হুমায়ূন আহমেদের লেখা সে আসে ধীরে খন্ড-১

উস মৃত্যুর কাছাকাছি যাবার মতাে ঘটনা আমার জীবনে কয়েকবারই ঘটেছে। একবারের কথা বলি। আমায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে আমাকে নেয়া হয়েছে হায়ােগ ইনস্টিটিউটে। আমি চলে গিয়েছি প্রবল ঘােরের মধ্যে, চারপাশের পৃথিবী হয়েছে অস্পষ্ট। এর মধ্যেও মনে হয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরা এক যুবক আমার পাশে বসে। কে সে?

হিমু না-কি? আমি বললাম, কে? যুবক কালো কাদো গলায় বলল, হুমায়ূন ভাই, আমি স্বাধীন। আপনার শরীর এখন কেমন? শরীর কেমন জবাব দিতে পারলাম না, আবারাে অচেতন হয়ে পড়লাম। এক সময় জ্ঞান ফিরল। হলুদ পাঞ্জাবি পরা যুবক তখনাে পাশে বসা। আমি বললাম, কে ? যুবক কাপা কাপা গলায় বলল, আমি স্বাধীন।

সে-আসে-ধীরেহিমুর এই বইটি স্বাধীনের জন্যে। যে মমতা সে আমার জন্যে দেখিয়েছে সেই মমতা তার জীবনে বহুগুণে ফিরে আসুক তার প্রতি এই আমার 

কামনা। 

আক্কেলগুড়ুম’ নামে বাংলা ভাষায় একটি প্রচলিত বাগধায়া আছে। যা দেখে গুডুম শব্দে আক্কেল থুবড়ি খেয়ে পড়ে- তাই আক্কেলগুড়ুম। মাজেদা খালাকে দেখে আমার মাথায় নতুন একটা বাগধারা তৈরি হলাে– পৃমি ‘। আক্কেলগুড়মে যেমন আক্কেল ধুবড়ি খেয়ে পড়ে, দৃষ্টিগুড়মে দৃষ্টিও সেই অবস্থা হয়। আমার দৃষ্টি থুবড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।

সে আসে ধীরে খন্ড-১

খালা হুবহুল আকার ধারণ করেছেন। ফুলে-ফেঁপে একাকার হয়েছেন। ইচ্ছা করলেই বিশ্বের এক নম্বর মােটা মহিলা হিসেবে তিনি যে-কোনাে সার্কাস পার্টিতে জয়েন করতে পারেন। আমি নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম- ইয়া।

মাজেদা খালা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কী বললি? আমি বিনীতভাবে বললাম, ইয়া হু বলেছি। খালা বললেন, ইয়া হু মানে কী? 

ইয়া হ’র কোনাে মানে নেই। আমরা যখন হঠাৎ কোনাে আবেগে অভিভূত হই তখন নিজের অজান্তেই ইয়া হু’ বলে চিৎকার দেই। যারা ইসলামি ভাবধারার মানুষ, তারা বলে ‘ইয়া আলি’। 

ইয়া হু’ বলার মতাে কী ঘটনা ঘটেছে। 

আমি বললাম, ঘটনা তুমি ঘটিয়েছ খালা। তােমার যে অবস্থা তুমি যে কোনাে সুমমা রেসলারকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের মতাে কুঁ করে গিলে ফেলতে পার। ব্যাটা বুঝতেও পারবে না। 

খালা হতাশ গলায় বললেন, গত বছর শীতের সময় টনসিল অপারেশন করিয়েছি, তারপর থেকে এই অবস্থা। রােজ ওজন বাড়ছে। খাওয়া-দাওয়া এখন প্রায় বন্ধ। কোনাে লাভ হচ্ছে না। বাতাস খেলেও ওজন বাড়ে। গত পনেরাে দিন ভয়েই ওজন করি নি। ভালাে করেছ। ওজন নেয়ার স্টেজ তুমি পার করে ফেলেছ। 

আমাকে নিয়ে তাের বক্তৃতা দিতে হবে না। তােকে এ জন্যে ডাকি নি। আরাে সিরিয়াস ব্যাপার আছে। তুই চুপ করে বােস। কিছু খাবি? 

সে আসে ধীরে খন্ড-১

 মাজেদা খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার কোনাে কথায় না বলবি না। আমি না শুনতে পারি না। গরম গরম পরােটা ভেজে দিচ্ছি, খাসির রেজালা দিয়ে খা। আমার নিজের খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ । অন্যদের খাইয়ে কিছুটা সুখ পাই । বাসি পােলাও আছে। পরােটা খাবি না-কি বাসি পােলাও গরম করে দেব ? 

দু’টাই দাও। মাজেদা খালার বিরক্ত মুখে এইবার হাসি দেখা গেল। তিনি সত্যি সত্যি থপথপ শব্দ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। এই মহিলাকে দেড় বছর পর দেখছি। দেড় বছরে শরীরকে হুলুস্থুল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া বিস্ময়কর ঘটনা। বিস্ময় হজম করতে আমার সময় লাগছে। 

তুমি হিমু না ? 

আমার পিছন দিকের দরজা দিয়ে খালু সাহেব ঢুকেছেন। তিনি এই দেড় বছরে আরাে রােগা হয়েছেন। চিমশে মেরে গেছেন। মানুষের চোখে হতাশ ভাব দেখা যায়— ইনার শরীরের চামড়ায় হতাশ ভাব চলে এসেছে। তিনি অসীম বিরক্তি নিয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন।

আমি এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ করেছি কোনাে বাড়িতে যদি কেউ একজন আমাকে খুব পছন্দ করে তাহলে আরেকজন থাকবে যে আমাকে সহ্যই করতে পারবে না। যতটুকু ভালােবাসা ঠিক ততটুকু ঘৃণায় কাটাকাটি। সাম্যাবস্থা, ন্যাচারাল ইকুইলিব্রিয়াম। 

খালু সাহেব বললেন, তুমি এখানে বসে আছ কেন? আমার যতদূর মনে পড়ে তােমাকে আমি বিশেষভাবে বলেছিলাম, ভবিষ্যতে কখনাে এ বাড়িতে পা দেবে না

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা সে আসে ধীরে খন্ড-২

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *