কোর্স কো-অর্ডিনেটরের মুখ দেখে মনে হল তিনি আমার ইয়েস শুনেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না।ক্লাস শুরু হল। ছাত্র সংখ্যা পনেরো। বিদেশী বলতে আমি এবং ইণ্ডিয়ান এক মেয়ে কান্তা। ছাত্রদের মধ্যে একজন অন্ধ ছাত্রকে দেখে চমকে উঠলাম। সে তার ব্রেইলি টাইপ রাইটার নিয়ে এসেছে। ক্লাসে ঢুকেই সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমি বক্তৃতা টাইপ করব।
খটখট শব্দ হবে, এ জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি ‘ আমি হতভম্ব। অন্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা করে এটা আমি জানি। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু অন্ধ ছাত্র-ছাত্রী আছে, তবে তাদের বিষয় হচ্ছে সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা দর্শন। কিন্তু ফিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিও কেউ পড়তে আসে আমার জানা ছিল না।
আমাদের কোর্স টিচারের নাম, মার্ক গর্ডন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মস্তান লােক। থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রির লােকজন তার নাম শুনলে চোখ কপালে তুলে ফেলে। তার খ্যাতি প্রবাদের পর্যায়ে চলে গেছে।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-৮
লােকটি অসম্ভব রোগা এবং তালগাছের মত লম্বা। মুখ ভর্তি প্রকাণ্ড গোফ। ইউনিভার্সিটিতে আসেন ভালুকের মত বড় একটা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি যখন ক্লাসে যান কুকুরটা তঁার চেয়ারে পা তুলে বসে থাকে। | মার্ক গর্ডন ক্লাসে ঢুকলেন একটা টি শার্ট গায়ে দিয়ে। সেই টি শার্টে যা লেখা, তার বঙ্গানুবাদ হল, সুন্দরী মেয়েরা আমাকে ভালবাসা দাও।
ক্লাসে ঢুকেই সবার নামধাম জিজ্ঞেস করলেন। সবাই বসে বসে উত্তর দিল। একমাত্র আমি দাড়িয়ে জবাব দিলাম। মার্ক গর্ডন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি দাড়িয়ে কথা বলছ কেন? বসে কথা বলতে কি তােমার অসুবিধা হয় ?
আমি জবাব দেবার আগেই কান্তা বলল, এটা হচ্ছে ভারতীয় ভদ্রতা। মার্ক গর্ডন বললেন, হুমায়ুন তুমি কি ভারতীয় ? ও না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ও ও আচ্ছা, আচ্ছা। বাংলাদেশ। বস। এর পর থেকে বসে বসে কথা বলবে।আমি বসলাম। মানুষটাকে ভাল লাগল এই কারণে যে সে শুদ্ধভাবে আমার নাম উচ্চারণ করেছে। অধিকাংশ আমেরিকান যা পারে না কিংবা শুদ্ধ উচ্চারণের চেষ্টা করে না। আমাকে যে সব নামে ডাকা হয় তার কয়েকটি হচ্ছে ঃ হাষায়ান, হিউমেন, হেমীন।
মার্ক গর্ডন টেবিলে পা তুলে বসলেন এবং বললেন, ক্লাস শুরু করার আগে একটা জোক বলা যাক। আমি আবার ডার্টি জোক ছাড়া অন্য কিছু জানি না। যারা ডাটি জোক শুনতে চাও না, তারা দয়া করে কান বন্ধ করে ফেল।গল্পটি হচ্ছে এক ফরাসী তরুণীকে নিয়ে যার একটি স্তন বড় অন্যটি ছোট। বিয়ের রাতে তার স্বামী ..
গল্পটি চমৎকার, তবে এ দেশে তা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না বলে শুধুশুরুটা বললাম। গল্প শেষ হবার পর হাসি থামতে পাঁচ মিনিটের মত লাগল। শুধু কান্তা হাসল না, মুখ লাল করে বসে রইল। যেন পুরাে রসিকতাটা তাকে নিয়েই করা হয়েছে। | মার্ক গর্ডন লেকচার শুরু করলেন। ক্লাসের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল। বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন, সহজ ব্যাপারগুলি নিয়ে আজ কথা বললাম, প্রথম ক্লাস তো তাই।
হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-৮
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কিছু বুঝতে পারিনি। তিনি ব্যবহার করছেন গ্রুপ থিওরী, যে গ্রুপ থিওরীর আমি কিছুই জানি না।আমি আমার পাশে বসে থাকা আমেরিকান ছাত্রটিকে বললাম, তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে ? ” সে বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বুঝব না, এসব তাে খুবই এলিমেন্টারি ব্যাপার। এক সপ্তাহ চলে গেল।
ক্লাসে যাই, মার্ক গড়নের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিচ্ছু বুঝতে পারি না। নিজের মেধা এবং বুদ্ধির উপর যে আস্থা ছিল তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এ প্রচুর বই জোগাড় করলাম। রাত দিন পড়ি। কোন লাভ হয় না। এই জিনিস বোঝার জন্য ক্যালকুলাসের যে জ্ঞান দরকার তা আমার নেই। আমার ইনসমনিয়ার মত হয়ে গেল। ঘুমুতে পারি না। গ্রেভার ইনের লবিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি। মনে মনে বলি কী সর্বনাশ।