অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

‘আমি কোনাে উদ্ভট কথা বলছি না। 

‘আপনি খুবই উদ্ভট কথা বলেছেন এবং তা বুঝতে পারছেন না। ইএসপি ক্ষমতা বা জাতীয় হাবিজাবি আমাকে বলতে আসবেন না। মহাকাশযান ইএসপি ক্ষমতার ওপর চলে না, চালে বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং তথ্যের ওপর।

অনন্ত নক্ষত্র বীথিআপনার জানা নেই যে এই মহাকাশযানের এক পার্স দূরত্ব পর্যন্ত যে কোনো জায়গার অতি সূক্ষ্মতম পরিবর্তনের হিসেবও রাখা হয়। ধরা যাক, কোনাে কারণে আমরা একটী নিউটন স্টারের কাছাকাছি চলে এলাম। নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হচ্ছে দানবীয় শক্তি, কিন্তু এই শক্তিও আমাদের কিছু করতে পারবে না। কারণ হাইপার স্পেস ডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি মহাকাশযানের আছে গ্র্যাভিটি ফ্লাস্ক তৈরির ক্ষমতা। এই গ্রাভিটি ফ্লাস্কের কারণে আমরা শুধু নিউট্রন স্টার নয়, ব্ল্যাক হােলের খপ্পর থেকেও নির্বিঘ্নে বের হয়ে আসতে পারি। এখন কি আপনার মনের অস্বস্তি দূর হয়েছে ? 

‘না।। 

‘এখনাে যদি অস্বস্তি দূর না হয়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। আপনি ডাক্তার রােবটের সঙ্গে যােগাযােগ করুন। সে আপনাকে ট্রাংকুইলাইজার ধরনের কিছু দেবে। তাই খেয়ে শুয়ে পড়ুন। 

আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। তার ঠিক সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরের নীলবাতি নিভে গেল।সেখানে জ্বলল হলুদ বাতি, যার মানে সতর্ক অবস্থা। হলুদ বাতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লালবাতি জ্বলল। লালবাতি মানে হচ্ছে বিপজ্জনক পরিস্থিতি । আমি নিশ্চিত জানি এই লালবাতি নিভে গিয়ে দুটি লাল বাতি জ্বলবে, 

যার মানে চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতারপর জুলবে তিনটি লালবাতি, যার অর্থ আমরা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন । 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

ইন্টারকমে কম্পিউটার সিডিসির ধাতব গলা শোনা গেল। সে অত্যন্ত স্পষ্ট করে যে সংবাদ দিল তা হচ্ছে 

‘বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আমরা অজানা একটি শক্তিশালী আকর্ষণী বলয়ের ভেতর পড়ে গিয়েছি। আকর্ষণী শক্তির ধরন, গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য আমাদের কাছে নেই বলে ঠিক এই মুহুর্তে কিছু করা যাচ্ছে না। তবে অতি দ্রুত তথ্যসগ্রহ করা হচ্ছে। মিশনপ্রধান জন বরগ একটি জরুরি সভা ডেকেছেন। স এক্ষুণি শুরু হবে। সেই সঙ্গে মিশন-প্রধান জন বরগ মহাকাশযানে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেছেন। আমার বক্তব্য শেষ হল। 

আমি সভাকক্ষের দিকে এগুলাম। ঘর ছেড়ে যাবার আগে শেষ বারের মতাে তাকালাম। আমি জানি এই ঘরে আর ফিরে আসব না। কেমন যেন মায়া লাগছে। অল্প কিছুদিন মাত্র কাটিয়েছি, অথচ তাতেই কেমন মায়া জন্মে গেছে। 

ঘরে লাল বাতি এখনাে জ্বলছে। একটি মাত্র ৰাতি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বাতিটি এখনো জুলে নি। তবে জ্বলবে। আমি তা রক্তের প্রতি কণিকায় অনুভব করছি। 

তিশ এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। সে বিষন্ন গলায় বলল, সভা শুরু হয়ে গেছে, আপনার যাওয়া দরকার। 

আমি হালকা গলায় বললাম, কী হবে সভায় গিয়ে ? তিশ ক্লান্ত গলয়ি বলল, মনে হচ্ছে কিছু হবে না। ঠিক তখন দ্বিতীয় লাল বাতিটি জ্বললএর মানে চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতি। 

জন বরগ শন্তুি মুখে বসে আছেন। তার চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই। যেন কিছুই হয় নি, তিনি সাধারণ একটি সভায় এসেছেন। রুটিন কাজ। এ-রকম একটি সভায় আমি আগে একবার উপস্থিত ছিলাম। সেই সভার সঙ্গে আজকের সভার আমি কোনাে প্রভেদ দেখছি না। উদ্বেগের কিছু ছাপ আমি ইনাের চোখেমুখে দেখছি। সে দ্রুত চোখের পাতা ফেলছে, কিছুক্ষণ পরপর ঢােক গিলছে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

জুন বরগ কথা বলা শুরু করলেন। শান্ত স্বর। আমি মনে মনে এই মানুষটির সাহসের প্রশংসা করলাম। এই মানুষটির স্নায়ু খুব সম্ভব ইস্পাতের তৈরি। 

বন্ধুগণ, দুটি লালবাতি জ্বলেছে কাজেই পরিস্থিতি কী সেই ব্যাখ্যার কোনাে প্রয়ােজন দেখছি না। তবু কিছু ব্যাখ্যা করছি, কারণ এই মুহুর্তে আমাদের কিছু করার নেই। এই মহাবিপদে আমাদের যারা সাহায্য করতে পারে তারা ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছে। তারা হচ্ছে সেন্ট্রাল কম্পিউটার সিডিসি-১০ এবং সাহায্যকারী 

কম্পিউটার সিডিসি-৭, জরুরি পরিস্থিতির কারণে হিসাব-নিকাশের কিছু অংশ তিশ-১০০ রিজার্ভ কম্পিউটার করে দিচ্ছে। 

‘ব্যাপারটা কি হল বলি । আমরা হঠাৎ করে একটা অকল্পনীয় আকর্ষণীয় শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পড়ে গিয়েছি। এই আকর্ষণী শক্তির উৎস কোথায় আমরা জানি না। শুরুতে মনে হচ্ছিল আমরা একটি কৃষ্ণ গহ্বরে পড়ে গেছি। কিন্তু এটি কৃষ্ণ গহর নয়। আমাদের চারপাশে কিছুই নেই। অথচ এই মহাশুন্য অতি তীব্র শক্তিতে আমাদের আকর্ষণ করছে। শক্তির পরিমাণ ১০১১ থেকে ১০২৭G, সমুদ্রতরঙ্গের মতাে এটা বাড়ছে এবং কমছে। মনে হচ্ছে আমরা একটা স্পাইরেলের ভেতর ঢুকে পড়েছি। এবং সােজাসুজি অগ্রসর হচ্ছি । স্পাইরেলের এক একটা বাহুর কাছাকাছি আসামাত্র আকর্ষণী শক্তি বেড়ে যায়, আবার বাহু অতিক্রম করামাত্র কিছুটা কমে যায়।’ 

ইনে বলল, এর থেকে বেরুবার জন্যে আমরা কী করছি তা কি জানতে পারি? 

“অবশ্যি জানতে পারেন। আমি সিডিসি-৭কে সভা শুরু হবার আগেই বলে রেখেছি এই বিষয়ে কথা বলবার জন্যে। 

সিডিসি সঙ্গে সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। এর গলার স্বরে কোনাে ধাতব ঝংকার নেই। সে কথা বলছে অনেকটা পুরুষালি গলায়। মাঝে মাঝে থামছে । আবার শুরু করছে। থামাটা ইচ্ছাকৃত। আমাদের সমস্ত ব্যাপারটা আত্মস্থ করবার জন্যে সময় দিচ্ছে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

‘সম্মানিত অভিযাত্রী, খুবই দুঃসময়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। অল্প সময়ে আমি বক্তব্য শেষ করতে চাচ্ছি। সেই কারণে কোনাে কিছুই পুরােপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না। | ‘আমরা বেকায়দায় পড়ে গেছি, কারণ ব্যাপারটা আচমকা ঘটেছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী নিউট্রন স্টার কিংবা ব্ল্যাক হােল মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাকাশযানের অতি উন্নত সেনসর অনেক দূর থেকে তাদের অস্তিত্ব টের পায় এবং প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখানে তা সম্ভব হয় নি, কারণ আচমকা আমরা একটি স্পাইরেলের ভেতর পড়ে গেছি। এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কেন্দ্রবিন্দুর দিকে। 

‘এইসব ক্ষেত্রে মহাকাশযানের দিকপরিবর্তন করা হয় এবং শক্তিশালী গ্র্যাভিট্রন ফ্লাঙ্ক ব্যবহার করা হয়। দিকপরিবর্তন আমরা ঠিকই করতে পারছি, তবে গ্রাভিট্রন ফ্লাস্ক ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ অলটারনেটিং চৌম্বক ক্ষেত্রে গ্র্যাভিট্রন ফ্লাস্ক কাজ করে না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *