হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-৯

আমার পাশের ঘরের বৃদ্ধা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, তােমার কি হয়েছে বলতাে? তুমি কি অসুস্থ? স্ত্রীর চিঠি পাচ্ছি না?

দেখতে দেখতে মিড-টার্ম পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষার পর পর যে লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে তা ভেবে হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাবার জোগাড় হল। মার্ক গর্ডন যখন দেখবে বাংলাদেশের এই ছেলে পরীক্ষার খাতায় কিছুই লেখেনি

হোটেল গ্রেভার ইন

তখন তিনি কি ভাববেন ? ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানই বা কী ভাববেন ?

এই চেয়ারম্যানকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আলি নওয়াব আমার প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে লিখেছেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যে অল্প সংখ্যক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তেরি করেছে, হুমায়ুন আহমেদ তাদের অন্যতম।

অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটি যখন শূন্য পাবে তখন কী হবে? রাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-৯

মিড-টার্ম পরীক্ষায় বসলাম। সব মিলিয়ে দশটি প্রশ্ন।

| এক ঘন্টা সময়ে প্রতিটির উত্তর করতে হবে। আমি দেখলাম একটি প্রশ্নের অংশবিশেষের উত্তর আমি জানি, আর কিছুই জানি না। অংশবিশেষের উত্তর লেখার কোন মানে হয় না। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এক ঘন্টা পর সাদা খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে এলাম।

পরদিনই রেজাল্ট হল। এ-তাে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় যে পনেরােটি খাতা দেখতে পনেরো মাস লাগবে।

তিনজন এ পেয়েছে। ছ’জন বি। বাকি সব সি। বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছে শূন্য। সবচে বেশি নম্বর পেয়েছে অন্ধ ছাত্রটি। এ ছেলেটির নাম আমার মনে পড়ছে না। তার নামটা মনে রাখা উচিত ছিল।

মার্ক গর্ডন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিস্মিত গলায় বললেন, ব্যাপারটা কী। বলতো?

আমি বললাম, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে আমার কোন ব্যাকগ্রাউণ্ড ছিল না। এই হায়ার লেভেলের কোর্স আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ও বুঝতে পারছ না তাহলে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? ঝুলে থাকার মানে কি? ও আমি ছাড়তে চাই না।ও তুমি বােকামি করছ। তােমরা গ্রেড যদি খারাপ হয়, যদি গড় গ্রেড সি চলে আসে তাহলে তােমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হবে। গ্রাজুয়েট কোর্সের ই নিয়ম।ও এই নিয়ম আমি জানি। ও জেনেও তুমি এই কোর্সটা চালিয়ে যাবে?

তুমি খুবই নির্বোধের মত কথা বলছ। ও হয়ত বলছি। কিন্তু আমি কোসটা ছাড়ব না। ও কারণটা বল।

ও একজন অন্ধ ছাত্র যদি এই কোর্সে সবচে বেশি নম্বর পেতে পারে আমি পারব না কেন? আমার তাে চোখ আছে।

তুমি আবারাে নির্বোধের মত কথা বলছ? সে অন্ধ হতে পারে কিন্তু তার এই বিষয়ে চমৎকার ব্যাকগ্রাউণ্ড আছে। সে আগের কোর্স সবগুলি করেছে। তুমি উপদেশ শােন। এই কোর্স ছেড়ে দাও। | না।

হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-৯

আমি ছাড়লাম না। নিজে নিজে অংক শিখলাম। গ্রুপ থিওরী শিখলাম, অপারেটর এলজেব্রা শিখলাম। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই এই প্রবাদটি সম্ভবত ভুল নয়। এক সময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝতে শুরু করেছি। | ফাইন্যাল পরীক্ষায় যখন বসলাম তখন আমি জানি আমাকে আটকানাের কোন পথ নেই। পরীক্ষা হয়ে গেল। পরদিন মার্ক গর্ডন একটি চিঠি লিখে আমার মেইল বক্সে রেখে দিলেন। টাইপ করা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে ।

—তুমি যদি আমার সঙ্গে থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে কাজ কর তাহলে আমি আনন্দিত হব এবং তােমার জন্যে আমি একটি ফেলােশীপ ব্যবস্থা করে দেব। তােমাকে আর কষ্ট করে টিচিং অ্যাসিসটেন্টশীপ করতে হবে না।

একটি পরীক্ষা দিয়েই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত হয়ে গেলাম। বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিজের উদ্যোগে ব্যবস্থা করে দিলেন যেন আমি আমার স্ত্রীকে আমেরিকায় নিয়ে আসতে পারি।

পরীক্ষায় কত পেয়েছিলাম তা বলার লােভ সামলাতে পারছি না। পাঠক পাঠিকারা আমার এই লোভ ক্ষমার চোখে দেখবেন বলে আশা করি। আমি পেয়েছিলাম ১০০তে ১০০।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হোটেল গ্রেভার ইন খন্ড-১০

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *