হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় -(পর্ব-২৮)

এরকম কথােপকথন কয়েকদিন আগে এক সন্ধেবেলা শর্মিষ্ঠার ফ্লাটে দুজনের মধ্যে ঘটে গিয়েছিল। জীবনে এরকম মানসিক ধাক্কা খুব কমই পেয়েছে তােতন । শর্মিষ্ঠা কি পরাগকে এভাবে শেষ করতে চায়? চাওয়া কি উচিৎ। ত্রিশ হাজার ডলার ওকে একথায় দিয়ে দিল পরাগ! তারপর? 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়শর্মিষ্ঠাকে সত্যিই বিয়ে করতে চেয়েছে তােতন । মনে মনে সে স্থির করে রেখেছে এরাই পনি থেকে তুমিতে নেমে একদিন নিরালায় প্রস্তাবটা করে যাবে। তাদের দুজনের মধ্যে একটা তড়িতবলয় তাে রয়েছেই। দুজনেই কি সুখে দুঃখে পাশাপাশি হাটেনি! এখনও পরস্পরে দেখলে তারা কত খুশি হয়! ডিভাের্স হয়ে গেলে তারা দুজনে বিনা আড়ম্বরে একটু চুপি চুপি বিয়েটা সেরে ফেলবে। 

কিন্তু সেই সন্ধের পর মাথায় ঝড় উঠল। কেন শর্মিষ্ঠা পরাগকে শেষ করতে চাইছে? কেন ততদূর নিষ্ঠুরতা করবে শর্মিষ্ঠা! যদি আমেরিকায় গিয়ে ডিভাের্সের মামলা আনে তাহলে পরাগকে আর নিউ জার্সির বাড়ি থেকেই উৎখাত হতে হবে। সেই বাড়ি বােধ হয় যাবে শর্মিষ্ঠার দখলে।একজন নিঃশেষিত লােককে আর কত যন্ত্রণা দেওয়া যায়? 

সেই রাত্রিটায় ঘুম হলাে না তােতনের । মাথা এত গরম হল যে মাঝরাতে উঠে স্নান করল সে। হাদময় পায়চারি করল । কিছুই ভাবতে পারলনা। শুধু তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে তাবল, এ জন্মটা কেন হল আমার বলাে তো? না হলেই ভাল ছিল। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

তােতনের এই এক সমস্যা। বাইরে তার তেমন প্রকাশ নেই, কিন্তু সামান্য আঘাত, সামান্য অপমান, সামান্য আদর, সামান্য নিষ্ঠুরতায় তার ভিতরে ভিতরে অবিরল রক্ততরণ হতে থাকে। ব্যথিয়ে ওঠে বুক। আর কাউকে নয়, তখন নিজেকেই তার কঠিন শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে। 

ভূগ্রস্তের মতাে সে ছাদ থেকে নেমে এল। তার মাথায় ঝড়ো হাওয়া এসে পাপছে। গুলিয়ে যাচ্ছে বুদ্ধি। গুলিয়ে যাচ্ছে কান্ডজ্ঞান। শর্মিষ্ঠাকে সে যদি বিয়ে করে, তারপর একদিন শর্মিষ্ঠা যদি তা ওপরেও কোনও কারণে ক্ষেপে ওঠে তাহলে কতদূর যাবে সে? 

অসহায়ের মতো, নাবালকের মতাে সে মা আর বাবার ঘরের বন্ধু কপাটের বাই এস দাঁড়াল নিশুত রাতে। 

না! মাগো ! জ্যোৎস্না সাড়া দিলেন না। 

মা গো জোগ আছে? 

, জো ভেঙ্গে নেই। তো ।জের ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইল : ঘুমহীন, বিষন্ন, করুণ । 

দুদিন বাদে সে আর একবার শর্মিষ্ঠাকে নিরস্ত করতে গিয়েছিল। শর্মিষ্ঠা, এরকম করবেন না। আপনি আপনার জীবন নিয়ে থাকুন। শেমার পাগ। হঠাৎ কেন পরাগের জন্য আপনি এত অস্থির হচ্ছেন? 

পরাণের জন্য নয়। পরীণ নিমিত্ত মাত্র। আমি আপনার নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে পারবাে না। 

শর্মিষ্ঠা তার দিকে গভির চোখে চেয়ে পঢ়ি গলায় বলল, আমি জানি তােতন, আপনি আমাকে– । আর আমার কথা কী বলব? যদি আমার জীবনটা এরকম নষ্ট না হত তাহলে কত সহজভাবে আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলতাম। কিন্তু এবার আপনি আমাকে একটু বুঝবার চেষ্টা করুন। পরাগকে আমি নিজের পারসােনাল কারনেই শুধু শেষ করছি না। আমি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। এমন একটা একজামপল যা থেকে ওরকম কাপুরুষরা শিক্ষা নিতে বাধ্য হবে। 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

কেন যে শর্মিষ্ঠা এই ঘােষনার পরেই হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল কে জানে। কিন্তু তােতনের মাথার মধ্যে ভূতের আঙুল নড়তে লাগল । বুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে । গুলিয়ে যাচ্ছে চিন্তাশক্তি পারম্পর্য। 

শর্মিষ্ঠা! শর্মিষ্ঠা ! অনেকক্ষণ বাদে শর্মিষ্ঠা দরজা খুলে বেরোলো। থমথমে মুখ। কি বলছেন তােতন? আমার মনটা ভাল নেই শর্মিষ্ঠা। 

জানি। আপনি আমার অ্যাটিচুড দেখে খুশি হচ্ছেন না। আপনি বড় নরম মনের মানুষ। খুব ইমপ্র্যাকটিক্যালও বটে। আমি আপনাকে জলের মতাে বুঝতে পারি। কিন্তু আপনি যে কেন আমাকে বােঝেন না! 

আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না আজকাল। আই কিউ কমে যাচ্ছে। 

তা নয় তােতন। জীবনের কঠিন দিকগুলাে তাে আপনি দেখেন নি । পরাগ যখন আইস পিক দিয়ে আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, যখন গলফ স্টিক বা টেনিস র্যাকেট দিয়ে মেরে ছি। তন 

আমিও জীবনের কঠিন দিকগুলােকে প্রথম দেখলাম। 

আপনি কি কিছুই ভােলেন না? 

ভােলা কি সােজা কথা তােতন? ভুলবার জন্যইতাে এত আয়োজন আমার। আপনি ভাববেন না, লক্ষীটি, আমি কিন্তু বরাবর এরকম থাকবাে না। আমি এরকম নই। আমি ভীষণ আদূরে, ভীষণ নরম, ন্যাগিং, ফা-লাভিং লাভ-লাভিং। আমি এরকম নই তােতন। কিন্তু আই মাস্ট এলিমিনেট পরাণ । | শর্মিষ্ঠা, আমি যদি আপনাকে খুব খুব ভালবাসি, সব ভুলিয়ে দিতে পারি, তাহলে কি পরাগকে উপেক্ষা করতে পারবেন না? 

হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

আপনি আমাকে খুব ভালবাসেন এই একটা আশা নিয়েই তাে বেঁচে আছি। আজ তােতন না থাকলে আমি কবে ড্রেসে যেতাম । শূন, আমি আপনার সঙ্গেই আমেরিকা যাবাে। ডেট ঠিক করে আমাকে জানাবেন। 

তােতনের অস্থিরতা কাটল না। সে আজ বুঝতে পারহে ঠাৎ, শর্মিষ্ঠাকে সে তীব্রভাবে ভালবাসে। কিন্তু তীব্রতার মধ্যে জ্বালাও আছে। যজ্ঞ জ্বালা। কারণ সে এটাও বুঝতে পারছে, তার মতাে বাস্তবােধ বর্জিত, ভাবা, বি ও আত্মমুখী মানুষের সঙ্গে শর্মিষ্ঠার কোথায় যেন একটা অমিল, শর্মিষ্ঠার অনেকটাই সে বুতে পারছে না। 

দুদিন বাদে শক্ষিায় ফ্ল্যাটে নিতি-নির্বিটের মতাে চলে গেল তােতন। যেন এক সন্মােহন তাকে বিরল টান।ে সে কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারে না ওই মামার টান। 

এক ভীষণ আখালু চেহারা নিয়ে শর্মিষ্ঠা স্তব্ধ ও অনড় বসে রইল কিছুক্ষণ তার সামনে। ভারপর দুর্বল গলায় বলল, আপনি কতদিন হয় এসে তােতন? 

দু’মাস। আরও হয়তাে মাস খানেক থাকতে পারে। আপনি আসার আগে আমেরিকায় কোনও ঘটনার কথা শুনে আসেন নি? আমেরিকার সর্বদাই ঘটনা ঘটছে শর্মিষ্ঠা। কী নব ? আমি পরাপের কথা বলছি। 

রা! তােতন হঠাৎ অজানা আশঙ্কায় কেপে উঠ বলে, কী হয়েছে পরাগের? ইজ হি ডেড?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *