিকিৎসা হলাে মন-চিকিৎসা। মন যদি কোনাে চিকিৎসা করতে বলে সেই চিকিৎসা করে দেখা দরকার। চলুন যাই, বড় দেখে একটা বরফের চাঙ কিনে নিয়ে আসি।
হাবিবুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, আপনাকে এত পছন্দ করি কিন্তু আপনার কথাবার্তা বেশিরভাগই বুঝতে পারি না। কোনটা রসিকতা কোনটা সিরিয়াস কিছুই ধরতে পারি না। ফরিদা দেখি ধরতে পারে। তার বুদ্ধি বেশি। তার তুলনায় আমি পাঁঠা-শ্রেণীর।
ফরিদা আছে কেমন ?
ভালাে না। ভাব দেখাচ্ছে ভালাে আছে। দেখা করতে গেলে ঠাট্টা ফাজলামিও করে। কিন্তু আমি তাে বুঝি!