ও ঐ ব্যাপার মানে? ও মনে হচ্ছে …
মেয়েরা ধাধা খুব পছন্দ করে। আমি লক্ষ্য করেছি, যে-কথা সরাসরি বললেও কোন ক্ষতি নেই সেই কথাও তারা ধাধার মত বলতে চেষ্টা করে। তার ব্যথা উঠেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এটা বুঝতে আমরা দশ মিনিটের মত লাগল। যখন বুঝলাম তখন স্পাইনাল কর্ড দিয়ে হিমশীতল একটা স্রোত বুয়ে গেল। কী সর্বনাশ!
আমি শুকনাে গলায় বললাম, ব্যথা কি খুব বেশি ?
না, বেশি না। কম। তবে ব্যথাটা ঢেউয়ের মত আসে, চলে যায়, আবার আসে। এখন ব্যথা নেই। | ঃ তাহলে তুমি রান্নাঘরে চলে যাও, চা বানাও! চা খেতে খেতে চিন্তা করি প্ল্যান অব অ্যাকশন।
ও চিন্তা করার কী আছে? তুমি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে—ব্যস। ও কথা না বাড়িয়ে চা বানাও। আবার ব্যথা শুরু হলে মুশকিল হবে।
সে রান্নাঘরে চলে গেল। আমি প্ল্যান অব অ্যাকশন ভাবতে বসলাম। গুলতেকিন পুরাে ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছে, এটা মােটেই তত সহজ না। প্রধান সমস্যা এই প্রচণ্ড দুর্যোগে তাকে হাসপাতালে নিয়ে পৌছানাে। এ ছাড়াও ছােটখাট সমস্যা আছে, যেমন নােভাকে কোথায় রেখে যাব? কে তার দেখাশোনা করবে? হাসপাতালে গুলতেকিনকে কতদিন থাকতে হবে? এই দিনগুলিতে নােভাকে সামলাব কিভাবে?
নাও, চা খাও। চা খেয়ে দয়া করে কাপড় পর। নােভাকে কী করব?
কিছু করতে হবে না। আমি ফরিদকে টেলিফোন করে দিয়েছি, সে এসে পড়বে।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২০
ও ডাক্তারকেও তে খবর দেয়া দরকার। ও খবর দিয়েছি। ও কাজ তাে দেখি অনেক এগিয়ে রেখেছ। ও হঁ্যা, রেখেছি। প্লীজ, চা-টা তাড়াতাড়ি শেষ কর।
চা শেষ করবার আগেই ফরিদ এসে পড়ল। সে কানাড়া থেকে এমএস করে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পি-এইচ-ডি করতে এসেছে। এই ছেলেটি পাকিস্তণী। পাকিস্তানী কারাে সঙ্গে নীতিগতভাবেই আমি কোন যােগাযােগ রাখি না। একমাত্র ব্যতিক্রম ফরিদ। পৃথিবীতে এক ধরনের মানুষ জন্মায় যাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে পরের উপকার করা। পরের উপকার করবার সময়টাতেই তারা খানিকটা হাসিখুশি থাকে, অন্য সময় বিমর্ষ হয়ে থাকে। আমি আমার চল্লিশ বছরের জীবনে ফরিদের মৃত ভাল ছেলে দ্বিতীয়টি দেখিনি, ভবিষ্যতে দেখব সেই আশাও করি না।
নােভাকে ফরিদের কাছে রেখে আমি হাসপাতালের দিকে রওনা হলাম। বরফ ঢাকা রাস্তায় আমার ডজ পােলারা গাড়ি চলছে। পেছনের সীটে গুলতেকিন কাত হয়ে শুয়ে আছে, মাঝে যাঝে অস্ফুটস্বরে কাতরাচ্ছে। আমি বললাম, ব্যথা কি খুব বছে ?
তুমি গাড়ি চালাও। কথা বলবে না। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার মনে হচ্ছে বেশি দেরি নেই।
ও কী সর্বনাশ! আগে বলবে তাে।
আমি একসিলেটরে পা পুরােপুরি দাবিয়ে দিলাম । গাড়ি চলল উল্কার গতিতে। অামার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলেই অ্যাকসিডেন্ট না করে সেইন্ট লিউক হাসপাতালে পৌছতে পারলাম।
নার্স এসে দেখেশুনে বলল, এক্ষুণি ডেলিভারী হবে, চল ও-টিতে যাই।
গুলতেকিনের চিকিৎসকের নাম ডঃ মেলয় । ডেলিভারী তিনিই করাবেন। আমেরিকান ডাক্তারদের সবার কাছেই ওয়াকি টকি জাতীয় একটি যন্ত্র থাকে। তিনি যেখানেই থাকেন তার সঙ্গে মুহুর্তের মধ্যে যােগাযোগ করা যায়। হাসপাতাল থেকে তার সঙ্গে যোগাযােগ করা হল। তিনি বললেন, এক মিনিটের মধ্যে রওনা হচ্ছি।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২০
আমি পুরােপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যখন সিগারেট ধরিয়েছি তখন হাসপাতালের ট্রেন বলল, তুমি চল আমার সঙ্গে।
ও কোথায়? ও অপারেশন থিয়েটারে। কেন? তুমি তােমার স্ত্রীর পাশে থাকবে। তাকে সাহস দেবে। ও খুবই সাহসী মেয়ে। ওকে সাহস দেবার কোন দরকার নেই।
ও বাজে কথা বলবে না। তুমি এসাে আমার সঙ্গে। ডেলিভারীর সময় আমরা কাউকে ঢুকতে দেই না। শুধু স্বামীকে থাকতে বলি। এর প্রয়ােজন আছে।
আমি তেমন কোন প্রয়ােজন দেখতে পাচ্ছি না। ৪ যা ঘটতে যাচ্ছে তার অর্ধেক দায়ভাগ তােমার। তুমি এরকম করছ কেন?
আমি ট্রেনের সঙ্গে রওনা হলাম। ও-টিতে ঢােকার প্রস্তুতি হিসেবে আমাকে মাস্ক পড়িয়ে দিল। অ্যাপ্রন গায়ে চড়িয়ে দিল। এক ধরনের বিশাল মােজায় পা ঢেকে দেয়া হল। আমি ও-টিতে ঢুকলাম। অপারেশন থিয়েটারটি তেমন আলােকিত নয়। আমার কাছে অন্ধকার অন্ধকার লাগল। ঘরটা ছােট এবং যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। ফিনাইলের যে কটু গন্ধ হাসপাতালে পাওয়া যায় তেমন গন্ধও পেলাম না, তবে নেশা ধরানাের মত মিষ্টি সৌরভ ঘরময় ছড়ানাে।
গুলতেকিনকে বিশেষ ধরনের একটা টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার দুপাশে দুজন নার্স। ডাঃ মেলায় এসে পড়েছেন, তিনি ছুরি-কাচি গুছিয়ে রাখছেন।
তাদের প্রত্যেকের মুখে মাস্ক থাকার জন্যে তাদের দেখাচ্ছিল ব্লু ক্লাক্স ক্লান এর সদস্যদের মত। তাদের ঠিক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল তারা যেন একদল রােবট। আমি গুলতেকিনের হাত ধরে দাঁড়ালাম।
ডেলিভারী পেইনের কথাই শুধ শুনেছি, এই ব্যথা যে কত তীব্র, কত তী এবং কত ভয়াবহ সেই সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। এই প্রথম ধারণা হল। ঘামে আমার সমস্ত শরীর ভিজে গেল। থরথর করে কাপতে লাগলাম। গলা কাটা কোরবানীর পশুর মত গুলতেকিন ছটফট করছে। এক সময় আমি ডাক্তারকে বললাম, আপনি দয়া করে পেইন কিলার দিয়ে ব্যথা কমিয়ে দিন। ডাক্তার নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, পেইন কিলার দেয়া যাবে না। পেইন কিলার দেয়া মাত্র কন্ট্রাকশনের সমস্যা হবে। আর মাত্র কিছুক্ষণ।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২০
সেই কিছুক্ষণ আমার কাছে অনন্তকাল বলে মনে হল। মনে হল আমি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমার স্ত্রীর হাত ধরে প্রতীক্ষা করছি।
একসময় প্রতীক্ষার অবসান হল, জশ হল আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলার । হাত পা ছুঁড়ে সে কাঁদছে, সরবে এই পৃথিবীতে তার অধিকার ঘােষণা করছে। যেন সে বলছে, এই পৃথিবী আমার, এই গ্রহ-নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য আমার, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি আমার।
গুলতেকিন ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি চুপ করে আছাে কেন, আজান দাও। বাচ্চার কানে আল্লাহর নাম শােনাতে হয়।
আমি আমার ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, আল্লাহু আকবর….
নার্সের হাতে একটা ট্রে ছিল। ভয় পেয়ে সে ঐ ফেলে দিল। ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, What is happening?
তাদের কোন কথাই আমার কানে ঢুকছে না। আমি অবাক হয়ে দেখছি আমার শিশু কন্যাকে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর রূপরসগন্ধ হয়তো-বা ইতিমধ্যেই তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। আমি প্রার্থনা করলাম, যেন পৃথিবী তার মঙ্গলময় হাত প্রসারিত করে আমার কন্যার দিকে। দুঃখ-বেদনার সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রগাঢ় আনন্দ বারবার আন্দোলিত করে আমার মা-মণিকে।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-২০
পাখি উইন্টার কোয়ার্টার শুরু হয়েছে। শীত এখনাে তেমন পড়েনি। ওয়েদার ফোরকাস্ট হচ্ছে দু’একদিনের মধ্যে প্রথম তুষারপাত হবে। এ বছর অন্য সব বছরের চেয়ে প্রচণ্ড শীত পড়বে,—এরকম কথাবার্তাও শােনা যাচ্ছে। প্রাচীন মানুষেরা আকাশের রঙ দেখে শীতের খবর বলতে পারতেন। স্যাটেলাইটের যুগেও তাদের কথা কেমন করে জানি মিলে যায় ।
ভােরবেল ক্লাসে রওনা হয়েছি। ঘর থেকে বের হয়ে মনে হল আজ ঠাণ্ডাটা অনেক বেশি। বাতাসের প্রথম ঝাপটায় মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি ফিরে এসে পার্কা গায়ে দিয়ে রওনা হলাম। পাকা হচ্ছে এমন এক শীতবস্ত্র যা পরে শূন্যের ত্রিশ ডিগ্রী নিচেও দিব্যি ঘােরাফেরা করা যায়।
হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি পায়ের সামনে চড়ুই পাখির মতো কালো রঙয়ের একটা পাখি ‘চিক চিক’ ধরনের শব্দ করছে। মনে হল শীতে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আমি পাখিটিকে হাতে উঠিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার আঙুলে ঠোট ঘষতে লাগলাে। আমার মনে হলাে পাখিদের কায়দায় সে বলল—তােমাকে ধন্যবাদ। আমি তাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। উদ্দেশ্য, আমার কন্যাকে পাখিটা দেব। সে জীবন্ত খেলনা পেয়ে উল্লসিত হবে। শিশুদের উল্লাস দেখতে বড় ভালাে লাগে।
Read More