হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

বাদশাহ নামদার পর্ব –২০

শের শাহ্ বিশাল বাহিনী নিয়ে লাহোরের দিকে ছুটে আসছেন । এই বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করা এই মুহূর্তে সম্রাটের পক্ষে সম্ভব না । এমন পরিস্থিতিতে আপনার পরামর্শ কী ?

আমি অতি ক্ষুদ্র একজন । সম্রাটকে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই । তারপরও বলব সম্রাট যেন কান্দাহারের ‍দিকে চলে যান পালিয়ে যেতে বলছেন ?

হ্যাঁ । ‘য পলায়তি স্ব জীবতি’ ।

এর অর্থ কী ?

এর অর্থ যে পলায়ন করে সে বেঁচে থাকে ।

মীজা কামরানকে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করা হয়েছে । তাঁর কোমরের তরবারি গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে । দুই হাত শক্ত করে পেছনদিকে বাঁধা । সম্রাটের সামনে বন্দিদের এইভাবেই উপস্থিত করানোর রীতি।

কামরান কুনিশ করার চেষ্টায় সামান্য নিচু হলেন ।

হুমায়ূন বললেন, আমার ভাইকে কেন তোমরা এভাবে আমার সামনে উপস্তিত করেছ ? এক্ষুনি হাতের বাঁধন খুলে দাও । গলা থেকে তরবারি নামাও ।

তা-ই করা হলো । সম্রাট উঠে এসে ভাইকে আলিঙ্গন করলেন । সম্রাট বললেন, আমার মহান পিতা মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন, তুমি সমসময় ভাইদের দেখবে ক্ষমাসুন্দর চোখে । আমি তা-ই করছি । ভাই কামরান, এসো তুমি আমার ডানপাশে এসে বসো ।

বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

কামরান মীর্জা তা-ই করলেন । অসময়ের একটি তরমুজ এসেছিল খোরাসান থেকে । সম্রাট নিজের হাতে সেই তরমুজের খণ্ড ভাইয়ের মুখে তুলে দিলেন । এমন আবেগঘন মুহূর্তে দরবারে ‘মারহাবা’ ধ্বনি উচ্চারিত হয় । কেউ মারহাবা ধ্বনি দিল না । সম্রাট ভাইকে বিশ্রাম নিতে পাঠালেন ।

মধ্যরাতে বৈরাম খাঁ সম্রাটকে ডেকে তুললেন । দুটি দুঃসংবাদ আছে, সম্রাটকে জানানো প্রয়োজন । প্রথম দুঃসংবাদ, শের শাহ্ লাহোরের কাছাকাছি চলে এসেছেন ।

দ্বিতীয় দুঃসংবাদ, মীর্জা কামরান কিছুক্ষণ আগেই তার সেনাবাহিনী নিয়ে কান্দাহার রওনা হয়েছেন । সম্রাট হুমায়ূনের সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্য কামরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন । তিনজন ছাড়া বাকি আমীররাও তাই করেছেন ।

হুমায়ূন বললেন, বৈরাম খাঁ, এর কারণ কী ?

বৈরাম খাঁ বললেন, বিচারসভায় আপনার কর্মকাণ্ড দেখা হয়েছে আপনার দুর্বলতা হিসেবে । সবাই থাকে সবলের পক্ষে ।

আমি কি দুর্বল ?

আপনি অনেক বেশি সবল । এটা ধরার ক্ষমতা তাদের নেই । হুমায়ূন বললেন, সবকিছুই তিনবার করে ঘটে । সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য আসে পরপর তিনবার । তুমি আমাকে দুটি দুঃসংবাদ দিয়েছ । এখন তৃতীয়টি দাও ।

বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাট যদি কামরান মীর্জাকে মৃত্যুদণ্ড দিতেন তাহলে সেই আদেশ দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া ছিল । হাতি এবং হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করার জন্যে পাথর ছিল । কামরান মীর্জা সেই পাথরে সাদ মুহম্মদকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করেছেন ।

সাদ মুহম্মদ কে ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

সম্রাটের এবং আমার অতি অনুগত একজন । তার হাতেই কামরান মীর্জা বন্দি হয়েছিলেন।

বৈরাম খাঁ, আপনি কি নিয়তি বিশ্বাস করেন ?

করি না । কিন্তু আপনি বললে করব ।

সম্রাট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি বলছি না । স্বয়ং আল্লাহ্পাক নিয়তির কথা বলেছেন । সূরা বনি ইসরাইলে বলা আছে, ‘আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের হলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি।’

নিয়তির হাতে সম্রাট নিজেকেই সমর্পণ করলেন। স্ত্রী হামিদা বানু এবং অল্পকিছু অনুগতজন নিয়ে শুরু হলো তাঁর পথেপ্রান্তরে পালিয়ে থাকার দিন । তাঁকে তাড়া করে ফিরল আরেক নিয়তির সন্তান শের খাঁ । ভুল বললাম, খাঁ না । তিনি এখন শের শাহ্ ।

এশার নামাজ শেষ হয়েছে । মীর্জা কামরান নামাজ শেষ করে নৈশকালীন মদের আসরে বসেছেন । আসরে ছয়জন আমীর উপস্থিত । তাদের হাতে রুপার পানপাত্র । মীর্জা কামরানের হাতে সোনার পানপাত্র । মীর্জা কামরান ক্ষুদ্ধ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন । তাঁর মেজাজ সপ্তমে । তবে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন । তাঁর মেজাজ খারাপের প্রধান কারণ, স্বর্ণের পানপাত্রে তাঁকে ছাড়াও আরেকজনকে মদ পরিবেশন করা হয়েছে । তার নাম বরকত খাঁ । বরকত খাঁকে কান্দাহার পাঠিয়েছেন শের শাহ্-পুত্র জালাল খাঁ । বরকত খাঁ’র মর্যাদা একজন আমীরের চেয়ে বেশি হতে পারে না । তাঁকে স্বর্ণপানপাত্রে মদ পরিবেশন করে মীর্জা কামরানকে ছোট করা হয়েছে । মীর্জা কামরান ভেবে পাচ্ছে না, স্বর্ণপাত্রের এই ভুলটা কারা করেছে! খেদমতগাররা এমন বড় ভুল করবে না । নিশ্চয়ই এখানে আমীরদের ভূমিকা আছে ।

বরকত খাঁ পানপাত্রে চুমুক দিচ্ছেন না । এটিও এক ধরনের অপমান । মীর্জা কামরান বললেন, আপনার কি নেশার পানীয় বিষয়ে আসক্তি নেই ?

বরকত খাঁ বললেন, জি না জনাব । আমি ধর্মভীরু মানুষ । ধর্মের অনুশাসন মেনে চলি । পরকালে হুররা যে মদিরা পরিবেশন করবেন তার জন্যে অপেক্ষা করাটাকে উওম মনে করি । মীর্জা কামরান বললেন, আপনি কি জালাল খাঁ’র কাছ থেকে কোনো পত্র এনেছেন ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

জি না জনাব । জালাল খাঁ তার পিতার স্বভাব পেয়েছেন । কলমের খেলার চেয়ে অসির খেলা তার অধিক পছন্দ । মীর্জা কামরান পানপাত্রে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বললেন, জালাল খাঁ আপনাকে পাঠিয়েছেন কেন ?

আপনার কুশল জানার জন্যে । আপনার শরীর কেমন জনাব ?

শরীর ভালো ।

পেটের পীড়ার ঘনঘন আক্রমণে শিকার হন বলে শুনেছি । পেট কি ঠিক আছে ?

পেট ঠিক না থাকলে আপনি কি ওষুধ দেবেন ?

সেই যোগ্যতা আমার নাই জনাব । আমি সামান্য দূত । কথা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার বাহনবিশেষ ।

মীর্জা কামরান বললেন, জালাল খাঁ’র কাছ থেকে কী কথা এনেছেন বলুন শুনি ।

আমি কথা এনেছি আপনার জন্যে । আপনার আমীরদের জন্যে না । তাদের সামনে আমি মুখ খুলব না ।

ওরা সবাই আমার বিশ্বস্ত ।

বরকত খাঁ হাসতে হাসতে বললেনম, এদের মধ্যে অনেকেই কিছুদিন আগে হুমায়ূনের বিশ্বস্ত ছিলেন। আমীরদের বিশ্বস্ততা আর বেশ্যাপল্লীর শারীরিক পরিত্রতা তুল্যমূল্য ।

মীর্জা কামরান কঠিন ভাষায় বললেন, আপনি আমার সামনে আমার আমীদের অপমান করছেন!

দুঃসময়ে কোনো অপমান গায়ে মাখতে হয় না । মোঘলদের এখন চরম দুঃসময় ।

মীর্জা কামরান বললেন, আপনার যদি কিছু বলার থাকে আমার আমীরদের সামনে বলতে হবে ।

বরকত খাঁ বললেন, আমার কিছুই বলার নাই জনাব । আপনার কুশল জানতে এসেছিলাম । কুশল জানা হয়েছে । সন্তোষ লাভ করেছি । এখন অনুমতি পেলে বিদায় হব ।

বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

বলতে-বলতে বরকত খাঁ উঠে দাঁড়ালেন । লোকটির ঔদ্ধত্য এবং দুঃসাহস দেখে মীর্জা কামরানের পিত্তি জ্বলে গেল । প্রধান আমীর বললেন, আমরা চলে যাচ্ছি । আপনারা আলোচনায় বসুন । সবার শান্তির জন্যেই আলোচনা জরুরি ।

মীর্জা কামরান ইশারায় বরকত খাঁকে বসতে বললেন, । আমীররা ঘর খালি করে চলে গেল । দুজন খিদমতগারকেও চলে যেতে হলো ।

বরকত খাঁ বললেন, এখন মূল কথায় আসা যাক । জালাল খাঁ আপনার কাছে জানতে চাচ্ছেন, আপনি শের শাহ্’র জন্যে অর্থাৎ দিল্লীর মহান সম্রাটের জন্যে কী করতে পারেন ।

মীর্জা কামরান বললেন, আমাকে শান্তিতে থাকতে দিলে অনেক কিছুই করতে পারি । আপনারা আমাকে শান্তি দেবেন, আমি আপনাদের শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করব ।

আপনার কি ধারণা দিল্লীর সম্রাট অশান্তিতে আছেন ?

অবশ্যই । আপনারা হুমায়ূন-আতঙ্কে ভুগছেন । তাঁকে তাড়া করে ফিরছেন । আপনাদের ধারণা, তিনি দ্রুত শক্তি সংগ্রহ করবেন । আপনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেবেন । যাই হোক আমি সরাসরি বলি, আমি আমার বড়ভাইকে জীবিত বা মৃত আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারি । তার বিনিময়ে আমি কী পাব ?

বরকত খাঁ বললেন, রেশমের কাজ করা মণিমুক্তা বসানো একজোড়া পাদুকা শের শাহ্ নিশ্চয়ই আপনাকে দেবেন ।

রসিকত করছেন ?

রসিকতা কেন করব! শের শাহ্ পাদুকা উপহার ‍দিতে পছন্দ করেন । তিনি যোধপুরের রাজা মালদেবকে একজোড়া পাদুকা উপহার দিয়েছেন । ঘটনার সত্যতা সন্ধান করলেই জানতে পারবেন । যাই হোক, জালাল খাঁ আমাকে পাঠিয়েছেন হুমায়ূনকে বন্দি করার বিষয়ে আপনার সাহায্য কামনা করতে । বিনিময়ে আপনি লাহোর ফিরে পাবেন । শুনেছি লাহোরের জলবায়ু আপনাকে পীড়ামুক্ত রাখতে সাহায্য করে ।

মীর্জা কামরান বললেন, শুধু মুখের কথা! এই বিষয়ে কোনো চুক্তি হবে না ?

বরকত খাঁ বললেন, যাদের মুখের কথা মূল্যহীন তারাই চুক্তির জন্যে লালায়িত হয় । জালাল খাঁ’র মুখের কথা মূল্যহীন না ।

আমি কবে লাহোর যেতে পারি ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

ইচ্ছা করলে এখনই রওনা দিতে পারবেন । পান বেশি করেছেন, এই অবস্থায় রওনা দেওয়া ঠিক হবে না । বলতে ভুলে গেছি, জালাল খাঁ আপনার জন্যে উপহার পাঠিয়েছেন । উপহার আপনার পছন্দ হবে ।

কী উপহার ?

বাংলা মুলুক থেকে আনা দুজন হিজড়া । হিজড়ার বিষয়ে আপনার আগ্রহের কথা আমরা জানি । শারীরিক ক্রটির কারণে ওদের অন্য গুণাবলি বিকশিত হয় ।*

আমি উপহার পেয়ে খুশি হয়েছি, ওনাকে ধন্যবাদ ।

বরকত খাঁ বললেন, আপনি আমীরদের আসরে ডাকুন ।

*বঙ্গদেশের হিজড়াদের মোঘল হেরেমে কদর ছিল । রাজপুরুষরা যৌন কদর্যতামুক্ত ছিলেন না । ভারতবর্ষের বাইরেও তাদের চাহিদা ছিল ।

আনন্দযাত্রা অব্যাহত থাকুক । জালাল খাঁ’র উপহার কেমন তাও দেখুন । আমি বিদায় নিচ্ছি ।

মীর্জা কামরানের আনন্দফুর্তি সারা রাত স্থায়ী হলো । হিজড়াদের নৃত্যগীত মীর্জা কামরানকে বিমোহিত করল।

কিছুক্ষণের জন্যে আমরা আচার্য হরিশংকরের কাছে ফিরে যাই । তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে হুমায়ূনের সঙ্গী হন নি । তিনি এখন আছেন পুণ্যধাম কাশিতে ।

তাঁর হাতে স্বর্ণমুদ্রা এবং রৌপ্যমুদ্রার সংগ্রহ ভালো । হুমায়ূন তাঁকে দুটি রুবি পাথরও দিয়েছেন । হরিশংকরের বাকি জীবন ভালোমতোই যাওয়ার কথা

তিনি কাশিতে একটি ঘর ভাড়া করেছেন । একজন পাচক রেখেছেন, দারোয়ান রেখেছেন । তাঁর সময় কাটে মন্দিরে মন্দিরে ।

একদিনের কথা, তিনি মন্দিরে সন্ধাপূজা দেখে ঘরে ফিরে দেখেন তার বিছানায় হুমায়ূন-কন্যা আকিকা বেগম। সে হাসিমুখে বসে আছে ।

হরিশংকর বুঝলেন চোখের ধাক্কা । কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে রাম নাম নিয়ে চোখ খুললেন, আকিকা বেগম আগের জায়গাতেই বসা । সে মিষ্টি গলায় বলল, আমার বাবা সম্রাট হুমায়ূন কোথায় ?

বাদশাহ নামদার পর্ব –২১

হরিশংকর মূর্ছিত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন ।

জোছনাপ্লাবিত রজনী । রাজ্যহারা সম্রাট দলবল নিয়ে পালাচ্ছেন । তিনি যাচ্ছেন সিন্ধুর দিকে । তাঁর সারা দিন ঘোড়ার পিঠে কেটেছে । সন্ধায় মাগরেবের নামাজের কিছু বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করেছেন ।

হুমায়ূনকে অনুসরণ করছেন কুতুব খাঁ । শের শাহ্’র আরেক পুত্র । তার ওপর নির্দেশ হুমায়ূনকে হিন্দুস্থান-ছাড়া করতে হবে । তাঁর ওপর সরাসরি চড়াও হওয়ার প্রয়োজন নেই ।

 

Read more

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –২২

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *