হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

ফটোগ্রাফার খুশি দারুণ একটা ছবি তােলা গেল । হিমুর রূপালী রাত্রি

মেঝে থেকে লেপ তুলতে গিয়ে আমি ছােটখাট একটা শকের মত পেলামআমার ঘরে বাইশতেইশ বছরের একটা মেয়েপায়ের কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেমেয়েটা প্রিন্টের একটা শাড়ি পরেছেশীতের জন্যে মাথায় স্কার্ফ বাঁধামেয়েটিকে সুন্দর দেখাচ্ছে বললে ভুল হবেঅপূর্ব লাগছে বললেও কম বলা হয়

স্বপ্ন দৃশ্যের মেয়েরাই এত সুন্দর হয়। একটু আগে স্বপ্নে ইয়াকুবকে দেখেছি— এই মেয়েটিকেও স্বপ্ন দেখছি না তাে। আজ বােধহয় আমার স্বপ্ন দেখার দিননা স্বপ্ন না, মেয়েটির গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছেস্বপ্ন দৃশ্যে গন্ধ থাকে নামেয়েটার চোখ তর্তি বিশ্বয়ঠোঁট চেপে সে হাসছেঘুমের মধ্যে আমি হাস্যকর কোন কাণ্ড করেছি কিনা কে জানে। 

শান্ত চেহারার মেয়েনিশ্চয়ই কোন বাড়ির বড় মেয়ে, যার অনেকগুলি ছােট ছােট ভাইবােন আছেভাই-বােনগুলি দুষ্টএদের বাইকে সামলে সুমলে রাখতে হয়ধরনের বাড়ির বড় মেয়েদের চেহারা এ রকম হয়এর মেয়ে হিসেবে খুবই ভাল, শুধু সমস্যা একটাইএরা সবাইকে ছােট ভাই বােনের মত দেখেআমার যদি ঘুম ভেঙ্গে না যেত আমি নিশ্চিত সে মেঝে থেকে লেপ তুলে আমার গায়ে দিয়ে দিতমাথার নিচের বালিশ ঠিকঠাক করে দিত

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি— মেয়েটা কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আমার পরিচিত। পরিচিত না হলে ঘরে ঢুকবে নাদরজা খােলা থাকলেও উকি দিয়ে দেখেই দরজায় টোকা নেবে। ঘরের বাইরে থেকে সাড়াশব্দ করে ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্টা করবেমেয়েদের সম্পর্কে সবার ধারণ তারা খুব ধৈর্যশীলাআসলে তা না মেয়েরা ধৈর্য ধরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে নাবন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেরা যেখানে দু তিনবার কলিং বেল টিপবেমেয়েরা সেখানে কলিং বেল টিপে যেতেই থাকবে। 

মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আপনি বােধহয় আমাকে দেখে খুবই বিস্মিত হচ্ছেন। ভাবছেন কেনা কে? অভদ্রের মত ঘুমন্ত মানুষের ঘরে বসে আছে| আমি লেপ দিয়ে গা ঢাকতে ঢাকতে বললাম, আমি মােটেই বিস্মিত হচ্ছি না। আপনাকে দেখে ভাল লাগছে। 

অপরিচিত একজন মানুষ ঘরে ঢুকে বসে আছে, তারপরেও বিস্মিত হচ্ছেন ?  নাকারণ আপনি মােটেই অপরিচিত ননআপনি হলেন তামান্না। 

ফাতেমা খালাপি..। 

মেয়েটা নিজেই এবার বিস্মিত হয়ে বলল, বুঝলেন কি করে

 ‘আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা দিয়ে টের পাচ্ছি। খালা আপনাকে আমার অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু বলেনি?” 

বলেছেন। ‘আপনি বিশ্বাস করেননি? ‘কিনা। ‘এখন কি করছেন? 

‘এখনাে করছি না। আপনি অনুমান করে বলেছেন আমি তামান্না। এমন কোন জটিল অনুমানও না। সহজ অংক। দূই দুই-এ চার। 

“ঠিক বলেছেন। আমার নিজেরাে ধারণা আমার কোন ক্ষমতা নেই। তবে অনেকের ধারণ খুব প্রবলভাবেই আছে। আপনার মাডাম অর্থাৎ ফাতেমা খালা তাদের মধ্যে একজন । 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

আমি ম্যাডামের একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। ‘আপনাকে পাঠালাে কেন? খালার টাই পরা ম্যানেজার কোথায়, বুলবুল ভাইয়া? 

উনি আছেন। তারপরেও আমাকে পাঠিয়েছেন। নিশ্চয়ই কোন একটা উদ্দেশ্য আছে। যাই হােক, এই নিন চিঠি। আপনি চিঠি পড়ুন, আমি চললাম।। 

‘চিঠি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসুন। হয়ত চিঠিতে জরুরী কিছু আছে। আপনাকে নিয়েই জবাব পাঠাতে হবে।’ | ‘আচ্ছা আপনি চিঠি পড়ুন, আমি বসছি। আপনি কি দরজা খােলা রেখে ঘুমান? চোর ঢুকে না? 

‘কে। আমার ঘরের জিনিসপত্র দেখে লজ্জা পেয়ে চলে যায়। চোরদেরও কিন্তু চক্ষু লজ্জা আছে। 

‘ঘর খােলা রেখে ঘুমান কেন? চোরদের লজ্জা দেবার জন্যে?” 

‘তা না। আমার বাবা আমাকে খােলা মাঠে ঘুমুতে বলেছেন। খােলা মাঠের বিকল্প হিসেবে খােলা ঘর । 

আমি চিঠি পড়া শুরু করেছি। তামান্না আড়চোখে আমাকে দেখছে। মনে হচ্ছে আমার চিঠি পড়া দেখে সে মজা পাচ্ছে। খালা তাঁর দুর্বোধ্য হাতের লেখায় লিখেছেন 

হিমু, 

তুই যে গেলি আর তাে দেখা নেই। একদিন শুধু টেলিফোনে হড়বড় করে কিসব বললি। মাথার যন্ত্রণায় সব বুঝতে পারলাম না। ইয়াকুবকে ধোঁজার ব্যাপারে কি করছিস আমাকে জানাবি না? না-কি ভুলেই গেছিস যে, 

তােকে একটা দায়িত্ব দিয়েছি? তাের চশমা, চাদর, নতুন পাঞ্জাবী সব তাে ফেলে গেলি। 

ঐদিন একটা ফুলও করেছি – ইয়াকুবকে খুঁজে বের করার জন্যে তােকে কিছু খরচ দেব বলে ভেবে রেখেছিলাম। সেদিন যাবার সময় ওই এমন তাড়াহুড়া শুরু করলি যে খরচ দেবার কথাটাই মাথা থেকে দূর হয়ে। গেল। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

দুই রবি সােম এই দু’ দিন বাদ দিয়ে যে কোন একদিন চলে আয়। ম্যানেজারকে না পাঠিয়ে ইচ্ছে করে তামান্নাকে পাঠালাম । যাতে তাের সঙ্গে পরিচয় হয়। কৌশলটা ভাল করিনি? মেয়েটাকে নিশ্চয়ই তাের পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হবার মতই মেয়ে। দেখতেও খুব সুন্দর তাই না?

রঙটা শুধু যদি আর এক গােছ সাদা হত তাহলে আর চোখ ফেরানাে যেত না। মেয়েটা যে এত সুন্দর এটা তোকে ইচ্ছে করেই আগে জানাইনি। বরং ইচ্ছা করে বলেছি মেয়েটা ডাউন টাইপ। আগে জানিয়ে রাখলে তুই কঙ্গনায় উর্বশী বা মেনকা ভেবে রাখতি। তখন আর তামান্নাকে এখন যত সুন্দর লাগছে তত সুন্দর লাগত না। 

হিমু, তোকে আল্লার দোহাই লাগে তুই এমন কিছু করিস না যেন মেয়েটা চিরদিনের জন্যে তাের প্রতি বিরূপ হয়ে যায়। তোর আচার আচরণ, কথাবার্তা কিছুই ভাল না। তাের টাইপের ছেলেদের কাছ থেকে মেয়েরা একশ হাত দূরে থাকে। কাজেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও মেয়েরা যেসব আচরণ পছন্দ করে সে রকম আচরণ করবি। 

আমি রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছি মেয়েরা এটেনশান খুব পছন্দ করে। তুই এমন ভাব করবি যেন তামান্নার ধারণা হয় ওই তার দিকে খুব এটেনশান দিচ্ছিস। তাের ফাজলামি ধরনের রসিকতগুলি অবশ্যই করবি না। মেয়েরা রসিকতা পছন্দ করে না। এটাও রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছি। মেয়েরা সিরিয়াস টাইপ পুরুষ পছন্দ করে। যারা রসিকতা করে মেয়েরা তাকে ছ্যাবলা ভাবে। 

আমি যা বলছি তাের ভালর জন্যেই বলছি। তাের বালু তােকে খুব পছন্দ করতাে। এই জন্যেই তাের জন্যে আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে, যদিও খুব ভাল করেই জানি যে মেয়ের সঙ্গে তাের বিয়ে হবে তার জীবনটা ছারখার হয়ে যাবে। 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

তুই ভাল থাকিস। ইয়াকুবের ব্যাপারটা মনে রাখবি। আমি খুব টেনশানে আছি। ঐ ব্যাটার কথা ভাবতে ভাবতে আমার পেটে গ্যাস হচ্ছে। গ্যাসের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাব। সিঙ্গাপুরে আমেরিকান হসপিটালটা নাকি খুব ভাল। আরেকটা হসপিটাল আছে এলিজাবেথ 

হসপিটাল। দুটার একটায় যাব। এখনাে ফাইনাল করিনি। আচ্ছা হিমু শােন, তুই কি আমার সঙ্গে যাবি? তুই তাে দেশের বাইরে কখনাে যাসনি। এই ফাঁকে বিদেশ দেখা হল। আমি ঠিক করে রেখেছি তামান্নাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তুই যদি সঙ্গে থাকিস তাহলে ভালই হয়, মাঝে মধ্যে তামান্নাকে নিয়ে শপিংএ গেলি। বা দুজনে মিলে ছবি দেখলি । এইভাবেও মেয়েটার সঙ্গে তাের ভাব হতে পারে। যাই হােক, অনেক কথা লিখে ফেললাম। ভাল থাকিস। 

তাের ফাতেমা খালা। চিঠি শেষ করে আমি তামান্নার দিকে তাকালাম। সে আগের মতই মিটি মিটি করে হাসছে। এখন মাথা থেকে স্কার্ফ খুলে ফেলেছে। স্কার্ফ খােলার জন্যে তাকে আরাে সুন্দর লাগছে। তার মাথা ভর্তি ফুলানাে-ফাপানাে চুল তামান্না যদি ছেলে হত তাহলে নাপিতরা তার চুল কেটে খুব মজা পেত | গোছা গােছা চুল কাটা হবে। শব্দ হবে কচকচ কচকচ। 

আমি বললাম, ‘আপনি চিঠিটা পড়েছেন তাই না?” 

তামান্না হকচকিয়ে গিয়ে বলল, ‘জ্বি। দয়া করে ম্যাডামকে কিছু বলবেন না । ম্যাডাম বিশ্বাস করে এই চিঠি আমার হাতে পাঠিয়েছেন। আমি বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হয়েছি।’ 

‘পড়লেন কেন?” 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

‘ম্যাডামের সব চিঠিপত্র আসলে আমি লিখে দেই। উনি শুধু সই করেন। এই চিঠিটা উনি নিজে অনেক সময় নিয়ে লিখলেন। নিজেই খামে মুখ বন্ধ করলেন। খামের মুখ ঠিকমত বন্ধ হয়েছে কি-না নানানভাবে পরীক্ষা করলেন। এতে আমার কৌতূহল খুব বেড়ে গেল। এবং কি জন্যে জানি আমি পুরােপুরি নিশ্চিত হয়ে শ্লোম চিঠিটায় আমার প্রসঙ্গে লেখা আছে। সেই কারণেই খুলে পড়েছি। আমার মস্ত বড় ভুল হয়েছে। আমি খুবই লজ্জিত। 

‘চা খাবেন? “জ্বি না, চা খাব না।’ ‘কফি খাবেন? 

তামান্ন: তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, খালা আপনার প্রতি এটেনশান দিতে বলেছেন এই জন্যেই চা-কফির কথা জিজ্ঞেস করছি।” 

‘জ্বি না, কফিও যাব না।’ ‘ঠাণ্ডা কিছু পেপসি বা কোক কিংবা লাচ্ছি?” 

তামান্না হেসে ফেলল শব্দ করে হাসি হেসেই বােধহয় তার মনে হল হাস। ঠিক হয়নি। সে গম্ভীর হতে চেষ্টা করল। মানুষের চরিত্রে তরল ভাব চলে এলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে কঠিন করা সহজসাধ্য না। মেয়েটা গম্ভীর হতে চেষ্টা করছে, পারছে না। আমি বললাম, ‘আপনি বসুন আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।

তারপর চলুন বােটানিকেল গার্ডেন দেখে আসি। না-কি চন্দ্রিমা উদ্যানে যেতে চান? বিবাহপূর্ব প্রেমের জন্যে চন্দ্রিমা উদ্যান ভাল। | তামান্না আবারাে হেসে উঠল। মেয়েটা তাল হাসতে পারে। কিংবা এও হতে পারে যে, সে যে পরিবেশে বাস করে সেখানে হাসার সুযােগ তেমন নেই। অনেকদিন পর মন খুলে হাসতে পারছে। 

তামান্না এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘চা দিতে বলি চা খান? 

‘জি আচ্ছা। ‘তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকতে পারবেন? তামান্না অবাক হয়ে বলল, ‘চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?” 

হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৯

‘আমি খালি গায়ে লেপের ভেতর বসে আছি। চোখটা বন্ধ করলে লেপটা ফেলে দিয়ে শার্ট গায়ে দিতে পারি। সুন্দরী একটা মেয়ের সামনে খালি গা হওয়া অসম্ভব ব্যাপার।’ 

আমি আজ চলে যাই, আরেকদিন এসে চা খাব। ‘আচ্ছা ঠিক আছে। 

তামান্না উঠে দাঁড়াল। মাথায় স্কার্ফ পরল। আবার বসে পড়ল। সে মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কোন কথা বলবে। সিরিয়াস ধরনের কোন কথা। ছেলেরা হুটহাট করে সিরিয়াস কথা বলে ফেলতে পারে। মেয়েরা পারে না। তাদের সিরিয়াস কথা বলার জন্যে সামান্য হলেও আয়ােজন লাগে। তামান্না সেই আয়ােজন করছে। কি বলবে তা আমি মনে হচ্ছে আন্দাজ করতে পারছি। 

‘হিমু সাহেব। 

‘ম্যাডাম আপনার সম্পর্কে আমাকে অনেক ভাল ভাল কথা বলেছেন। আমি ম্যাডামের কথা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-১০

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *