হুমায়ন আহমেদ এর হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

সামানা চরি থেকে শুরু করে মানুষের পেটে দশ হলঃ হরি ঢাকিয়ে মােচড় দেয়ার মতো অপরাধ এব্রা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে করতে পারেএরা কখনাে একা চলাফেরা করে নাআবার এদের দল বড়ও হয় না

হিমুর রূপালী রাত্রি

নেয় ছোট ছোট ললদুজনের একজন (সাধারণত দুবলাপাতলাজন) ওস্তান, তিনি হুকুম দেন। অন্য জন সেই হুকুম পালন করে।  কাক মানুষের হাত থেকে খাবার নিয়ে উড়ে যায় কিন্তু তাদেরকে যলি যত্ন করে থালায় খাবার বেড়ে ডাকা হয় আয় আয় তখন তারা আয় কাছে আসে। 

দূর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকেউড়ে চলেও যায় না, আবার কাছেও আসে নাযুবক দুটির মধ্যে কাকভাব প্রবল বলে মনে হলতারা সরু চোখেমানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে আছেহাত বাড়াচ্ছে নাআমাকে ছেড়ে চলে | যাচ্ছে নাআমি আবারও বললাম, কী মানিব্যাগ নিতে চান? নিতে চাইলে নেনপানমুখের যুবক আবারও পিক ফেলল সে একটু চিস্ততমুখে তার স্তা দেয় দিকে তাকাচ্ছে

ওস্তাদের নির্দেশের অপেক্ষাওস্তাদ নির্দেশ দিচ্ছেন নাসময় নিচ্ছেনপরিস্থিতি তিনি যত সহ ভেবেছিলেন এখন তত সহজ মনে হচ্ছে না  চট করে ডিসিশান নেয়া যাচ্ছে না। জায়গাটা নির্জন নয়ঢাকা শহরে নিউনি জায়গা নেইতবে আমি যেখানেদাড়িয়ে সেজায়গাটায় এই মুহর্তে লােকচলাচল নেইওস্তাদ এবং, গারেন আমার দুপাশে দাড়িয়ে আছেওস্তাদের বাঁ হাত তার প্যান্টের পকেটে। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

লােহাটি সম্ভবত বায়া এবং সে তার বা হাতে নেয়া পর্যন্ত শিষ্যগুরুর সাক্ষতি সম্পূর্ণ হবে না  

আফনেরে যে আবার দেখমু ভাবি নাইআল্লাহপাকের মাস রহমতে আফনেরে পাইছিআছেন কেমুন হিমু ভাই” ভাল। আফনে একটা বড়ই আচায্য মানুষ্ক । অখন কন কেমনে আফনের খেদমত করি‘ 

 চা খাওয়াওপয়সা কিন্তু দিতে পারব না। 

দিয়া দুই গালে দুইটা বাড়ি দিতেন। 

আমি ওস্তাদ শাগরেদকে দেখিয়ে বললাম, আমার দুজন গেস্ট আছেএদেরও চা দাও। 

কাওছার মিয়া তার সবকটা দাঁত বের করে বলল, আন্ন কী খাইবেন কুনআর কিছু লাগবে নাছিরাপেট ছিরগেট আইন্যা দেই?” 

 তে লাগণ এবং সে তার বাঁ হাতে খুন ধরে আছেমেতেমুহতে বের করবেসেই মুহুর্তের জন্যে অপেক্ষা  

আমি হঠাৎ করেই লম্বা লম্বা পা ফেলে হাটা শুরু করলামতালা হরিয়ে গেল, তবে তৎক্ষণাৎ আমার পেছনে পেছনে আসতে শুরু করেএমন শিশষ ভঙ্গিতে কাশলেন, সঙ্গে সঙ্গে শাগনের প্রায় দৌড়ে আমার মা চলে এলএখন আমরা তিনজন হাটছিশাগরেদ সবার আগে, মানে , এর পেছনে ওস্তানওরা আমার হাত থেকে শনিব্যাগটা নিয়ে দৌড় দিয়ে ভর কেন বুঝতে পারছি নাসবচে সহজ এবং যুক্তিযুক্ত কাজ হল মানিব্যাগ | দৌড় দেয়াঅবশ্যি এদের নানান রকম টেকনিক আছেএরা কোন টেকনি ফলাে কছে কে জানে। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

আকরাইলের আশেপাশের রাস্তার একটা নিয়ম হল কথা নেই বার্তা ৯ে হঠাৎ একনল তবলিগ জামাতি কোথেকে যেন উদয় হয়এখানেও তাহল দশএগারাে জ্বনের একটা দল পাটলাপুটলি, বদনা, ছাতা নিয়ে উপস্থিতহাসিখুশি কালোতারা চলছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেআমি মাথা ঘুরিয়ে আমার পেছনের ওস্তাদের দিকে তাকালাম বেটাব্লার মুখ হতাশায় মিইয়েগেছেনিচের ঠোট আর নেমে গেছেভাল একটা শিকার পেয়েছিলসেইশিকার হাসিমুখে তবলিগ জামাতীদের দলে ভিড়ে গেছে। 

তবলিগের দল াকরাইল মসজিদের দিকে চলে গেলআমি ইচ্ছা করলে ওদের সঙ্গে ভীড়ে যেতে পারতাম তা করলাম নাআমি রওনা হলাম চায়ের দোকানের দিকেওস্তাদ এবং শাগরেদের মধ্যে নতুন উৎসাহ দেখা দিলতারাচোখেচোখে কিছু কথা বলল দুজনই একসঙ্গে সিগারেট ধরালতারাওআসছে। আসুক চাটা একসঙ্গে খাইহাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই মজাদার নাটকের ভেতর ঢুকে গেছিভাল লাগছেনাটকের শেষটা রক্তারক্তি পর্যন্ত না গড়ালেই হয়

চায়ের দোকানের মালিকের নাম কাওছার মিয়াএক মধ্যরাতে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলকাওছার মিয়ার ধারণা সেই রাতে আমি তাকে ভয়ংকরবিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলামমধ্যরাতের পরিচিতজনরা সাধারণত সন্ধ্যারাতে কেউ কাউকে চেনে নাকাওছার মিয়া চিনলআরে হিমু ভাইয়া, আফনে!এই বলে নেচিৎকার দিল তাতে নামাজ ভঙ্গ করে কাকরাইল মসজিদের

মুণিদের জুটে আসার কথাতারা দুটে এলেন না, তবে ওস্তাদ শাগরেদের | আমেল গুম হয়ে গেলকাওছার মিয়া চায়ের দোকানের মালিক হলেও তাকে এসখাচ্ছে ভীমভৱানার মতােসে আদর করে কালাে পিঠে থালা দিলে সেই মানবসন্তানের মেরুদণ্ডের বেশ কিছু আড় খুলে পড়ে যাবার কথা। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

কাওছার মিয়া চিৎকার দিনেই থামল না, দোকান ফেলে ছুটে এসে পায়ে | পড়ে গেলনেন অনেকদিন পর শিমা তার গুরুর দেখা পেয়েছে চরণধুলি |

কাওছার মিয়া দোকানের ছেলেটাকে পানসিগারেট আনতে পাঠাল তিনশলা বেনসনতিনটা মিষ্টি পান, জরদা আলিদা। 

 ওস্তাদ শাগরেদ পুরােপুরি থমকে গেলতবে চলে গেল নাদাড়িয়েরইলএখন তাদের চোখ আমার হাতে ধরা মানিব্যাগের দিকেআমি চায়ের কাপ তাদের দিকে বাড়িয়ে বললাম, ভাই, চা খানঅনেকক্ষণ আমার পিছনেপিছনে ঘুরছেন, নিশ্চয়ই টায়ার্ড। 

ওস্তাদ বললেন, চা খাব নাশাগরেদও সঙ্গে সঙ্গে বলল, চা খাব না । 

কাওছার মিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, হিমু ভাইয়া চা সাধাতেই, আর চাখাইবেন না ! কন কী আফনে? আচায্য ঘটনা ধরেন চা নেন । 

ওস্তাদ শাগরেদ দুজনেই শুকনাে মুখে চায়ের কাপ তুললকাওছার মিয়া | তার বেনসন সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আফনাদের পরিচয়। 

ওস্তাদ ও শাগরেদ মুখচাওয়াচাওয়ি করছেআমি তাদের পরিচয়দানথেকে রক্ষা করলামকাওছারকে বললাম, শােনাে কাওছার মিয়াআমি একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিমানিব্যাগে টাকার পরিমাণ ভালই, ত্রিশপয়ত্রিশহাজার তাে বটেইটাকাটা দিয়ে কী করা যায় কালাে তাে

কাওছারের মুখ হাঁ হয়ে গেলসে বিড়বিড় করে বলল, খাইছে রে! আমি ওস্তাদ শাগরেদের দিকে তাকালামতারা মনে হচ্ছে দুদুগুখে কেনে ফেলবেআমি তাদের দিকে মানিব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ভাল করে দেখুনতো কোন ঠিকানালেখা কাগজ আছে কী নাআর টাকাটাও গুলো দেখুন ঠিকানা পাওয়া মাওয়া ঠিক নাআমার চোখে কাজল দিয়ে এসেছেসৰ পবতী মেয়েদের চোখ বিষন্ন হমএই মেয়ের চোখও বিষন্ন। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

ভদ্রলােক বললেন, মা, তােকে আমি বলেছিলাম না টাকাটা পাওয়া যাবে

গেলে চলন নিয়ে আসিএতগুলি টাকা একা একা নিয়ে যাওয়া নাম হিম আপনাদের পরিচয়টা কী

বিভবিড় করে বললেন, আমার নাম মােফাজ্জলআর জাতিঠিকানা পাওয়া গেছে?টুকরা কাগজ অনেক আছে কোনটা ঠিকানা কে জানে! দেখে দেখে বের করে ফেলবআপনাদের কাজ না থাকলে আমার সঙ্গে কাজ আছেঃ 

মীরা তাকাল আমার দিকেআমি বললাম, ভাল আছেন

মীরা ভুরু কুঁচকে ফেললআমি মােফাজলের দিকে তাকিয়ে বললাম, মানিব্যাগ দিয়ে দিনমােফাজ্জল কঠিন গলায় বলল, মানিব্যাগ মো উনাদের তা প্রমাণ কী

আমি উদাস গলায় বললাম, প্রমাণ লাগবে নামরা, তুমি টাকাটা |

তা তালে আনিব্যাগটা আপনার পকেটে রাখুনআমার পাঞ্জাবির পতে নেই আপনাদের পাওয়ায় আমার সুবিধাই হল । 

মােহাল আমার দিকে তাকিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল আমি তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে তার চেয়েও বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলামবিচিত্র হাসি বিডি হাসিতে কাটাকাটি। 

কাওছার উৎসাহের সঙ্গে বলল, টিকাটা আগে গনেন কত টেকার। 

জহিরুল টাকা গুনছেবেশ আগ্রহের সঙ্গেই শুনছেকাওছার বলল আরেক দফা চা দিমু হিমু ভাই। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

মীরার কোচকানাে ভুল আর কুঁচকে গেলআমার মতাে অভাজন তাকে তুমি করে বলবে তা সে মেনে নিতে পারছে নামানিব্যাগসংক্রান্ত জটিলতা নাথাকলে সে নিশ্চয়ই শুকানো গলায় বলত, আমাকে তুমি করে না বললে খুশি। 

মােফাজ্জল ভাই, জহিরুল ভাই, আফনেরারে দিমু

জহিরুল টাকা গােনায় ব্যস্তসে কিছু বলল নামােফাজ্জল উদাস গলায়বলল, দাও

আমরা রাত দুটার দিকে ঝিকাতলার এক টিনের বাড়ির দরজায় প্রবল উৎসাহে কড়া নাড়তে লাগলামআমরা কড়া নাড়ছি বলা ঠিক হচ্ছে নাআমি কড়া নাড়ছি, বাকি দুজন চিমশা মুখে দাঁড়িয়ে আছেএরা আমাকে ছেড়ে চলেও যাচ্ছে না, আবার সঙ্গে থাকার কোনাে কারণও বােধহয় খুঁজে পাচ্ছে না বেশ

কিছুক্ষণ কড়া নাড়ার পর এক ভদ্রলােক বের হয়ে এলেনপঞ্চাশষাট হবেবয়সমাথার চুল ধবধবে শাদাভদ্রলােক মনে হয় অসুস্থকেমন উদভ্রান্তপাটআমাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছেন, কিন্তু চোখের পলক ফেলছেননাআমি বললাম, আপনার কী কোনাে মানিব্যাগ হারিয়েছে

ভদ্রলােক কিছু বললেন না, শন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেনআমি বললাম, মানিব্যাগে অনেকগুলি টাকা ছিলআমার ধারণা আপনারই মানিব্যাগ। 

প্রলোক বাড়ির ভিতরের দিকে তাকিয়ে আত গলায় ডাকলেন, মীরা

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

 মােফাজ্জল অপ্রসন্ন মুখে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলএরকম অপ্রীতিকর কাজ সে মনে হয় তার জীবনে অরি করেনিমােফাজ্জলের চেনেন বেশী মন খারাপ হয়েছে তার টেল জহিরুলেরজহিরুলের মানে হয় মনেদুঃখে কেঁদেই ফেলবে। 

ভদ্রলােক আবারও মীরাকে বললেন, বলেছিলাম না সব টাকা ফেরত পাল, বিশ্বাস হল? তুইতাে কেদে অস্থির হচ্ছিলিনে, টাকাটা শুনে লেখ সাইলিশ হাজার নয়শ একুশাে টাকা আছে। 

মীরা বলল, গুনতে হবে নাভদ্রলােক বললেন, আহাগুনে দেখ, না! আমি বললাম, মীরা, তুমি সাবধানে শুনতে থাকোআমরা চললাম । 

শুরুতেই তুমি বলায় মেয়েটা রেগে গেছে, তাকে আবারো তুমি বলে আরও লাগিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলাম। 

মােফাজ্জল ক্রদ্ধ গলায় বলল, এতগুলা টাকা ফেরত পেয়েছে তার বেকাআলামত নাইশালার দুনিয়া! লাথি মারি এমন দুনিয়ারে

জহিরুল বলল, এক হাজার টাকা বখশিশ দিলেওতাে একটা কথা ছিল! কীবলেন ওস্তাদবখশিশ না দেওয়াটা অধর্ম হয়েছে। 

আমি বললাম, বখশিশ পেলে কী করতেন

জহিরুল দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী আর করতামমাল খাইতাম পাতি | চাইরদিনে তিন আঙ্গুল পরিমাণ বাংলা খাইছিতিন আঙ্গুল বাংলায় কী হয় কনতিন আঙ্গুল মাল ইচ্ছা করলে একটা মশাও খাইতে পারেমাল খাওয়া তাে দূরের কথা, আজ সারাদিনে ভাতও খাই নাইআপনার পিছে পিছে বেফিফকির মারা

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-৬

মরা বের হয়ে এলআমি হিনা না হয়ে অন্য কেউ হলে তৎক্ষণাৎ মেয়েটিমনে পড়ে যেতামকী মিষ্টি যে তার মুখ! মনে হচ্ছে, এইমাত্র সে গােসল কণে 

কথার দরকার কী! হিমু ভাইয়া 

এলিতেছিআইজ যত হাটা হাঁটছি একটা ফকিরও অত হাঁটা হাটে না। 

শালবন বিল মখ বলল, উপ কর এত অথার দরকার ! বিননাম দেন, আমরা এখন যাই। যাবেন কোথায়

জানি না কই যাবআমার সঙ্গে চলেন, মাল খাওয়াব। 

মােফাজ্জল সরু চোখে তাকিয়ে রইলসে আমার কথা বিশ্বাস কল পারছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে নাবিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝি, বাস করা খুবই কষ্টকরমােফাজজল আছে সেই কষ্ট। 

শী, যাবেনসত্যি মাল খাওয়াবেন?” 

কী খাওয়াবেনবাংল? বাংলা ইংরেজি জানি না, তবে খাওয়াবচলো যাই।” । 

মােফাল অনিচ্ছার সঙ্গে হাটছেতবে জহিরুলের চোখ চকচক করছেছি মানষ আছে যাদের জন্মই হয় শিষ্য হবার নেজহিরুল হল সেই মান্যএল কখনো বিশ্বাসঅবিশ্বাসের মাঝামাঝি বাস করে নাএরা বাস করেবিশ্বাসের জগতেযে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। 

জহিরুল বলল, হিমু ভাই, আপনেরে আমার পছন্দ হয়েছে

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর রূপালী রাত্রি খন্ড-৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *