না, তা নয়। আজকাল তাকে এক নির্বিকারত্ব পেয়ে বসেছে। একটু উদাসীনতাও। আজকাল সে সাধু-সন্যাসী হওয়ার কথা ভাবে। আর মাঝে মাঝে বিষণ্ণতায় ভরে থাকে মন। নিঃসঙ্গ লাগে, আবার নিঃসঙ্গতাই ভাল লাগতে থাকে। ভাল বিষও কি লাগে না? খুব দীন হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এর নিরহংকার হয়ে। খুব বিন হতে ইচ্ছে যায়। খুব গরিব ও মহৎ হতেও।
এসব মিশিয়ে একটা ককটেল করলে কেমন হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই তার। যাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে লােক নামিয়ে এবং তুলে, বড় নদী ছেড়ে, ছােটো নদী ধরে ভটভটি এগোচ্ছে শব্দের সন্ত্রাস ছড়াতে ছড়াতে। আমরা কোথায় নাববাে রতন?
আজ্ঞে তহাবিলি ঘাট। সেখানে ভ্যানগাড়ি রাখা আছে। পাকা রাস্তা । হ্যা, হাৰিলি ঘাট নামটা কয়েকবার শুনেছে বটে তােতন ওদেরই মুখে ! সেখানে নেমে কোরাকাঠি অল্প একটু হাঁটাপথ। অল্প মানে কত? রতনের মতে আধঘন্টা বা মেরেকেটে পঁয়ত্রিশ মিনিট । বাসুর মতে, তা মিনিট দশেক লাগতে পারে। এদের কারােই যে সম্পর্ক কোনও বােধ গজায়নি তা বুঝতে লহমাও দেরি হয় না। বাদার জীবনে তাদের ঘড়ির দরকার বা কি? কোন আহাম্মক বাদায় বসে ঘন্টা মিনিট সেকেভের হিসেব কষ্টে আয়ুক্ষয় করবে! সূর্য উঠলে দিদন শুরু, সূর্য ডুবলে শেষ- এইটুকু জানলেই বহত।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
রতনের একটু শহরে পলিশ আছে ওর মধ্যেই। তােতনের দাদার অফিসে আগে সুন্দরবনের মধু বেচতে আসত মাঝে মাকে। নােটনের সঙ্গে সেই থেকে চেনা অফিসে যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি নােটন এই কদিন হল রতনকে সে-ই চাকরি দিয়েছে। রতনের কাছে এখন নােটন মা-বাবা।
যােগাযােগটা কিছু অদ্ভুত। শর্মিষ্ঠাকে তার কলকাতার ফ্ল্যাটে পাওয়া গেলে এতদূর ছুটতে হত না তােতনকে। শর্মিষ্ঠার অ্যাপার্টমেন্টের হাউসে খবর পেল, সে সন্দেশখারি কোরাকাঠিতে বাপের বাড়ি গেছে। কবে ফিরবে টিক নেই! কোথায় কোরাকাঠি কোথায় সন্দেশখালি কিছুই জানে না চেতন। শুনে তার সাদা নোটন বলল, দাঁড়, সুন্দরবনের একটা ছেলে আছে। সেই ঠিক জানে। পরদিনই রতন এসে হাজির, কোরাকাঠি! সেখানে আমাদের দেবেল। যাতায়াত। কাছেই। অন্তপুর থেকে মাত্র কয়েক মাইল । আমি নিয়ে যাবেন।
সে-ই আসা। শমির বাবা পরিতােষবাবু আতাপুর হাইস্কুলের মাস্টারমশাই । শুধু মাস্টারমশাই নন, তাঁর নাট অঞ্চলে বেশ বিষয় সম্পতি আছে। সুদে টাকা খাটানাের ব্যবসা আছে। ভ্যানগাড়ি এবং ভটভটিও আছে। বেশ ভাল অবস্থা, বাদার বড়লােক বলতে যা বােঝায়। ধামাখালির দিকে একখানা মাছের ভেরি কেনারও তালে আছেন ।
বিষয়ী লােকদের বিশেষ পছন্দ করে না তােতন। শমিষ্ঠার বাবা বিষয় বলেই কি-? না, পাকগে, এই উদাসী নদী পাড়ি দিতে দিতে ওসব চিন্তা করাও বোধহয় ভাল নয়।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
রতন, আমার ব্যাগটা। কোনও ভয় নেই দাদা, ব্যাগ আমার কাঁধে।
তােতন কোরাকাঠি আসবে বলে রতন শুক্রবার এসে একবার দেশ থেকে ঘুরে গেছে। রাস্তাঘাই ঠিকঠাক আছে কিনা, ভ্যনগাড়ি পাওয়া যাবে কিনা, কোন সময়ে এলে সুবিধে হবে ইত্যাদি। তবে বুদ্ধি করে শমিঠকেও তর আসবার খবরটা যদি দিয়ে আসত তাহলে একটুও টেনশন থাকত না তােতনের। সে যদি কোরাকাঠি গিয়ে শােনে যে, শমিঠা আজই রওনা হয়ে গেছে কলকাতায়?
হারে তত পেট পুড়ায় রতনে তবু একটু পালিশ আছে । বাসু নিতান্তই আকাড়া। আতাপুর থেকে বাদুকে জুটিয়ে নিন গােছে রতনই । যাতে দুজনে মিলে তােতনে দেখভাল করতে পারে। তানের খুব ইচ্ছে আজকের রাতটা তােতন তাহাপুরে তালে বাড়িতে থাকুক। রত মুগ, গায়। অহ কিফার লোভ দেখিয়ে লেখেছে : গােলেই হয়।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
রতন আর বাসু দুজনেই পরিতােষবাবুকে ভালই চেনে। দুজনেই আতাপুর হাই স্কুলে পড়েছে। তবে যাঁ, পরিতোষবাবুর ছােটো মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে তারা ভাল চেনে না। দেখেনি কখনও। তবে তারা শুনেছে বটে, পরিতােষবাবুর ওরকম একটি মেয়ে আছে। দুঃখী মেয়ে। তার বেশী কিছু তারা জানে ।
ভাগ্যিস জানে না। | সময় বিশেষ নেই। নইলে কলকাতায় শমিষ্ঠার ফিরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত। তবে এও কিছু খারাপ হল না। সে তাে আউটিং চেয়েছিল। এও একরকম আউটিং। খারাপ কি? আজ সে ক্রিটিক্যাল চোখে কিছুই বিচার করছে না। ধামাবালির আরশাদ মিঞার ঘাট থেকে শুরু করে এই যা দেখছে সবই যেন তার পূর্ব পূর্ব নানা জন্মের চেনা জায়গা ? শুধু স্মৃতির ফ্লাডগেট খুলছে না। খুললে হাজার জনের স্মৃতির তােড়ে ভেসে যেত তােতন। কিন্তু বন্ধু অৰ্গলে ঘা লাগছে বড়। এক জন্যে কী সুখ? জন্ম জন্মান্তরে ছড়িয়ে না পড়লেই এই মন্মের এই ক্ষুদ্রত্ব নিয়ে থাকে কি করে তােতন? | দাদা, এস গেলুম যে। ওই, এই হাবিলি ঘাট । বউড কাদা এখানে, নাববেন না যেন। আমরা কাঁধে করে নামিয়ে নেবাে।