কালো সিমেন্টের বারা। দেখলেই ইচ্ছে করে খালি গায়ে শুয়ে পড়তে। চুপচাপ বসে আছি, হঠাৎ বাড়ির দরজা খুলে গেল। ঘুমঘুম চোখে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে । নরম গলায় বললেন, কী চাও খােকা?
আমি বললাম, কিছু চাই না।বাসা কোথায়?
আমি জবাব দিলাম না। বাসা কোখায় তা এই মহিলাকে বলার কোন অর্থ হয় না। তিনি চলে গেলেন না। দরজা ধরে দাড়িয়ে রইলেন। তার চোখে গভীর বিস্ময়এবং কৌতূহল। আমি অস্বস্তি বােধ করতে লাগলাম। তিনি বললেন, তুমি চলে যেও না, আমি আসছি। | তিনি ঘরের ভিতরে চলে গেলেন এবং মিনিট তিনেক পর আবার উপস্থিত হলেন।
তাঁর হাতে কী-একটা খাবার। তিনি আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন নাও, খাও| অপরিচিত কেউ কিছু খেতে দিলে বলতে হয়—খাব না। ক্ষিধে নেই! আমি তা বলতে পারলাম না। জিনিসটা হাতে নিলাম। খেতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঐ খাদ্য এই পৃথিবীর খাদ্য নয়। স্বর্গীয় কোন অমৃত।
জিনিসটা হচ্ছে জেলী মাখানাে এক টুকরাে পাউরুটি। এরকম সুখাদ্য পৃথিবীতে আছে এবং তা অপরিচিত কাউকে দেয়া যায় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। ভদ্রমহিলা বললেন, আরেকটা দেব?
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৪
আমি না সূচক মাখা নাড়লাম, তবে তা করতে বড় কষ্ট হল। ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন এবং আরো এক টুকরা পাউরুটি নিয়ে ফিরে এলেন।আমি দ্বিতীয়টিও নিঃশব্দে খেয়ে ফেললাম। ভদ্রমহিলা বললেন, তােমার নাম কী, খােকা?
নাম বললাম না। এক দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। তিনি নিশ্চয়ই আমার এই অদ্ভুত ব্যবহারে খুবই অবাক হয়েছিলেন, তবে তিনি হয়তবা তার চেয়েও অবাক হলেন যখন দেখলেন পরের দিন আমি আবার উপস্থিত হয়েছি। | তিনি আমাকে দেখে খুব হাসলেন। তারপরই খাবার নিয়ে এলেন। ব্যাপারটা রুটিনের মত হয়ে গেল—আমি রােজ যাই, ভদ্রমহিলা খাবার দেন, আমি খাই এবং চলে আসি।
তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করেন বলে মনে হয়। বারান্দায় এসে বসা মাত্র দরজা খুলে বের হয়ে আসেন।
একদিনের কথা বলি। মেঘলা দুপুর। চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। ভদ্রমহিলার বারান্দায় পা দেয়া মাত্র বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল।
তিনি দরজা খুলে বললেন, বারান্দায় বৃষ্টির হুঁটি আসবে, ভেতরে এসাে খােকা।
আমি ভয়ে ভয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম। কী চমৎকার সাজানাে বাড়ি। যেন ছবি আঁকা। মানুষের বাড়ির ভেতরটা এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না।
খােকা, বস। আমি ভয়ে ভয়ে সােফায় বসলাম। তিনি বললেন, আজ থেকে তুমি আমাকে
মা বলে ডাকবে, কেমন? তুমি মা ডাকবে, আমি তােমাকে খুব মজার মজার খাবার খাওয়াব। আচ্ছা?
আমি কিছু বললাম না।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৪
তিনি বললেন, তুমি যে আমাকে মা ডাকছ এটা কাউকে বলার দরকার নেই। এটা তােমার এবং আমার গােপন খেলা।
আমি ভদ্রমহিলার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি নাশপাতি কিংবা নাশপাতির মত দেখতে কোন একটা ফল কেটে দিলেন। বললেন, এসাে, তুমি
আমার কোলে বসে খাও। তার আগে মিষ্টি করে আমাকে মা ডাক তাে।
আমি মা ডাকতে পারলাম না। বিচিত্র এক ধরনের ভয়ে অন্তর কেঁপে উঠল। শিশুদের মনের গভীরে অনেক ধরনের ভয় লুকানো থাকে। তারই কোন একটা বের হয়ে এসে আমাকে অভিভূত করে ফেলল। আমি ছুটে বের হয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় পৌঁছলাম।
ঐ রহস্যময় বাড়িতে আর কোনদিন যাইনি। মানুষের জীবনে কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। রহস্যময় প্রকৃতি মানুষকে একই পরিস্থিতিতে বার বার ফেলে মজা দেখেন বলে আমার ধারণা। সিলেটের ঐ বাড়ির মহিলার মত এক মহিলার দেখা পেলাম খােদ আমেরিকায়। আমার বয়স তখন সাতাশ।
শীতের শুরু।
বরফ পড়া আরম্ভ হয়েছে। হােটেল গ্রেভার ইন থেকে বাসে ইউনিভার্সিটিতে আসতে খুব কষ্ট হয়। বাসের ভিতর হিটিং-এর ব্যবস্থা আছে, তবু শীতে জমে যাবার মত কষ্ট পাই। বাসস্ট্যাণ্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করার কষ্টও অকল্পনীয়। আমার ভারতীয় বন্ধু উমেশ আমার জন্য ইউনিভার্সিটির কাছে একটা ঘর খুঁজে দিল।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৪
আমেরিকান এক ভদ্রমহিলা তার বাড়ির কয়েকটা ঘর বিদেশী ছাত্রদের ভাড়া দেন। ভাড়া খুবই সস্তা, মাসে চল্লিশ ডলার। তবে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে বাইরে। আমি বাড়িওয়ালির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার নাম লেভারেল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, আমি খুব বেছে বেছে রুম ভাড়া দেই। যাদেরকে দেই তাদের কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। তার মধ্যে সবচে কঠিন নিয়ম দুটি হচ্ছে, রাত দশটার পর কোন বান্ধবীকে ঘরে আনা যাবে না। এবং উঁচু ভ্যলুমে স্টেরিও বাজানো * যাবে না।
আমি বললাম, বান্ধবী এবং স্টেরিও—দুটোর কোনটিই আমার নেই।
তিনি বললেন, এখন নেই, দুদিন পর হবে। সেটা দোষের নয়। তবে আমার নিয়ম তােমাকে বললাম। পছন্দ হলে রুম নিতে পার।
আমি রুম নিয়ে নিলাম। প্রথম মাসের ভাড়া বাবদ চল্লিশ ডলার দেবার পর তিনি একটি ছাপানো কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই কাগজে আরাে সব শর্ত লেখা। প্রথম শর্ত পড়েই আমার আক্কেল গুড়ুম। লেখা আছে ? এই বাড়ির কোন অগ্নিবীমা নেই। কাজেই এই বাড়ির অধিবাসীদের কেউ ধূমপান করতে পারবে না।
সব নিয়ম মানা সম্ভব কিন্তু এই নিয়ম কী করে মানব? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। একবার ভাবলাম ডলার ফেরত নিয়ে হােটেল গ্রেভার ইনে ফিরে যাব। আবার ভাবলাম, বাসায় তো আর বেশিক্ষণ থাকব না, কাজেই তেমন অসুবিধা হয়ত হবে না।অসুবিধা হল।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৪
ঘুমুতে যাবার আগে আগে সিগারেটের তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার মত অবস্থা হল। আমি গরম কাপড় গায়ে দিলাম। গায়ে পার্ক চড়ালাম। মাফলার দিয়ে নিজেকে পেঁচিয়ে মাংকিক্যাপ মাথায় দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সিগারেট ধরালাম।
দৃশ্যটা অদ্ভুত। বরফ পড়ছে। এই বরফের মধ্যে জোব্বা-জাব্বা গায়ে এক ছেলে সিগারেট টানার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
দিন সাতেক পরের কথা। লেভারেল আমার ঘরে ঢুকে কঠিন গলায় বলল, এগারটা-বারটার সময় বাইরে দাড়িয়ে সিগারেট টান তাই না?
ও হঁ্যা। ধূমপান যারা করে তাদের আমি বাড়ি ভাড়া দেই না। ঃ আমি সামনের মায়ে চলে যাব।
খুবই ভাল কথা। মাসের এই কটা দিন দয়া করে ঘরে বসেই সিগারেট খাবে। ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে অসুখ-বিসুখ বাঁধাও তা আমি চাই না।
ধন্যবাদ।
ও শুকনাে ধন্যবাদের আমার দরকার নেই। আমি পনেরাে বছরে এই প্রথম একজনকে সিগারেট খাবার অনুমতি দিলাম।
থ্যাংক ইউ।
লেভারেল উঠে চলে গেল। তবে যাবার আগে হঠাৎ বলল, তােমার অন্য কোথাও যাবার দরকার নেই। তুমি আমার এখানেই থাকবে। আমি তােমার সিগারেটের অভ্যাস ছাড়িয়ে দেব।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৪
ভদ্রমহিলা এর পর আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেন। আমার সিগারেটের প্যাকেট তার কাছে জমা রাখতে হল। তিনি গুনে গুনে আমাকে সিগারেট দেন। তার সামনে বসে খেতে হয়। তিনি নানান উপদেশ দেন, ধোয়া বুকের ভিতর নিও না। পাফ করে ছেড়ে দাও।সিগারেট খাবার সময় একজন অগ্নিদষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, এটা অসহ্য।
এছাড়াও তিনি আরাে সব সমস্যা করতে লাগলেন—আমার ওজন খুব কম, কাজেই তিনি ওজন বাড়ানাের চেষ্টা করতে লাগলেন। বলতে গেলে রােজ রাতে তার সঙ্গে ডিনার খেতে হয়। তিনি আমার কাপড় ধুয়ে দেন। ঘর ঝাট দিয়ে দেন। একদিন তুষার ঝড় হচ্ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে আমি ঠিকমত ফিরতে পারব না ভেবে নিজেই ইউনিভার্সিটিতে হাজির হলেন। আমি বরফের উপর দিয়ে ঠিকমতই ইটিতে পারছি তবু তিনি হাত ধরে আমাকে নিয়ে এলেন।
Read More