হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-১১)

চার পাচটা ঝিঙে তুলে হাতে নিয়ে মাচানের ছায়া অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এলেন অবনীবাবুর সবই মাঝারি । রং না। কালাে, উচ্চতা মাঝারি, স্বাস্থ্য মাঝারি । ভীড়ের মধ্যে নজরে পড়বার মতাে চেহারা নয়। বয়স সত্তরের কাছেপিঠে হতে পারে। পরনে ধুতি এবং একটা হাতাওয়ালা গেঞ্জী। একসময়ে পাক্কা সাহেব ছিলেন। থ্রি পিস স্যুট, টাই, বে এখনও ট্রাংক বাক্সে পড়ে আছে বেশ কয়েকটা বিশেষ করে অজস্র টাই। ইংরিজি পালেপার্বণে ওই এক বন্ধু প্রচুর উপহার পাওয়া যেত ইংরেজ আমলে। ইদানীং সেগুলাে সমূলে বর্জন করেছেন। বেশ কয়েকটা ব্যাট ছিল, সেগুলাে বাড়ির ছােটোর পরে পরে নষ্ট করেছে।হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

ঝিঙে তুলে নােটনকে দেখিয়ে বললেন, নিজের হাতে ফলানাে জিনিসের স্বাদ আলাদা। তাতে দিয়ে খেতে অতি চমৎকার। 

নােটন বিরস মুখে বলে, আপনি আমাকে ঝিড়ে চেনাচ্ছেন শাখা? ঝিre কি আমরা বিস্তর পাই ? বাজারে কি প্রচুর ঝিঙে ওঠে না? মায়ের হাতের ঝিঙে-পপাস্তা যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাদ্য সেও কি আমরা জানি না? 

অবনীবাবু একটু তল্যির সঙ্গে বলেন, ঝিঙে পােস্তা! ওটা কি একটা বাদ্য হল? ঝিঙে পাতুরি খেয়েছাে? নারকোল আর সর্ষেবাটা দিয়ে চাপটা মতাে করতে হয়। ওই পাতুরি দিয়েই একথা তাত তুলে ফেলা যায়। তােমার মা শিখেছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছে। কেন যেন আজকাল আর করতে চান না সেটা। পাতুরির একটা কায়দা আছে, পুরাে চাপটাটা কড়াই ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে উল্টে দিতে হয়। তােমার মায়ের হাতে আর্থারাইটিস, তাই বােধহয় পেরে ওঠেন না। | জগিং-টগিং আমার পোষাবে না বাবা। খাওয়া কন্ট্রোল করাও আমার কর্ম নয়। এছাড়া আর কোনও পথ নেই? | সংযম আর পরিশ্রম। এ ছাড়া মানুষের আর কোন মূলধন আছে তা তো জানা নেই। তবে এই সালওলাসের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারাে । কত নতুন নতুন নিদান তাে বেরােচ্ছে। 

আপনিও তাে বিজ্ঞানের লােক। 

সেসব পুরােনাে বিজ্ঞান, এ যুগে অচল । ভুলেও গেছি সব। তােমার এমন কি মেদবৃদ্ধি হল তা তাে বােঝা যাচ্ছে না। একটু উনিশ-বিশ হয়ে থাকতে পারে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। | মাথা নেড়ে নােটন বলে, আপনি বুঝছে না বাবা, এ জিনিস একবার হওয়া খাওয়া রু করলে ঠেকানাে মুশকিল। আমি বড় খাই যে। ভীষণ খাই। কপালটাও খাওয়ার । ভাল ভাল হােটেলে ডিনার খেতে হয় পার্টি লেগেই আছে। 

অবনীবাবু তিমুখে বললেন, হােটেলে খাওয়া খুব ভাল জিনিস নয়। খাওয়া ছাড়াও আনুষঙ্গিক জিনিস আছে । এক পেগ হইঙ্গিতে কত ক্যালােরি থেকে জানাে? 

নােটন এবার দশাতই অস্বস্তিতে পড়ল। হুইস্কি সে খায় বটে, কিন্তু অবনীবাবুর সেটা না-জানার ভান করা উচিত। এদেশে সেটাই নিয়ম। নােটন এটা ভু-রুত শব্দ করল। হয়তো সেঁকু, হয়তাে ওটাও একটা এপ্রেশন। 

ছেলের অস্তি লক্ষ করেই অবনীবাবু বললেন, আজ বিকেলের দিকে বরানগরে মেয়িটিকে দেখে আসবে নাকি? তােমার মা আর বোনেরা যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে একজন পুরুষমানুও যাক, দুরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচারটা ভাল হয়। 

কাহিল মুখে নােটন বলে, আবার আমি কেন বাবা? আমি ব্যাচেলর মানুষ, এসবের কীই বা বুঝি? 

ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবে তাতে তো তােমার ব্যাচেলরশিপ ক্ষুন্ন হবে না। ব্যাপারটা তাড়াতাড়িই ঘটানো দরজার । তোমার মা কিন্তু উন্নি, আর এই উদ্দেগে পড়ে উনি হয়তাে বাছাবাহি বা ভালমন্দ বিচার করবেন না। সেই জন্যই তােমাকে সঙ্গে যেতে বলি। | নােটন যথেষ্ট সিরিয়াস মুখ করে বলে, উদ্বেগের যা কারণ শুনলাম সেটা তেমন ভাবার মতাে কিছু নয়। মেয়েটা তাে এথও ডিভাের্স দেয়নি। 

ডিভাের্স না দিলেই কি আর নিশ্চত থাকা ভাল? আইন আদালতের ব্যাপার দুদিন পরে হলেও হবে। ইতিমধ্যে তাে আর নর-নারীর সম্পর্ক থেমে থাকবে না। আজকাল সকলেই অপরিণামদর্শী। তােমার ভাইটি আবার একটু দার্শনিক টাইপের । বাস্তববােধ কম । 

বাবা, তােতন আমেরিকায় থাকে। বাস্তববােধ কম হলে ওখানে চলে না। আপনি তাে সব নিজেই চোখেই দেখে এসেছেন। 

দেখেছি বলেই বলছি । আমেরিকায় তােমার ভাই সত্যিই অচল। ড্রাইভিং লইসেন্স নিতে ভুলে যায়, ক্রেডিট কার্ড বাড়িতে রেখে দোকানপাটে গিয়ে লজ্জায় পড়ে, অফিসের কাজেও নিশ্চয়ই গাফিলাতি আছে, নইলে এতদিন তার ম্যানেজেরিয়াল ব্যাংকে যাওয়ার কথা। 

ঠিক আছে। যাবাে। 

সবচেয়ে চিন্তার কথা হল, কলকাতার ফ্ল্যাটে মেয়েটি একা থাকে এবং তােমার ভাই সেখানে যাতায়াত করে। 

সামান্য বুক চিতিয়ে নােটন বলে, যদি বলেন তা মেয়েটিকে একটু কড়কে দিতে পারি । 

অবনীবাৰু অবাক হয়ে বলেন, ভ লাগাবে নাকি? ওসব করতে যেও না, হিতে বিপরীত হবে। এসব ঠিক পাস্কোয়ারি ব্যাপারে নয়। তার চেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলে ল্যাটা চুকে যাবে। 

এবার কি আর হবে? তােতনের ছুটি তাে ফুরিয়ে এল। 

বিয়ে ঠিক হলে ছুটি বাড়াতে পারবে। তােমার মা চাপাচাপি করায় স্বীকারও হয়েছে । কিন্তু অল্প সময় একটা ভাল পাত্রী জেটানােই কঠিন। আজকের বিকেলটা ফ্রি থেকো। 

নিশ্চয়ই বাবা। তবে আমার কিন্তু মেয়ে দেখার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কোন কোন পয়েন্টে ভাল-মন্দ বিচার করব তা তাে জানি না। 

ভাবটা কেমন সেটা আঁচ করা চেষ্টা কোরাে। আর দেখতে হয় পরিবার। চারদিকে লক্ষ গর। কে কিরকম বন করছে, সহবৎ জানে কি, বিনয়টা সহজাত কিনা, নাকি অভিনয় করছে | ২০ 

এসব বিচার করে দেখবেশুধু দায়সারা ভাবে ঘাড় নিচু করে বসে থেকো নাদেখার চোখ থাকলে সামান্য সামান্য ব্যাপার দেখেও অনেকটা আঁচ করা যায়। 

পর্যন্ত তাে পাঁচ ছুটি দেখা হয়েছে বােধহয়কোনওটাই পছন্দ হয়নি নাকি? 

তা নয় শতকরা হিসেবে কোনওটা পঁচিশ ভাগ, কোনওটা পঞ্চাশ ভাগ পছন্দ হয়ে আছেতােমার বােনের ষােল আনা সন্তুষ্ট নয়, তারা আরও কয়েটা দেখতে চায়। 

আপনি নিজে দেখলেই তাে হয় আমাদের সিলেকশনে ভুল থাকতে পারে। 

অবনীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, সেটা ভাল দেখায় নাআর আমারও আর এসব ব্যাপারে থাকতে ইচ্ছে যায় না। আজকাল দেখছি পুরুষরা যখন ওন্ড টাইমার হয় তখন তাদের মতামতের মৃল্য কমে যায় । 

নােটন কৃত্রিম বিষণতা মাখানাে গলায় বলে, সংসারে ব্যচেলরদেরও মতামতের তেমন কোনও মূল্য নেই বাবা । 

অবনীবাবু হাসলেন। বললেন, তাহলে ব্যাচেলর থাকার দরকারটাই বা কি? সাধন ভজন কছো না, দেশের কাজ করছে না, অথচ ব্যাচেলর ধাছে এটা তাে মিনিংসে হয়ে যাচ্ছে। 

কথাটার জবাব দেওয়ার মানেই হয় না নােটনের কোনও জবাব নেইও। সে ঝিও কটা হাত বাড়িয়ে অবনীরবাবুর হাত থেকে নিয়ে বলল, আপনার হাতের ফলন খুব ভাল বাবা। ঝিঙের সাইজটা দারুণ হয়েছে। 

অবনীরবাৰু এখন বাগানেই থাকবেননােটন ঝিঙে হাতে দোলাতে দোলাতে লন পার হয়ে হলঘরে ঢুকল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *