দেখলাম ব্যাপারটায় আয়ােজনও প্রচুর। দূজন আছে রেকর্ড কীপার, স্টপ ওয়াচ হাতে সময়ের হিসাব রাখছে। একজন আছেন নােটারী পাবিলক। যিনি
সার্টিফিকেট দেবেন যে, দীর্ঘতম চুম্বনে কোন কারচুপি হয়নি। এই নােটারী পাবলিক সারাক্ষণই থাকবেন কিনা বুঝতে পারলাম না। এদের মত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এরকম একটা ফালতু জিনিস নিয়ে কী করে সময় নষ্ট করে বুঝতে পারলাম না। | বেন এবং মেয়েটিকে নাইলনের দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কেউ সে বেষ্টনীর ভেতর যেতে পারছে না। বাজনা বাজছে। সবই নাচের জন্য ওয়াল্টজ। বাজনার তালে তালে এরা দু’জন নাচছে।
আমি মিনিট দশেক এই দৃশ্য দেখে চলে এলাম। এই জাতীয় পাগলামির কোন মানে হয়?
পরদিন ভােরে আবার গেলাম। ম্যারাথন চুমু তখনো চলছে। তবে পাত্র-পাত্রী দুজন এখন সােফায় শুয়ে আছে। ঠোটে ঠোট লাগানাে। বাজনা বাজছে। সেই বাজনার তালে তালে সমবেত দর্শকদের অনেকেই সঙ্গী অথবা সঙ্গিনী নিয়ে খানিকক্ষণ নাচছে। রীতিমত উৎসব।
আমি আমার পাশে দাড়ানো ছেলেটিকে বললাম, ক্ষিধে পেলে ওরা করবে কী? ঠোটে ঠোট লাগিয়ে খাওয়া-দাওয়া তো করা যাবে না।
ও তরল খাবার খাবে স্ট্র দিয়ে। কিছুক্ষণ আগেই স্যুপ খেয়েছে।
আমি ইতস্তত করে বললাম, বাথরুমে যাবার প্রয়ােজন যখন হয় তখন কী করবে ?
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৮
জানি না। বাথরুমের জন্যে কিছু সময় বােধ হয় অফ পাওয়া যায় । কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। ওদের জিজ্ঞেস কর।।
আমার আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করল না। ততক্ষণে ফ্লোরে উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়ে গেছে। এক জোড়া বুড়ােবুড়ি উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে। ভয়াবহ লাফ ঝাপ। তালে তালে হাত তালি পড়ছে। জমজমাট অবস্থা। | জানতে পারলাম এই বুড়ােবুড়ি হচ্ছে বেন ওয়ালির বাবা এবং মা। তারা সুদূর মিনেসােটা থেকে ছুটে এসেছেন ছেলেকে উৎসাহ দেবার জন্যে। ছেলের গর্বে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল। | + বেন ওয়ালি দীর্ঘতম চুম্বনের বিশ্বরেকর্ড ভাঙতে পারেনি। তবে সে খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
লাস ভেগাস
দিনটা ছিল বুধবার। জুন মাসের ষোলো বা সতেরো অরিখ। ডানবার হলের এক্সরে রুমে বসে আছি। অামার সামনে গাদা খানিক রিপেটি। আমি রিপোর্ট দেখছি এবং ঠাণ্ডা ঘরে বসেও রীতিমত ঘামছি। কারণ গা দিয়ে গাম বের হবার মত একটা আবিস্কার করে ফেলেছি। পলিমার ক্লে ইন্টারেকশনের এমন একটা ব্যাপার পাওয়া গেছে যা আগে কখনাে লক্ষ্য করা হয়নি। আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ হবার সম্ভাবনা শতকরা ৮০ ভাগ ।।
আমি দেখিয়েছি যে, পলিমারের মত বিশাল অণু ক্লে-র লেয়ারের ভেতর ঢুকে তার স্ট্রাকচার বদলে দিতে পারে। সব পলিমার পারে না, কিছু কিছু পারে। কোন কোন পলিমার কে লেয়ারের ফঁাক বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কেউ আবার কমিয়ে দেয়। অত্যন্ত অবাক হবার মত ব্যাপার।
সন্ধ্যাবেলা আমি আমার প্রফেসরকে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। ঝিম ভাঙবার ও বললেন, গােল্ড মাইন।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৮
অর্থাৎ তিনি একটি স্বর্ণখনির সন্ধান পেয়েছেন। রাত দশটার দিকে তিনি বাসায় টেলিফোন করে বললেন, আমেরিকান কেমিক্যাল সােসাইটির ৫৭তম অধিবেশন হবে নাভাদার লাস ভেগাসে। সেই অধিবেশনে আমরা আমাদের এই আবিষ্কারের কথা বলব।
আমি বললাম, খুবই ভাল কথা। কিন্তু এখনাে ব্যাপারটা আমরা ভালমত জানি না। আমেরিকান কেমিক্যাল সােসাইটির মত অধিবেশনে তাড়াহুড়া করে কিছু …
প্রফেসর আমার কথা শেষ করতে দিলেন না, ঘট করে টেলিফোন রেখে দিলেন।
পরদিন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুব চেষ্টা করলাম প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি সেই সুযােগ দিলেন না। লেখালেখি নিয়ে খুব ব্যস্ত। যতবার কথা বলতে চাই দাত-মুখ খিচিয়ে বলেন—দেখছ একটা কাজ করছি, কেন বিরক্ত করছ। আমার কাজ নয়। এটা তােমারই কাজ ।
সন্ধ্যাবেলা প্রফেসরের সেই কাজ শেষ হল। তিনি তার সমস্ত ছাত্রদের ডেকে গম্ভীর গলায় বললেন, আমার ছাত্র আহামাদ নাভাদার লাস ভেগাসে তার আবিষ্কারের কথা ঘােষণা করবে। সে একটা পেপার দেবে। পেপারের খসড়া আমি তৈরি করে ফেলেছি।
| আমার মাথা ঘুরে গেল। ব্যাটা বলে কী? পৃথিবীর সব বড় বড় রসায়নবিদরা। জড়াে হবে সেখানে। এইসব জ্ঞানী-গুণীদের মধ্যে আমি কেন? এক অক্ষর ইংরেজী আমার মুখ দিয়ে বের হয় না। যা বের হয় তার অর্থ কেউ বুঝে না। আমি একী বিপদে পড়লাম।
প্রফেসর বললেন, আহামদি, তােমার মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? আমি কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ও কেন জানতে পারি ?
আমি বক্তৃতা দিতে পারি না।। ও এটা খুবই সত্যি কথা।। : আমি ইংরেজী বললে কেউ তা বুঝতে পারে না।
ও কারেক্ট। আমি এত দিন তােমার সঙ্গে আছি, আমি নিজেই বুঝি না। অন্যরা কী বুঝবে।
আমি খুবই নার্ভাস ধরনের ছেলে। কী বলতে কী বলব।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৮
দেখ আহমাদ, আমেরিকান কেমিক্যাল সােসাইটির অধিবেশনে কথা বলতে পারার সৌভাগ্য সবার হয় না। তােমার হচ্ছে।
এই সৌভাগ্য আমার চাই না।
ও বাজে কথা বলবে না। কাজটা তুমি করেছ। আমি চাই সম্মানের বড় অংশ তুমি পাও। কেন ভয় পাচ্ছ। আমি তােমার পাশেই থাকব।
আমি মনে মনে বললাম—ব্যাটা তুই আমাকে একী বিপদে ফেললি।
পনেরাে দিনের মধ্যে চিন্তায় চিন্তায় আমার দুপাউণ্ড ওজন কমে গেল। আমার দুশ্চিন্তার মূল কারণ হচ্ছে কাজটা আধখেচড়াভাবে হয়েছে। কেউ যদি কাজের উপর জটিল কোন প্রশ্ন করে বসে জবাব দিতে পারব না। এ রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় এত বড় বিজ্ঞান অধিবেশনে যাওয়া যায় না। ব্যাটা প্রফেসর তা বুঝবে না।
| প্রফেসর তার গাড়িতে করে আমাকে লাস ভেগাসে নিয়ে গেলেন। মরুভূমির ভেতর আলাে ঝলমল একটি শহর। জুয়ার তীর্থভূমি। নাইট ক্লাব এবং ক্যাসিনােতে ভরী। দিনের বেলা এই শহর ঝিম মেরে থাকে। সন্ধ্যার পর জেগে ওঠে। সেই জেগে ওঠাটা ভয়াবহ।
আমার প্রফেসরেরও এই প্রথম লাস ভেগাসে আগমন। তিনিও আমার মতই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন। হা হয়ে দেখছেন রাস্তার অপূর্ব সুন্দরীদের ভীড়।
প্রফেসর আমার কানে কানে বললেন, এই একটি জায়গাতেই প্রসটিডিউশন নিষিদ্ধ নয়। যাদের দেখছ, তাদের প্রায় সবাই ঐ জিনিস। দেখবে পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েরা এসে টাকার লােভে এখানে জড় হয়েছে। | কিছুদূর এগুতেই এক সুন্দরী এগিয়ে এসে বলল, সান্ধ্যকালীন কোন বান্ধবীর কি প্রয়ােজন আছে?
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৮
আমি কিছু বলবার আগেই প্রফেসর বললেন, না ওর কোন বান্ধবীর প্রয়ােজন নেই।
মেয়েটি নীল চোখ তুলে শান্ত গলায় বললেন, তােমাকে তাে জিগগেস করিনি। তুমি কথা বলছ কেন?
আমি বললাম, তােমায় ধন্যবাদ, আমার বান্ধবীর প্রয়ােজন নেই।
মেয়েটি বলল, সুন্দর সন্ধ্যাটা একা একা কাটাবে। এক গ্রাস বিয়ারের বদলে আমি তােমার পাশে বসতে পারি।
আমরা কথা না বলে এগিয়ে গেলাম। পথে আরাে দুটি মেয়ের সঙ্গে কথা হল। এদের একজন মধুর ভঙ্গিতে বলল, তােমাদের কি ডেট লাগবে? লাগলে লজ্জা করবে না ।
আমার প্রফেসর মুখ গম্ভীর করে আমাকে বুঝালেন,এরা ভয়াবহ ধরনের প্রস্টিটিউট। তােমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়ে হাত পর্যন্ত দিতে দেবে না। পত্রপত্রিকায় এদের সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। | প্রফেসরের ভাব এরকম যে গায়ে হাত দিতে দিলে তিনি রাজি হয়ে যেতেন।
রাতের খাবার খেতে আমরা যে রেস্টুরেন্টে গেলাম তা হচ্ছে টপলেস রেস্টুরেন্ট। অর্থাৎ ওয়েট্রেসদের বুকে কোন কাপড় থাকবে না। বইপত্রে এইসব | রেস্টুরেন্টের কথা পড়েছি। রাস্তার এই প্রথম দেখলাম। আমার লজ্জায় প্রায় মাথা
আমরা কথা না বলে এগিয়ে গেলাম। পথে আরাে দুটি মেয়ের সঙ্গে কথা হল। এদের একজন মধুর ভঙ্গিতে বলল, তােমাদের কি ডেট লাগবে? লাগলে লজ্জা করবে না ।
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১৯