কারণ আমি চেয়েছিলাম মেয়ে হােক। ফরিদার সব কিছু আমাকে ঘিরে। এখন সে মারা যাবে বিনা চিকিৎসায়, আমি কিছুই করতে পারছি না— এটা হলাে
বিশ হাজার টাকা জোগাড় হয় নি। হাবিবুর রহমান ছােষ্ট্র নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, না। চেষ্টাও করি নি। কেন? বিশ হাজার টাকা যদি জোগাড় করি, বাকিটা পাব কোথায় ?
আমি বললাম, সেটা অবশ্য একটা কথা।
হাবিবুর রহমান বললেন, ফরিদা আমার সঙ্গে থাকবে না— মানসিকভাবে এই সত্যি আমি মেনে নিয়েছি। ইমরুলকে কীভাবে বােঝাব মাথায় আসছে না।
আমি বললাম, এইসব জটিল জিনিস হােটরা খুব সহজে বুঝতে পারে। ইমরুলকে নিয়ে আপনি মােটেই চিন্তা করবেন না।
আরেক কাপ চা কি দেব হিমু ভাই? দিন আরেক কাপ।
আমি দুকাপ চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম, ও আচ্ছা, ইমরুলের জন্মদিনের উপহার তাে দেয়া হলাে না। আজ উপহার নিয়ে এসেছি। ঐদিন খালি হাতে জন্মদিনে এসেছিলাম। তখনই ভেবে রেখেছি পরে যখন আসব কোনাে উপহার নিয়ে আসব।
সে আসে ধীরে খন্ড-৮
হাবিবুর রহমান বললেন, কী যে আপনি করেন হিমু ভাই। গরিবের ছেলের আবার জন্মদিন কী ? তারিখটা মনে রেখে আপনি যে এসেছেন এই খুশিই আমার রাখার জায়গা নাই। কী গিফট এনেছেন ?
ক্যাশ টাকা এনেছি। গিফট কেনার সময় পাই নি। আমি টাকার বান্ডিলটা হাবিবুর রহমান সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম।
হাবিবুর রহমান সাহেব অনেকক্ষণ টাকার বান্ডিলের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, এখানে বিশ হাজার টাকা আছে, তাই না?
আমি বললাম, হু।
তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। | চোখের পানি বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমি লক্ষ করেছি, শুধুমাত্র কুমারী মেয়েদের চোখের পানি দেখতে ভালাে লাগে। পুরুষ মানুষের চোখের পানি দেখা মাত্রই রাগ ভাব হয়। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার চোখের পানি বিরক্তি তৈরি করে।
আমি হাবিবুর রহমান সাহেবের চোখের পানি কিছুক্ষণ দেখলাম। আমার রাগ উঠে গেল। আমি তার দিকে না তাকিয়ে বললাম, যাই । তিনি জবাব দিলেন
আমি চলে এলাম বারান্দায়। ইমরুল এখনাে ভূতের ছবি একে যাচ্ছে। আমি বললাম, ইমরুল যাই। সে মাথা নিচু করে ফেলল। এটা তার কান্নার প্রস্তুতি। আমি চলে যাচ্ছি— এই দুঃখে সে কিছুক্ষণ কাঁদবে । আগে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। এখন মা পাশে নেই। কাদার ব্যাপারটা তাকে একা একা করতে হয়।
সে আসে ধীরে খন্ড-৮
কাঁদছিস না-কি ?
ভালােই হলাে। বাপ-বেটা দু’জনের চোখেই জল। চোখের জলে চোখের জলে ধুল পরিমাণ। মাকে দেখতে যাবি?
না কেন ? মাকে দেখতে ইচ্ছা করে না ?
ইমরুল জবাব দিল না। চোখ মুছে ফোঁপাতে লাগল । ইমরুলের চরিত্রের এই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। যে মায়ের জন্যে তার এত ভালােবাসা অসুস্থ হবার পর সেই মা’র প্রতি তার কোনাে আগ্রহ নেই কেন? সে কি ধরেই নিয়েছে মা আর সুস্থ হয়ে ফিরবে না ?
কিরে ব্যাটা, মাকে দেখতে যাবি না? চল দেখে আসি ?
না।
তাহলে একটা কাজ কর— রাক্ষসের ছবিটা দিয়ে দে, তাের মাকে দিয়ে আসি। ছবির এক কোনায় লাল রঙ দিয়ে লিখে দে— মা। মা লিখতে পারিস?
পারি।
সুন্দর করে মা লিখে চারদিকে লতা-ফুল-গাছ দিয়ে ডিজাইন করে দে। পারবি না ?
পারব।
পারলে তাড়াতাড়ি কর। কান্না বন্ধ। কাঁদতে কাঁদতে যে ডিজাইন করা হয় সে ডিজাইন ভালাে হয় না। | ইমরুল কান্না থামিয়ে ডিজাইন করার চেষ্টা করছে। কান্না পুরােপুরি থামছে না। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতাে কিছুক্ষণ পর পর উঠে আসছে । আচ্ছা— কান্নার সঙ্গে তাে সমুদ্রের খুব মিল আছে। সমুদ্রের জল নােনা। চোখের জল নােনা। সমুদ্রে ঢেউ ওঠে। কান্নাও আসে ঢেউয়ের মতাে।
কোনাে কোনাে মানুষকে কি অসুস্থ অবস্থায় সুন্দর লাগে? ব্যাপারটা আগে তেমনভাবে লক্ষ করি নি। ফরিদাকে খুবই সুন্দর লাগছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এইমাত্র গরম পানি দিয়ে গােসল করে সেজেগুজে বসে আছে। কোথাও বেড়াতে যাবে। গাড়ি এখনাে আসে নি বলে অপেক্ষা। আমি বললাম, কেমন আছ ফরিদা।
ফরিদা বলল, খুব ভালাে।
সে আসে ধীরে খন্ড-৮
আমি বললাম, তােমাকে দেখেও মনে হচ্ছে খুব ভালাে আছ। রাতে ভালাে ঘুম হয়েছে ?
রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই। ঘুম তাে ভালাে হবেই। তবে কাল রাতে ভালাে ঘুম হয় নি।
কেন? সেটা আপনাকে বলা যাবে না।
ফরিদা মুখ টিপে হাসছে। দুষ্টুমির হাসি। এইসব দুষ্টুমির ব্যাপার তার মধ্যে আগে ছিল না। ইদানীং দেখা দিয়েছে।
ইমরুল তােমার জন্যে উপহার পাঠিয়েছে, ভূতের ছবি। আমি স্কচ টেপ নিয়ে এসেছি। এই ছবি আমি তােমার খাটের পেছনের দেয়ালে লাগিয়ে দেব। ডাক্তাররা রাগ করবে না তাে?
রাগ করতে পারে।