অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

 ‘অনেক রকম বাছাইয়ের পর আপনাকে আলাদা করা হয়েছে । এক সপ্তাহের মতো সময় আপনার হাতে আছে। এই সময়ে আপনাকে নিয়ে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা হবে। হাইপার স্পেস ভাইভ দেয়ার মতাে শারীরিক যােগ্যতা আপনার আছে কি না দেখা হবে। তারপর যাত্রা শুরু। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

‘ফিরে আসব কবে ? 

কখন ফিরবেন এই ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। একটি হাইপার স্পেস ডাইভের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বয়স প্রায় একশ’ বহুর বেড়ে যায়। ধরুন, তিনটি হাইপার স্পেস ভাইভ দিয়ে আপনি পৃথিবীতে ফিরলেন। ফিরে এসে দেখবেন পৃথিবীর বয়স তিনশ’ বছর বেড়ে গেছে। হয়তাে পৃথিবী কোনাে প্রাকৃতিক কারণে ধ্বংসই হয়ে গেছে। কাজেই ফিরে আসার সময় জানতে চাওয়া অর্থহীন। আমি অবাক হয়ে এই লােকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বলছে সে । এর মানে কী! 

কত বড় সৌভাগ্য আপনার ভেবে দেখুন। আপনি হবেন মানবজাতির প্রথম প্রতিনিধি দলের একজন, যে অন্য একটি গ্যালাক্সিতে পা রাখবে। 

কী হবে পা রেখে ? 

‘অনেক কিছুই হতে পারে । হয়তো অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন কোনাে প্রাণীর সঙ্গে আপনাদের যােগাযােগ হবে। তাদের কল্যাণে আমরা সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যগুলি জেনে ফেলতে পারব । সময় ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি না। তারা হয়তো আমাদের সময় ব্যাপারটা কী, বুঝিয়ে দেবে। আমরা তখন ইচ্ছামতাে সময়কে সংকুচিত ও প্রসারিত করতে পারব। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

‘আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি আর কোনােদিন এই চেনা পৃথিবীতে ফিরে আসব ?” ‘হ্যা তাই। 

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে এই ঘর থেকে বের করে আলাদা করে ফেলা হল। আমি কত জনকে যে বললাম, আমাকে একটা টেলিফোন করতে দিন। একজনের সঙ্গে একটু কথা বলব ? ঘড়ি ধরে এক মিনিট । এর বেশি নয়। 

কেউ আমার কথার কোনাে উত্তর দিল না। একজন শুধু বলল, “সপ্তম কেন্দ্রের গবেষণাগার থেকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যােগাযােগের কোনাে ব্যবস্থা নেই। 

নিকির সঙ্গে আমার কথা বলা হল না। 

সময়ের কোনাে হিসাব আমার কাছে ছিল না। গবেষণা কেন্দ্রের যেখানে আমাকে রাখা হল, দিন এবং রাত বলে সেখানে কিছু নেই। সারাক্ষণই কৃত্রিম আলো জ্বলছে। আমাকে বলা হল মানুষের শরীরে দিনরাত্রির যে-চক্র তৈরি হয় তা ভেঙে দেবার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাদের কোনাে কথাই আমি মন দিয়ে শুনি না। যা করতে বলে করি, এই পর্যন্তই। 

একবার তারা আমাকে একটা সিলিন্ডারের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এ জাতীয় অন্ধকার পৃথিবীতে কখনাে পাওয়া যায় না। অন্ধকার যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কত সময় যে কেটে গেল সেই সিলিন্ডারে। কী ভয়াবহ অবস্থা ! প্রচণ্ড খিদে, তবু মনে হয়েছে খাদ্য নয়, আমার প্রয়ােজন আলাে। সামান্য আলাে। প্রদীপের একটি ক্ষুদ্র শিখার জন্যে আমি আমার নশ্বর জীবন দিয়ে দিতে পারি।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

কিন্তু আলাে ভৗগাে জোটে নি। খাদ্য এসেছে, আলো নয় । আশ্চর্য, এক সময় সেই অন্ধকারও সহ্য হয়ে গেল। মনে হল আলােহীন এই জগই-বা মন্দ কি। যখন পুরােপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম তখন আমাকে চোখ ধাধানাে আলােয় ঝলমল করছে এমন একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আহ কী তীব্র আলাে ! প্রাণপণে চেঁচিয়েছি, ‘আলাে চাই না, অন্ধকার চাই। কুৎসিত এই আলোর হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। 

কত বিচিত্র ধরনের ট্রেনিং 1 ভরশুন্যতার ট্রেনিং, শব্দহীন জগতের ট্রেনিং, আবার ভয়াবহ শব্দের ট্রেনিং। 

তারপর একদিন ট্রেনিং পর্ব শেষ হল। আমাকে গােলাকার একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আমার সঙ্গে গবেষণাগারের একজন কর্মী। ঘরটির মাঝখানে ছােট্ট টেবিলে একটা টেলিফোনের সেট। 

গবেষণাগারের কর্মী আমাকে বললেন, এখন আপনি আপনার বান্ধবীকে একটা টেলিফোন করতে পারেন। নাম্বার মনে আছে তাে, নাকি ট্রেনিংএর ঝামেলায় সব ভুলে বসে আছেন ?’ 

নাম্বার মনে আছে।‘ 

নিকিকে তার বাসার নাম্বারেই পাওয়া গেল। সে অসম্ভব অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার তােমার ? 

আমি বহু কষ্টে বললাম, তোমার কী খবর? তুমি কেমন আছ? নিকি রাগী স্বরে বলল, আমার খবর তােমার কী দরকার ? তুমি তােমার খবর বল। ইচ্ছেটা কী ? 

আমাকে একটা মহাকাশযানে করে পাঠানাে হচ্ছে। 

কী বলছ তুমি এসব ! সত্যি কথাই বলছি নিকি।আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’ ‘আমিও বুঝতে পারছি না।’ 

প্রায় দশ মিনিটের মতাে কথা বললাম। নিকি ব্যাকুল হয়ে কঁাদল। আমার চোখও বারবার ভিজে উঠল। এক সময় টেলিফোন নামিয়ে ব্রাখলাম। আমার সঙ্গী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভার চোখে চোখ রেখে একটু হেসে বললাম, ‘এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বললাম, সে নিকি নয়। সে আপনাদের একজন। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৩)- হুমায়ূন আহমেদ

আমার সঙ্গী বিস্মিত হয়ে বলল, “একথা কেন বলছেন ? তার গলার স্বর কি আপনার কাছে অন্য রকম মনে হয়েছে ? 

‘না, গলার স্বর নিকির মতাে। আচার-আচরণ, কথা বলার ঢং সবই নিকির মতো। তবু আমি জানি, সে নিকি নয়।‘ 

কখন জানলেন? ‘টেলিফোন নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে জানলাম । 

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। এতক্ষণ আপনি কথা বলেছেন একটি ভয়েস সিনথেসাইজারের সঙ্গে। 

আমার সঙ্গে এই রসিকতা করার প্রয়ােজনটা তাে ধরতে পারছি না। শুরুতে আমি নিকির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। পরে কিন্তু আর চাই নি। 

‘আমরা ছােট্ট একটা পরীক্ষা চালানাের জন্যে টেলিফোনের ব্যবস্থাটা করেছি। 

কী পরীক্ষা ?

মহাকাশযানে করে পাঠানাের জন্যে সব সময় স্বাভাবিক ক্রুদের বাইরে একজনকে নেয়া হয়। সেই একজন কিন্তু রাম শ্যাম যদু মধু কেউ নয়। সেই 

একজন হচ্ছে বিশেষ একজন । যার কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। ইএসপি জাতীয় ক্ষমতা। আপনার স্র প্রচুর পরিমাণে আছে। 

কী করে বুঝলেন ? ‘সেন্ট্রাল কম্পিউটার পৃথিবীর সব মানুষদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে। আপনার সম্পর্কে খবর সেখান থেকেই পাওয়া।’ 

‘খবরটা ভুল। আমার ইএসপি কেন, কোনাে ক্ষমতাই নেই। থাকলে আমি তা জানতাম। আমি জানব না, অথচ সেন্ট্রাল কম্পিউটার জানবে—তা কী করে হয় ? 

জন্মসূত্রে আপনি যেক্ষমতা নিয়ে এসেছেন তার কথা তাে আপনার জানার কথা নয়। তা জানবে অন্য জন। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, আপনি টিভি প্রােগ্রাম মনিটার করতেন। 

হ্যা, এটাই আমার চাকরি। ‘চ্যালেন গ্রির একটা প্রােগ্রাম আপনি মনিটার করছিলেন, তাই না? ‘হঁ্যা।। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *