অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

হাতি আনতে লােক গেল হালুয়াঘাটসেখানে কালুশেখের দুটি মা এত আছেবন থেকে কাঠের বােঝা টেনে নামায়বিয়ের আগের রাতে মাহুতকে ঘাড়ে করে মাতু এসে দাঁড়াল

অচিনপুর

উৎসাহী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের পাহাড় বানিয়ে ফেল উঠোনেমাহুতের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলার জন্যে কী আগ্রহ সবারমাহুত সাহেবের কি একটু তামাক ইচ্ছে করবেন

হাতির পিঠে চড়ে বর এসে নামললােকে লােকারণ্যভিড়ের চাপে গেট ভেঙে পড়ে, এমন অবস্থাজরির মালায় বরের মুখ ঢাকাকিছুই দেখা যাচ্ছে নাকলমা পড়ার আগে জরির মালা সরান হবে নাসেও রাত একটার আগে নয়বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে বর বন্ধুদের নিয়ে সিগারেট খেতে গেল বাইরেঅমনি হৈহৈ করে উঠল সবাইদেখেছি! কী রং! যেন সাহেবদের রংরাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে যেন। 

লিলিরও বিয়ে হল এই বাড়িতেদশপনের জন বন্ধু নিয়ে রােগামতাে একটি ছেলে বসে রইল বাইরের ঘরেনিতান্ত দায়সারা গােছের বিয়েভালাে ছেলে পাওয়া গেছে, এই তাে ঢেরতাছাড়া গয়নায়নাও তাে নেহায়েত কম দেওয়া হয় নিমায়ের গলার হার, হাতের গাছা চুড়ি, নানিজান দিলেন কানের দুল, ছােট নানিজান নাম লেখা আংটিকবুল বলতে গিয়ে লিলি তবু কেঁদেকেটে অস্থিরনানাজানের প্রবল ধমকের এক ফাঁকে কখন যে কবুল বলেছে তা শুনতেই পেল না কেউ। 

মাইল পালকি করে গিয়ে ট্রেনট্রেন পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে আসব আমি আর নবু মামাবেডিংপত্তর নিয়ে দুজন কামলা আগে আগে চলে গিয়েছেপাকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না, বারবার পিছিয়ে পড়িনবু মামা বললেন, পয়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, আমি জুতা খুলে ফেললাম। 

অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

সজনেতলা এসে পাকি থামলবেহারারা জিরােবেপানতামুক খাবেলিলি পালকির ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকল, দুষ্টামি করবি না তাে রঞ্জু

আমার জন্য কাঁদবি না তাে? না, কাঁদব না‘ 

কাঁদবি না কিরে গাধা? বােনের জন্য না কাঁদলে কার জন্য কাঁদবি? আমার কি আর কেউ আছে?” 

ট্রেন ছেড়ে দিল। 

এই বাড়ি বাড়ি করে ট্রেন দ্রুত সরে যাচ্ছেনবু মামা কাঁদছেন হুহু করেবেহারা এসে বলল, দু জনে এসে বসেন পালকিতে, ফিরিয়ে নিয়ে যাই। 

লিলিকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসে আমার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেলমনে হল কিছু কিছু চিরন্তন রহস্য যেন বুঝতে পরছি। 

১৭১ 

আশ্বিন মাস আসতেই সাজ সাজ পড়ে গেল স্কুলে। 

স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীগান আবৃত্তি তাে হবেই, সেইসঙ্গে নাটক হবে স্টেজ বেঁধেহিরণ্য রাজানাটকের নামহিরণ্য রাজার পার্ট করেছেন বাদশা মামাউৎসাহের সীমা নেই আমাদেরখালারাও ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলেন নাটক দেখবার জন্যেমেয়েদের জন্যে পর্দাঘেরা আলাদা জায়গা করা হয়েছেবাড়ির মেয়েরা আগে কখনাে নাটকফাটক কিছুই দেখে নিদেখবার শখ খুবছােট নানি আর্জি নিয়ে গেলেন নানাজানের কাছে। 

সব কি দেখবে? না, নাবলে প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি তুললেও শেষের দিকে তাঁকে কেমন নরম মনে হলসুযােগ বুঝে নানিজান বলে চলছেন, এক দিনের মােটে ব্যাপারআমােদআহ্লাদ তাে কিছু করে না। 

নাকরে না! রাতদিনই তাে আমােদ চলছেআচ্ছা যাক, পাকি করে যেন যায়। 

স্কুলঘরে স্টেজ সাজান হয়েছেহ্যাজারে আলােয় ঝলমল করছে চারিদিকহ্যারিকেন হাতে নিয়ে গ্রামের লােকজন আসছে কাতারে কাতারেপর্দায় আড়াল করা মেয়েদের জায়গায় তিল ধারণের ঠাঁই নেইআমি আর নবু মামা বসেছি মেয়েদের সঙ্গেছােট নানি আর দুখালা চাদর গায়ে চুপচাপ বসে আছেননাটক শুরু হতে হতে রাত হয়ে গেলবাদশা মামা সেজেছেন হিরণ্য রাজা! এমন মহান রাজাদীনদুঃখীদের জন্য সমস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেনদুশ্চরিত্র মন্ত্রী ঘোঁট পাকাচ্ছেতলে তলেরাজা আপনভােলা মানুষ, কিছু জানতেও পারছেন নামন্ত্রমুগ্ধের মতাে দেখছি সবাইএকসময় হিরণ্য রাজা মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেনরানীও চলেছেন তাঁর পিছু পিছুনানিজান চমকে বললেন, মেয়ে কোথেকে এলকার মেয়ে

অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

হচ্ছে হারু দাদা, মেয়ে সেজেছে। 

ওমা, হারু নাকি! নানিজানের চোখে আর পলক পড়ে নাবিবেকের পার্ট করল আজমলখালারা কাঁদতে কাঁদতে চাদর ভিজিয়ে ফেললশেষ দৃশ্যে হিরণ্য রাজা মন্ত্রীকে বলছেন– 

এই রাজ্য তুমি লও ভাইকাজ নাই রাজ্যপাটে আমি বনবাসে যাব। 

সেইখানে শান্তি আপারছােট খালা বললেন, বেকুবটা মন্ত্রীকে মেরে ফেলে না কেন? মন্ত্রী বলছে, দ্বন্ধযুদ্ধ হােক রাজা, বৃথা তর্কে কোনাে ফল নাইঝনঝন যুদ্ধ। 

শুরু হয়ে গেলনবু মামা উত্তেজনায় দাড়িয়ে পড়লেননানিজান পেছনে থেকে চেচাচ্ছেন ‘ও নবু বস, দেখতে পাচ্ছি নাবসে পড়কী তীব্র উত্তেজনারাজার মৃত্যুতে সবার চোখে জলবাদশা মামার জয়জয়কারকী পার্টটাই না করলেন

নানাজানও যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় দেখবেন, তা কেউ ভাবি নিপাকিতে খালারা উঠতে যাবে, এমন সময় তিনি এসে হাজিরবাদশা তাে বড়াে ভালাে করেছেএই বলে পালকিতে ওঠবার তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন হেডমাষ্টার সাহেবের বাড়িসেখানে তাঁর রাতের দাওয়াত। 

অচিনপুর পর্ব (৪)- হুমায়ূন আহমেদ

বাড়ি গেয়ে দেখি মেহমানে বাড়ি ভর্তি, নান্দিপুর থেকে নানাজানের ফুপাতাে বােন এসেছেন ছেলেমেয়ে নিয়েসকাল সকালই পৌছতেন, নৌকার দাঁড় ভেঙে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছেআমি আর নবু মামা অবাক হয়ে গেলাম মেহমানদের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখেনানাজানের ফুপাতাে বােনের বড়াে মেয়েডাকনাম এলাচিএমন সুন্দর মানুষ হয়

দুমাসের ভেতর এলাচির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বাদশা মামারআপাত কার্যকারণ ছাড়াই যেসমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটে তাই কেমন করে পরবর্তীসময়ে মানুষের সমস্ত জীবন বদলে দেয়, ভাবতে অবাক লাগে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *