হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-২০)

পরাগকে কিছুই তেমন স্পর্শ করে না । ডারী উদাস লাগে। এরা ওই ঘটনার কত ভুল ব্যাখ্যা করছে। 

তার চেয়েও বড় কথা হল, হাওয়া ঘুরছে। এতদিন পরাগ ছিল ভিলেন এখন ধীরে ধীরে কি ভিলেন হয়ে উঠবে তােতন? কিন্তু তাতে আর কী লাভ পরাগের? সে তাে আর এই খেলায় ফিরবে 

না! 

হৃদয়বৃত্তান্ত-পর্ব-২০অনন্যা বউদি আর অশােকদাকে খানিকটা নিরাশ করেই ফিরে আসতে হল পরাগকে। 

এখন আমেরিকায় চলছে বিখ্যাত ফল। গাছে গাছে বার্তা রটে গেছে, পাতা খসানাের সময় হয়েছে ক্ষ। সবুজ পাতা হয়ে উঠছে লাল, মেরুন, হলুদ,রঙে রঙে হালাপ আমেরিকার অশ্যবহুল প্রকৃতি। চারদিক যেন মানা রংরে এক ক্যালেডিওস্কোপ । খুব ভােরে উঠে পড়ে পরাগ। ডাক্তার তাকে নানারকম ব্যায়ামের উপদেশ দিয়েছে, দৌড়াতে বলেছে। কিন্তু তার জন্য, এই ফলড় অলৌকি সৌন্দর্যই তাকে বােরবেলা টেনে আনে বাইরে। ঘরের কাছেই বনভূমি। সেখানে রয়েছে চমৎকার নির্জন দীর্ঘ জগারস্ ট্রেইল। পরাগ দৌড়াতে দৌড়াতে মাথা পরিস্কার হয়ে যেতে থাকে। আজকাল অনেক কথা সে পারম্পর্য সহকারে ভাবতে পারে যা আগে পারত না। মন শান্ত হয়ে যায়। মাথা ঠাণ্ডা হতে থাকে। দৌড়ােয় আরও অনেক । মুখােমুখি, চোখাচোখি হলেই পরম্পর বলে ওঠে ‘হাই’ বা ‘গুড মর্নিং’। চেনা জানা থাক বা না থাক। আগে যান্ত্রিকভাবে হাই বা গুড মর্নিং বলত পরাগ 

হৃদয়বৃত্তান্ত-পর্ব-২০

আজকাল তা বলতে ভালই লাগে। 

তার পাশের বাড়িতেই থাকে জন হিক। জনের বাবাে তেরাে বছরের মেয়ে নিনার সঙ্গে আজকাল প্রায়ই দেখা হয়ে যায় পরাগের। দৌড়াতে দৌড়ােতে মাঝে মাঝে পাশাপাশি চলে আসে মেয়েটা। 

হাই নয়, গুড মর্নিং। গুড মর্নিং নিনা। আর ইউ ওকে নাউ? কোয়াইট ওকে, থ্যাংক ইউ। ইউ আর এ সেহ্রিাইটি, আই নাে । ইটস্ নাথিং মাই ডিয়ার। কান উই রান টুগেদার এভরি ডে? হােয়াই নট? ইউ লিভিং অ্যালেন না? ইয়া।। ওঠ ইউ ডেট মি সাম ডে? ওমেন ওয়েল, আই উইল থিংক ইট ওডার। মম সেজ ইউ আর এ লােনার। ইউ ডােন্ট মাইক গার্লস। দ্যাটনটটু।

হৃদয়বৃত্তান্ত-পর্ব-২০

নিতান্ত কিশােৰীও ডেট করতে চাইছে তার সঙ্গে! পৰাগ খাব হাসে আপন মনে, সাড়ে সাতটার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে পড়ে পরাগ। আজকাল কাজে ডুবে যেতে তার খুব অসুবিধে হয় না। মনটা সুস্থির রয়েছে ভারসাম্য আছে। কিন্তু এখনও তার জীবনের অনেক সূতে ৰূলে আছে এখানে সেখানে। 

সব সমস্যার সমাধান তার পক্ষে তাে সম্ভব নয়। 

নিউ জার্সিস পুজো কমিটির মিটিং হয়ে গেল । একদিন যতীনদা টেলিফোন করে বললেন, ওরে এবার তােকে আমার একটা রিসেপশন দিচ্ছি। 

রিসেপশন! কেন যতীন?। তুই যে হীরাে বনে গেছিস? কিসের হীরে ! ওসব প্রচারে বিশ্বাস করবেন না। আমি ক্রনিক কাপুরুষ। চ্যানেল ফোর বা নিউ ইয়র্ক টাইমস্ তাে সে কথা বলছে না। খবরটা যে কত ভুল তা যদি জানতেন! সে যাই হােক, রিসেপশনটা হচ্ছে। তৈরী থাকিস। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-পর্ব-২০

সেন্ট্রাল পার্কে একটা মারপিটের ঘটান থেকে যে জল এতদূর গড়াবে এটা ভ’তে পেরেছিল। পরাগের ইচ্ছে করে হারলেমের সেই কলাে ওস্তাদের গানে গিয়ে চুমু খেয়ে বলে আসে, সােনার চাঁদ ছেলেরা, তােমরা এরকম কাজ রােজ করে যাও গড রেস ইউ। 

পরাগ আজকাল খবরের কাগজ এবং বই পড়ে । গান শােনে । গান গায় । সে রােজ সাবান দিয়ে স্নান করছে। রাতে শােওয়ার আগে উঁত মাজতে আর ভুল হচ্ছে না। সুপারস্টোরে গিয়ে আজকাল সে। আনাজ ও অন্যান্য গেরস্থালীর জিনিস কিনছে। সপ্তাহে একদিন সে দাড়ি ও গো ট্রিম করে। জামাকাপড় কাচা ও ইস্তিরি করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল পরাগ । আবার শুরু করল । 

একথা ঠিক যে, সে অনেক গরিব হয়ে গেছে। শর্মিষ্ঠাকে আঙ্কেল সেলামী যা দিয়েছে তার ভার বহন করার মতাে পকেটের জোর তার ছিল না। শুধু মায়ের হাত থেকে শর্মিষ্ঠাকে এবং শর্মিষ্ঠার হাত থেকে মাকে এবং নিজের হাত থেকে শর্মিষ্ঠাকে এবং শর্মিষ্ঠার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে সে বেকুবের মতো টাকা দিয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা যা জানত না। সম্পর্ক যথন খরাপ থেকে পারাপতর-র দিকে যাচ্ছিল, যখন ঘরে মারদাঙ্গা এবং বিস্কোরক মুহূর্তগুলি একের পর এক তৈরী হচ্ছিল তখন আর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেনি পরাগ। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-পর্ব-২০

শর্মিষ্ঠা আজও ডিভাের্স দেয়নি। পরাগের অবশ্য আর প্রয়ােজনও নেই। তাড়া তাে নেই-ই। | কিন্তু মেয়েটা তাকে যে যথেষ্ট ছিবড়ে করে ছেড়েছে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ধারকর্জের বহর। এ চোট সামলে ওঠা মুশকিল। কলকাতায় বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটটা হাতছাড়া হল। মা মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে থাকতে চাইতে বলে কেনা। তবে সেই ফ্ল্যাটের জন্যে তেমন দুঃখ নেই পরাগের। দেশে ফেরার বাসনা বা প্রয়ােজন কোনটাই নেই তার। সে বহুকালের গ্রীন কার্ডধারী । ইচ্ছে করলেই মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে নিতে পারে। তাই নেবে। তার প্রয়ােজনও খুব সীমাবদ্ধ একাকী জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পক্ষে তেমন কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু মুশকিল হবে শর্মিষ্ঠা আরও দাবী-দাওয়া তুললো শমিয়ার বাবা পরিতােষবাবু উঁদে মানুষ। চাইলে আদায় করতে অসুবিধা হবে না। কাশ শর্মিষ্ঠাকে সে যা দিয়েছে তা তাে আদালতের নির্দেশে নয়। সেগুলাে অ্যালিনি হিসেবে এম রা যাবে না। 

এটে এখন পরাণের দুচিন্তার কারণ ডিভাের্সের পর শর্মিষ্ঠা যত তাড়াতাড়ি তােতনকে বিয়ে করে ফেলে ততই পরাপের শকে মম। 

নিনার সঙ্গে তােরে বনপথে দেখা হয় মাঝে মধে। 

এ ডেট মি? 

সাম ডে। 

নেক্সট উইক এন্ড? নাে। নট দিস উইক এন্ড । সাম ডে। আই উইল মেক ইট। ডােন্ট ইউ লাইক মি? ওঃ, ইউ আর নাইস। টুগেদা উই মে ডু সামথিং টেরিফিক। অফকোর্স। ওয়েল, বাই দেন। বাই নিনা। 

পরাগ ভারী অস্বস্তি বােধ করে। ওইটুকু মেয়ে। ডেট মানে তাে স জানে । ছিঃ ছিঃ, ওইটুকু মেয়ে-! তবে আপাদমস্তক অবাক হয়ে সে একদিন টের পায়, কাম তাকে ছেড়ে যায়নি। শীতের সাপের মতাে ঘুমিয়েছিল শুধু। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-পর্ব-২০

চার । সকাল থেকেই বাড়িতে একটা সাজো-সাজো রব পড়ে গেছে। কোন ভেরে যশােধরাকে ঠেলে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে মা । সারা রাত ঘুমহীন অস্বস্তির মধ্যে কাটিয়ে ভাের রাতেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল যশোধরা। ভােরবেলা ডাকতে বউ আদুরে গলায় বলে, কেন ডাকছাে মা? 

ওঠ ওঠ । আজ দক্ষিণেশ্বরে পূজো দিতে যেতে হবে না? উঠছি মা। আর পাঁচটা মিনিট। 

মা আদর করে বলে, ওঠ মা! আর দেরী করলে ওদিকে বড্ড দেরী হয়ে যাবে। ছুটির দিনে মন্দিরে ভীষণ ভীড় হয় যে। 

অন্য দিন হলে যশােধরা আরও কিছুক্ষণ ঠিক বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকত। কিন্তু হঠাৎ ধক করে মনে পড়ল, আজ তাকে দেখতে আসবে। 

জীবনে এই প্রথম পাত্রপক্ষের সামনে বসবে যশােধরা। ভীষণ, খুব সাংঘাতিক এবং ঘােরতর আপত্তি ছিল তার। সে যুগ কি আর আছে নাকি যে, মেয়েরা বাজারি পণ্যের মতাে পছন্দ হওয়ার জন্য সকলের সামনে গিয়ে গিয়ে বসবে! 

 

Read More

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-২১)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *