হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

‘আমি গম্ভীগলায় বললাম, জাতীয় পরিষদে আইন পাস করতে হবে যে, কেউ তাদের ছেলেমেয়েদের ভারতে পড়তে পাঠাতে পারবে না, কারভারতীয়রা আমাদের সন্তানদের ব্রেইওয়াশ করে দিচ্ছে, তাই না ফুপা?”।হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম 

ফুপা মদের গ্লাস মুখের কাছে নিয়েও নামিয়ে নিলেন। কঠিকোন কথা বলতে গিয়েও বললেন না – কারণ তিনি তাঁর পুত্র বাদলকে ভর্তি করেছেন দার্জিলিং-এর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

“জ্বি ফুপা। ‘রাজনীতি বাদ দিয়ে চল অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করি। ‘দ্বি আচ্ছা। কি নিয়ে আলাপ করতে চান? আবহাওয়া নিয়ে কথা বলবেন? না —। ‘সাহিত্য নিয়ে কথা বলবেন ফুপা ? গল্প-উপন্যাস? ‘আরে ধূৎ, সাহিত্য! সাহিত্যের লােকগুলিও বদ। এরা আরাে বেশি বদ। ‘তাহলে কি নিয়ে কথা বলা যায়? একটা কোন টপিক বের করুন। 

ফুপা মদের গ্লাস হাতে নিয়ে চিন্তিত মুখে টপিক চিন্তা করতে লাগলেন। আমি ছাদে শুয়ে পড়লাম। আকাশে নাকি নতুন কি একটা ধূমকেতু এসেছে – ‘হায়াকুতাকা, বেচারাকে দেখা যায় কিনা। নয় হাজার বছর আগে সে একবার 

‘জি ফুপা। ‘দেশটাকে আমাদের ঠিক করতে হবে হিমু। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

পৃথিবীকে দেখতে এসেছিল। এখন আবার দেখছে। আবারও আসবে নয় হাজার বছর পর। নয় হাজার বছর পর বাংলাদেশকে সে কেমন দেখবে কে জানে। | ধূমকেতু খুঁজে পাচ্ছি না। সপ্তর্ষিমণ্ডলের নীচেই তার থাকার কথা। উত্তর আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল পাওয়া গেল। এক বিশাল প্রশ্নবােধক চিহ্ন হিসেবে জ্বলজ্বল করছে সপ্তর্ষি ।। 

ফুপা জড়ানাে গলায় বললেন, কি খুঁজছিস হিমু? ‘হায়াকুতাকাকে খুঁজছি। ‘সে কে? ‘ধূমকেতু‘চাইনিজ ধূমকেতু না-কি? হায়াকুতাকা – নাটা তাে মনে হয় চাইনিজ। ‘জাপানিজ নাম। 

“ও আচ্ছা, জাপানিজ … একটা দেশ কোথায় ছিল, এখন কোথায় উঠে গেছে। দেখ … ধূমকেত-ফে সব নিয়ে নিচ্ছে – আমরা কিছুই নিতে পাছি নাবঙ্গোপসাগরে তালপট্টি সেটাও চলে গেল। চলে গেল কি-না তুই বল হিমু?” 

‘জি, চলে গেছে। ‘বেঁচে থেকে তাহলে লাভ কি? ‘বেচে থাকলে আনন্দ করা যায়। মাঝে-মধ্যে মদ্যপান করা যায় ‘এতে লিভারের ক্ষতি হয়। 

‘আসগর সান্যে কেমন আছেন? 

আসগর সাহেব চোখ মেলে তাকালেন। অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিআমাকে চিনতে পারছেন বলে মনে হল না। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

‘দেশ তাে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আপনার অপারেশন কবে বে? ‘আজ সন্ধ্যায়। ‘ভাল, খুব ভাল। ‘হিমু ভাই! বলুন। 

‘পরিমিত খেলে হয় না। পরিমিত খেলে লিভার ভাল থাকে। 

ফুপার কথা আমি এখন আর শুছি না। আমি ধূমকেতু খুঁজছি। ধূমকেতুও আমার মতই পরিব্রাজক – সেও শুধুই হেঁটে বেড়ায় …। 

‘আপনার চিঠিজন্যে কাগজ কিনিয়েছি – কলম কিনিয়েছি। রেডিও বন্ড কাগজ, পার্কার কলম 

‘কে কিনে দিল? 

‘একজন নার্স আছেন, সােমা নাম। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তাঁকে বলেছিলাম, তিনি কিনেছেন। 

‘খুব ভাল হয়েছে। অপারেশন শেষ হােক, তারপর চিঠি লেখালেখি হবে। ‘ছি না‘জি না মানে? ‘আমি বাঁচব না হিমু ভাই, যা লেখার আজই লিখতে হবে। 

‘আপনার যে অবস্থা আপনি লিখবেন কিভাবে? আপনি তাে কথাই বলতে পারছেন না। 

আসগর সাহেযন্ত্রেমত বললেন, যা লেখার আই লিখতে হবে। 

তিনি মনে হল একশভাগ নিশ্চিত, অপারেশনের পরে তাঁকে আর পাওয়া যাবে না। বিদায়ের ঘণ্টা তিনি মনে হয় শুনতে পাচ্ছেন। 

‘হিমু ভাই!

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

 বলুন, শুনছি‘আপনার জন্যে কিছুই করতে পারি নাইচিঠিটাও যদি লিখতে না পারি তাহলে মনে কষ্ট নিয়ে মারা যাব। 

‘কিসের বিপদ হিমু ভাই? তাহলে তাে ভূত বিশ্বাস করতে হয়রাবিরাতে ইটি, কখন ভূতের খপ্পরে 

‘মনে কষ্ট নিয়ে মরার দরকার নেই – নিন, চিঠি লিখুনকলমে কালি আছে?” 

‘দ্ধি, সব ঠিকঠাক করা আছে। হাতটা কাঁপে হিমু ভাই – লেখা ভাল হবে নাআমাকে একটু উঠিয়ে বসান। 

‘উঠে বসাদরকার নেইশুয়ে শুয়ে লিখতে পারবেনখুব সহজ চিঠিএকটা তারা আঁকুন, আবার একটু গ্যাপ দিয়ে চারটা তারা, আবার তিটাএই রকম – * দেখুন আমি লিখে দেখাচ্ছি । 

আসগর সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, এইসব কি ? 

আমি হাসিমুখে বললাম, এটা একটা সাংকেতিক চিঠিআমি মেয়েটার কাছ থেকে একটা সাংকেতিক চিঠি পেয়েছিলামকাজেই সাংকেতিক ভাষায় চিঠিজবাব। 

‘তারাগুলির অর্থ কি? 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

এর অর্থটা মজার – কেউ ইচ্ছা করলে এর অর্থ করবে । love you. একটা তারা , চারটা তারা হল Love, তিনটা তারা হল You.আবার কেউ ইচ্ছা করলে অর্থ করতে পারে – I hate you.  আসগর সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে স্টার এঁকে দিলেন। আমি সেই তারকাচিহ্নের জগৎ বড় রহস্যময় হিমু ভাই।। 

‘জগৎ মােটেই রহস্যময় নামানুষের মাথাটা রমস্যময়যা ঘটে মানুষের মাথার মধ্যে ঘটে। মনসুর এসেছিল আপনার মাথার ভেতরআমার ধারণা, সে তার পরিবারের ঠিকানা ঠিকই দিয়েছেআপনার মাথা কিভাবে কিভাবে এই ঠিকানা বের করে ফেলেছে। আপনার কথা বুঝতে পাছি না হিমু ভাই। 

‘বুঝতে না পারলেও কোন অসুবিধা নেইআমি নিজেও আমার সব কথা বুঝতে পারি না। 

আমি আসগর সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। গফুরের মেয়েটার সঙ্গে দুটা কথা বলার ইচ্ছা ছিলমেয়েটাকে দেখলাম না। গফুর তার বিছানায় হা করে ঘুমাচ্ছেতার মুখের উপর একটা মাছি ভন ভন করছে; সেই মাছি তাড়াবার চেষ্টা করছেন বয়স্কা এক মহিলাসম্ভবত গফুরের স্ত্রীস্বামীকে তিনি নির্বিঘ্নে ঘুমুতে দিতে চান

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

রিকশা নিয়ে নিলাম। মারিয়ার বাবাকে দেখতে যাবপাঁচ বছর পর। ভদ্রলােককে দেখতে যাচ্ছি। এই পাঁচ বছরে তিনি আমার কথা মনে করেছেন। আমি । গ্রেফতার হয়েছি শুনে চিন্তিত হয়ে চারদিকে টেলিফোন করেছেন। আমি তার কথা মনে করিনিআমি আমার বাবার কঠিন উপদেশ মনে রেখেছি – 

বললাম, আপনার সঙ্গে তাহলে আর দেখা হচ্ছে না। 

জি না। মৃত্যু কখন হবে বলে আপনার ধারণা? 

আসগর সাহেব জবাব দিলেন নাআমি বললাম, রাতে একবার এসে খোঁজ নিয়ে যাবমরে গেলে তাে চলেই গেলেনবেঁচে থাকলে কথা হবে। 

‘দি আচ্ছা‘আর কিছু কি বলবেন? মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজনকে কিছু বলা কিংবা …। 

মনসুরের পরিবারকে টাকাটা পাঠিয়ে দেবেন ভাই সাহেব। মনসুর এসে পরিবারের ঠিকানা দিয়ে গেছে। 

‘ঠিকানা কি ? 

‘কাগজে লিখে রেখেছি – পােস্টাপিসের কিছু কাগজ, পাসবই সব একটা বড় প্যাকেটে ভরে রেখে দিয়েছিআপনার নামে অথরাইজেশন চিঠিও আছে। 

“ও আচ্ছা, কাজকর্ম গুছিয়ে রেখেছেন? ‘জি – যতদূর পেরেছি| ‘অনেকদূর পেরেছেন বলেই তাে মনে হচ্ছে – ফ্যাকরা বাঁধিয়েছে মসুর সে যদি ভূত হয়ে সত্যি সত্যি তার পরিবারের ঠিকানা বলে দিয়ে যায় তাহলে বিপদের কথা। 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

প্রিয় পুত্র

মানুষ মায়াবদ্ধ জীব। মায়ায় আবদ্ধ হওয়াই তাহার নিয়তিতােমাকে আমি মায়ামুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া বড় করিয়াছি। তারপরেও আমার ভয় একদিন ভয়ঙ্কর কোন মায়ায় তােমার সমস্ত বােধ, সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হইবে। মায়া কূপবিশেষ, সে কুপের গভীরতা মায়ায় যে আবদ্ধ হইবে তাহার মনের গভীরতার উপর নির্ভরশীলআমি তােমার মনের গভীরতা সম্পর্কে জানি – কাজেই ভয় পাইতেছি – কখন না তুমি মায়া নামক অর্থহীন কুপে আটকা পড়িয়া যাওযখনই এইরূপ কোন সম্ভাবনা দেখিবে তখনই মুক্তির 

জন্য তােমার জন্ম হয় নাই। তুমি আমার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করিও না।… 

আমি আমার অপ্রকৃতিস্থ পিতার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করিনিআমি যখই মায়ার রূপ দেখেছি তখনি দূরে সরে গেছি। দূরে সরার প্রক্রিয়াটি কত যে কঠিতা কি আমার অপ্রকৃতিস্থ দার্শনিক পিতা জানতেন? মনে হয় জানতেন না। জানলে মায়মুক্তির কঠিন বিধান রাতেন না। 

আসাদুল্লাহ সাহেব আজ এতদিপরে আমাকে দেখে কি করবেন? খুব কি উল্লাস প্রকাশ করবেন? না, তা করবেন নাযে সব মানুষ সীমাহীন আবেগ নিয়ে জমেছেন তাঁরা কখনাে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করেন না। তাঁদের আচারআচরণ রােবটধর্মীযাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন মধ্যম শ্রেণীর আবেগ নিয়ে, তাঁদের আবেগের প্রকাশ অতি তীব্রএঁরা প্রিয়জনদের দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে হুলস্থল ধাধিয়ে দে। 

আমার ধারণা, আসাদুল্লাহ সাহেব আমাকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলবেন, তারপর কি খর হিমু সাহেব? 

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-22

এই যে দীর্ঘ পাঁচ বছর দেখা হল না সে প্রসঙ্গে একটা কথাও বলবেন নাপুলিশের হাতে কিভাবে ধরা পড়েছি, কিভাবে ছাড়া পেয়েছি সেই প্রসঙ্গেও কোন কথা হবে না। দেশ নিয়েও কোন কথা বলবেন না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি নিয়ে। তার কোন মাথাব্যথা নেই। ক্ষুদ্র একটি ভূখশুকে তিনি দেশ ভাবেন না।

তাঁর দেশ হচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। তিনি নিজেকে অনন্ত নক্ষত্রবীথির নাগরিক মনে করেন। এইসব নাগরিকদের কাছে জাগতিক অনেক কর্মকাণ্ডই তুচ্ছবাবা বেঁচে থাকলে আমি অবশ্যই তাকে আসাদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতাম। দুজন দুমেরু থেকে কথা শুরু করতেনসেইসব কথা না জানি শুনতে কত সুন্দর হত! | মারিয়ার মাকে আমি খালা ডাকিহাসি খালা

মহিলারা চাচীর চেয়ে খালা ডাক বেশি পছন্দ করেন। খালা ডাক মায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অনেক কাছেডাকখালা ডেকেও আমার তেমন সুবিধা অবশ্যি হয়নি। ভদ্রমহিলা গােড়া থেকেই আমাকে তীব্র ন্দেহেচোখে দেখেছেন। তবে আচাআচরণে কখনাে তা প্রকাশ হতে দেননিবরং বাড়াবাড়ি রকম আন্তরিকতা দেখিয়েছেন| হাত দেখার প্রতি এই হিলার খুব দুর্বতা আছে।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম খন্ড-২৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *