হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-১৫)

টি ভি-তে সে চ্যানেল চালিয়ে সে দেখছে । বিরক্তকর। তার আজকাল কোনও কামবােধ নেই। দুটি নগ্ন নরনারীর কৃপ্তি দেখতে দখেতে তার মনে হয় এর কোনও মানে হয় না। এ ব্যাপারে সে খুব বেশী পটু নয় বলে সুস্পষ্ট অভিযােগ ছিল শর্মিষ্ঠার । সেই অপমান আজও তাকে ভীষণ ঠান্ডা করে রাখে। ড্রাগ না ধরালেও আজকাল ঘুমের ওষুধ খায় পরাগ। ঘূৰ হল।

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়অবশ্য ! কিন্তু শরীর ঝিমিয়ে থাকে । বছর খানেক আগে মেডিক্যাল চেক আপ-এ তার হার্টের গন্ডগােল ধরা পড়েছিল। আর সে ডাক্তারের কাছে যায় না। যা খুশি হােক। 

কাল থেকে দীর্ঘ ছুটির দিন। কী করবে পরাগ? আজকাল এদেশে তার কোনও বন্ধু জুটছে না। শর্মিষ্ঠাকে বাড়ি থেকে তাড়ানাের পর থেকেই সে ভীষণ আন-ওয়েলকাম সব জায়গায়। কোথও যায় না পরাগ । দু-একজন সাহেব বন্ধু ছিল। আজকাল তাদের সঙ্গেও মেলে না সে। 

ফ্রিজে কিছুই থাকে না আজকাল । রাখাই হয় না। পরাগ কদাচিৎ জিনিসপত্র কেনে। আজ ফ্রিজ খুলে দেখল,পর কেনা এক কার্টুন দুধ রয়েছে। খুলে সেটাই ঢকঢক করে খেয়ে নিল সে। ব্যস, আর ডিনারের ঝামেলা নেই। খাওয়া যে আজকাল শান্তি বিশেষ। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

প্রত্যেকের জীবনই তার নিজেস্ব রকমের। বিভিন্ন ঘটানার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সবকিছুর ওপর মানুষের হাত থাকে না। পরাগের ছােটো ভাই মারা যায় আট বছর বয়সে, কলকাতার রাস্তায় একটা অ্যাকসিডেন্টে। পরাগেয় জীবনের টার্নিং পয়েন্ট এটাই । সেই থেকে তাকে আঁকড়ে ধরল। এমন ধরুল যে, পরাগের আর স্বাধীন হওয়া হল না কখনও। ভাইটা যদি এভাবে না মরত, বাবা যদি আজও বেঁচে থাকত, কিংবা আরও কয়েকটা ভাই বােন যদি থাকত তার, তাহলে ঠিক এরকম হতে পারত না । ন ত প ছিল না কখনও। কিন্তু হিংসুটে ছিল। বড় হিংসুটে।। 

শর্মিষ্ঠার কথা খুব কমই মনে পড়ে তার। পড়লে সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে রাগে । শুধু রাগে । এত অপমান তাকে কেউ কখনও করেনি। তুমি এর মতাে নও, তুমি ওর মতােনও, তুমি কেমন যেন, আচ্ছা তােমার কি ইডিপাস কমপ্লেক্স আছে ? তুমি কি ইমপােটেন্ট ? আজকাল পরাগের বাড়িতে 

নি বাজে না। কেউ তাকে রিং করে না, সেও কাউকে নয় । বােবা টেলিফোন পড়ে আছে বহুকাল । 

আৰু টি ভি খুলল পরাগ! নিউজ চ্যানেল । কিছু নেই। খুলল বাচ্চাদের চ্যানেল। কিছু দেখার মতো নয় । ওপরে শােওয়ার ঘর অবধি সে কদাচিৎ ওঠে। সােফায় শুয়ে রইল চুপচাপ। জামাকাপড় 

ছেড়েই । তারপর অন্ধকারে জেগে থাকা আর জেগে থাকা। অন্ধকার হলেই চারদিকটায় কি যেন একটা ঘনিয়ে ওঠে। অশরীরী কিছু ? কেন যেন মনে হতে থাকে, কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে, অন্ধকারে তাকে তীব্র চোখে লক্ষ করছে, দাঁতে দাঁত পিষছে । | মামরে যাওয়ার পর থেকেই তার এটা হয়েছে। কুইনসের বাড়িতে এরকম হতে থাকায় সে বড় বাড়ি বিক্রি করে মফস্বলে চলে এল। কিন্তু লাভ হল না। 

কে যেন বলে উঠল, ওরে বাবা! 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

কে! চমকে উঠল পরাগ। হৃৎপিষ্ঠ দুম দুম করে পাঁজরায় ঘা মারছে। জলতেষ্টা। মাথায় ঘূর্ণিঝড় । কে! কিছুক্ষণ স্তম্ভিতের মতাে বসে থাকার পর সে হঠাৎ টের পেল, যা সে শুনেছে তা তার নিজেরই কণ্ঠস্বর ।। 

সে কি একা কথা বলছে আ ল ? 

নিজের মাথা দুহাতে চেপে ধরে পরাগ ? অন্ধকার তার ভাল লাগে না। কিন্তু আলােও কি লাগে ? একা থাকতে ভাল লাগে না। কিন্তু লােকজনও কি সহ্য হয়? 

একাজের জন্য এদেশে ফলাও ব্যবস্থা আছে। টেলিফোন করলেই একজন কম্পানিয়ন চলে আসবে। ছেলে বা মেয়ে । ঘন্টাওয়ারি হিসেবে পয়সা নেবে। তারা নানা ছলাকলা জানে। নিঃসঙ্গ কোন মানুষকে কি ভাবে সঙ্গ দিতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে তাদের। আর শরীর! পরাগ শুনেছে, শরীরের ব্যাপারে তাদের মতো জ্ঞানী ও দক্ষ বিশেষ নেই। 

এই ভুতুড়ে বাড়িতে একা থাকার চেয়ে একজন পাকা তাল নয় কি? পরাগ নেবার ভেবেছে একজন ভাড়াটে নেবে। এই মফস্বলে ভাড়াটে ভােটানাে মুশকিল। জুটলেও ভাল লোক হবে কিনা কে জানে ! আর ভাড়াটে এলেই যে তার সমস্যার সমাধান হবে তাও নয়। 

কিন্তু এত কথা এখন ভাবতে অর ভাল লাগছে না। তার কভেড়া এক অতলান্ত ভয়, সে এক কথা কইছে কেন? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? 

রময় পায়চারি করল পরাগ। পায়চারি করতে করতেই শুনতে পেল কে যেন বিড় বিড় কথা কইছে, আই হেট ইউ! আই ডেসপাইজ ইউ! আত্মহত্যা করতে পারে। না? খুব ইজি। ড্রাগ! কী হবে অত ভেবে? শুরু করে দাও। | হ্যা, নিঃসন্দেহে সে নিজেই কথা কইছে। কিন্তু টের পাচ্ছে না। কথা বেরিয়ে যাচ্ছে মুখ দিয়ে । 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

এ যেন দুটো মানুষ। একজন শুনছে, একজন কইছে। 

পেটের মধ্যে একটা ঘুরপাক খাচ্ছে যেন হঠাৎ? মাথাটা ফার্নেশের মতাে গরম লাগছে কেন? ঘাম হচ্ছে। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে বেসিনে উপুড় হল সে, অম্বল সমেত দুধটা হড় হড় করে বেরিয়ে গেল । 

সমস্ত বাড়ির বাতি জ্বালিয়ে দিল পরাগ। তারপর আবার সব বাতি নেবাল। গুল, উঠল, ফের 

এভাবে চলে না। চলছে না। এক একটা রাত যে কিভাবে কাটে তার। একজন সঙ্গী চেয়ে দেখবে? | ডাইরেকটরি খুলে নম্বর বের করে ডায়ল করল সে। অল্পবয়সী একটি মেয়ে চাইল। তারপর 

অপেক্ষা করতে লাগল চুপচাপ । দেখা যাক, যদি অন্যরকম কিছু হয় ।। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *