বই–প্রেমিক। হাতে বইটা পাবার পর আশপাশের সবকিছু ভুলে গেছেন। আমাকে সাধারণ ভদ্রতার ধন্যবাদও দেননি। আমি নিশ্চিত, আবার যখন দেখা হবে তখন দেবেন।
পরের বছর চৈত্র মাসের কথা (আমার জীবনের বড় বড় ঘটনা চৈত্র মাসে ঘটে।
বই বগলে নিয়ে ভদ্রলােক এগুচ্ছেন। আমি তার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। তার চোখ ভালমত না দেখে বিদেয় হওয়া যায় না। ভদ্রলােক হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ে বললেন, আপনার নাম কি?
আমি বললাম, আমার নাম হিমালয়। | ভদ্রলােক বললেন সুন্দর নাম – হিমালয়। বললেন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। হিমালয় নাম শুনে সবাই সামান্য হলেও কৌতূহল নিয়ে আমাকে দেখে, ইনি তাও দেখছেন না। যেন হিমালয় নামের অনেকের সঙ্গে তার পরিচয় আছে।
আমরা নিউ মার্কেটের কার পার্কিং এলাকায় গিয়ে পৌছলাম। তিনি শাদা রঙের বড় একটা গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললেন, আসুন, ভেতরে আসুন।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ভেতরে যাব কেন?
তিনি আমার চেয়েও বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার বাড়িতে চলুন, আপনাকে টাকা দিয়ে দেব। তারপর আমার ড্রাইভার আপনি যেখানে যেতে চান সেখানে পৌছে দেবে।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৫
‘জি ভাল আছি। ‘তােমার হাতে লাল–সবুজ চুড়ি নেই কেন?”
মারিয়া ঘাড় বাকিয়ে তাকাল। কিছু বলল না। আমি মেয়েটিকে চিনতে পারছি । তাতে কিছু যায় আসে না। মারিয়া বলল, আপনি কি অসুস্থ? কে বলবে রহস্যটা কি?) বেলা একটার মত বাজে। ঝা ঝা রােদ উঠে গেছে। অনেকক্ষণ হেঁটেছি বলে শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পাঞ্জাবির এমন অবস্থা যে দুহাতে চিপে উঠোনের দড়িতে শুকোতে দেয়া যায়। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম। ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
চোখের সামনে ভাসছে বড় মাপের একটা গ্লাস। গ্লাস ভর্তি পানি। তার উপর বরফের কুচি। কাচের পানির জগ হাতে আরেকজন দাড়িয়ে আছে। গ্লাস শেষ হওয়ামাত্র সে গ্লাস ভর্তি করে দেবে। জগ হাতে যে দাড়িয়ে আছে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু হাত দেখা যাচ্ছে – ধবধবে ফর্সা হাত। হাত ভর্তি লাল আর সুজ কাচের চুড়ি। জগে করে পানি ঢালার সময় চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ উঠছে।
কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। চৈত্র মাসের দুপুরে ঢাকার রাজপথে পানির জগ হাতে চুড়িপরা কোন হাত থাকে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, কোনদিন যদি প্রচুর টাকা হয় তাহলে চৈত্র মাসে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় জলসত্র খুলে দেব। সেখানে হাসিখুশি তরুণীরা পথচারীদের বরফ শীতল পানি খাওয়াবে। ট্যাপের পানি না – ফুটন্ত পানি। পানিবাহিত জীবাণু যে পানিকে দূষিত করেনি সেই পানি। তরুণীদের গায়ে থাকবে আকাশী রঙ–এর শাড়ি। হাত ভর্তি লাল–সবজ চডি। চডির লাল রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ঠোটে থাকবে আগন-রঙা লিপস্টিক। তাদের চোখ কেমন হবে? তাদের চোখ এমন হবে যেন চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় –
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৫
“প্রহর শেষের আলােয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস তােমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ। আপনি তাে আমাকে চেনেন না – আমি কে জানতে চাচ্ছেন না কেন?
‘তুমি কে? ‘আমি আসাদুল্লাহ সাহেবের মেয়ে।
ও আচ্ছ। ‘আসাদুল্লাহ সাহেব কে তাও তাে আপনি জানেন না। ‘না। উনি কে?
‘উনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাকে আপনি একবার একশ টাকা ধার দিয়েছিলেন। মনে পড়েছে?
‘হ্যা, মনে পড়েছে। | ‘যে ভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় এখনাে মনে পড়েনি। আপনি বাবাকে বলেছিলেন — তার একটা চোখ পাথরের – এখন মনে পড়েছে? | ‘হ্যা, মনে পড়েছে। আমরা কি এখন তার কাছে যাচ্ছি? তাকে ঋণমুক্ত করার পরিকল্পনা ? | ‘না – তিনি দেশে নেই। বছরে মাত্র তিনমাস তিনি দেশে থাকেন। আপনার সঙ্গে দেখা হবার দুমাস পরই তিনি চলে যান। এই দুমাস আপনি তার সঙ্গে যােগাযােগ করেননি বলে তিনি খুব আপসেট ছিলেন।
তিনি চলে যাবার আগে আপনার চেহারার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বলে গিয়েছিলেন যদি আপনাকে আমি বের করতে পারি তাহলে দারুণ একটা উপহার পাব। তারপর থেকে আমি পথে বের হলেই হলদ পাঞ্জাবি পরা কাউকে দেখলেই জিজ্ঞেস করি – আপনার নাম কি হিমালয়? ভাল কথা, আপনি আসলেই হিমালয় তাে??
‘– আমিই হিমালয়। ‘প্রমাণ দিতে পারেন?
‘পারি – আপনার বাবা যে বইটা কিনেছিলেন – তার নাম – “Interpretation of Conscience“.’
‘বাবা বলেছিলেন – আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ। আমার কাছে অবশ্যি তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।
‘আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৫
প্রচণ্ড রােদের কারণেই বােধহয় মরীচিকা দেখার মত ব্যাপার ঘটল। আমি চোখের সামনে জলসত্রের মেয়েগুলিকে দেখতে পেলাম। একজন না, চার–পাঁচ জন। সবার হাতেই পানির জগ। হাত ভর্তি লাল-সবুজ চুড়ি। আর তখন আমার পেছনে। একটা গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে মাথা বের করে জলসত্রের তরুণীদের একজন। বলল, এই যে শুনুন। কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কি হিমালয় ? আমি বললাম, যা। ‘গাড়িতে উঠে আসুন। আমার নাম – মারিয়া।
মেয়েটার বয়স তের-চৌদ্দ, কিংবা হয়ত আরাে কম। বাচ্চা মেয়েরা হঠাৎ শাড়ি পরলে অন্য এক ধরনের সৌন্দর্য তাদের জড়িয়ে ধরে। এই মেয়েটির বেলায়ও তাই হয়েছে। মেয়েটি জলসত্রের মেয়েদের নিয়মমত আকাশী রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরা মেয়েদের কখনাে তুমি বলতে নেই, তবু আমি গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম, কেমন আছ মারিয়া ?
ভাবের লােকজনদের কেউ ঘরে ঢােকাতে চায় না। রাস্তা-ভাবের লােক রাস্তাতেই ভাল। কবিতা আছে না –
বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
আমি সম্ভবত রাস্তাতেই সুন্দর।
‘গুলশানের দিকে যাচ্ছি।
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-১৫
গাড়ির ভেতরে এসি দেয়া — শরীর শীতল হয়ে আসছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি জেগে থাকতে। ঘুম আনার জন্যে মানুষ ভেড়ার পাল গােনে। ঘুম না আসার জন্যে কিছু কি গােনার আছে? ভয়ংকর কোন প্রাণী গুনতে শুরু করলে ঘুম কেটে যাবার কথা। আমি মাকড়সা গুনতে শুরু করলাম।
একটা মাকড়সা, দুটা মাকড়সা, তিনটা – চারটা, পঁচটা। সর্বনাশ! পঞ্চমটা। আবার ব্লাক উইডাে মাকড়সা – কামড়ে সাক্ষাৎ মৃত্যু। | এত গােনাগুনি করেও লাভ হল না। মারিয়াদের বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন আমি গভীর ঘুমে অচেতন। মারিয়া এবং তাদের ড্রাইভার দুজন মিলে ডাকাডাকি করেও আমার ঘুম ভাঙাতে পারছে না। | মারিয়াদের পরিবারের সঙ্গে এই হচ্ছে আমার পরিচয়ের সূত্র। মারিয়ার বয়স তখন পনেরাে। সেদিনই সে প্রথম শাড়ি পরে। শাড়ির রঙ বলেছি কি? ও হঁ্যা, আগে একবার বলেছি। আচ্ছা আবারাে বলি, শাড়ির রঙ জলসত্রের মেয়েদের
Read More