অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-১৮)

মিসির আলি মনে মনে তিন্নির সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। গত রাতে তুমি আসনি কেন? ইচ্ছা করছিল না। 

এসেও তাে কথা বলতে পারতে। তাও বলনি। ইচ্ছা করছিল না। 

এখন ইচ্ছা করছে? হ্যা করছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে। বল কথা বল।

অন্যভুবনআমি শুনছি। আমি এখন এখানকার গাছের কথা বুঝতে পারি। বাহ চমৎকার তাে। তাই রােজ সন্ধ্যাবেলায় বাগানে যাই। ওদের কথা শুনি। দিনের বেলা শুনতে পাও না? 

, দিনের বেলায় ওরা কোনাে কথা বলে না। চুপ করে থাকে। ওরা কথা বলে শুধু সন্ধ্যার দিকে। রাতে আবার চুপ করে যায়। ওরাতাে আর মানুষের মতাে না যে সারাদিন বকবক করবে । 

তাতাে ঠিকই। ওরা কী কথা বলে তােমার সঙ্গে? 

আমার সঙ্গে তাে কোনাে কথা বলে না। ওরা কথা বলে নিজেদের মধ্যে। আমি শুনি। 

কী নিয়ে কথা বলে? অদ্ভুত জিনিস নিয়ে কথা বলে। বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারি না । তবু বল। আমার শুনতে ইচ্ছা করছে। 

জীবন কী, জীবনের মানে কী এইসব নিয়ে তারা কথা বলে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে। 

তাই নাকি? 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ

হা। আর কথা বলে মানুষদের নিয়ে। পশুপাখিদের নিয়ে। এরা পৃথিবীর মানুষদের কথা জানে। এরা কী বলে কী করে এইসব জানে। মানুষদের নিয়ে ভাবে। 

বাহ, চমৎকার তাে। 

একটা গাছ যখন মারা যায় তখন সারাজীবন যা জানল তা অন্য গাছদের জানিয়ে যায়। মানুষদের যখন কষ্ট হয় তখন তাদের কষ্ট হয়। মানুষদের যখন আনন্দ হয় তখন 

তাদেরও আনন্দ হয়। 

মানুষ যখন একটা গাছকে কেটে ফেলে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে তখন তারা মানুষদের ওপর রাগ করে না? 

না। তারা রাগ করতে পারে না। তারা তাে মানুষের মতাে নয়। তারা শুধু ভালােবাসে। জানেন তাদের মনে খুব কষ্ট। 

কেন বল তাে? 

কারণ খুব শিগগিরই পৃথিবীতে কোনাে মানুষ থাকবে না। কোনাে জীব থাকবে । পৃথিবী আস্তে আস্তে গাছে ভরে যাবে। এইজন্যেই তাদের দুঃখ। 

মানুষ থাকবে না কেন? 

এরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাবে। এটম বােমা ফাটাবে। পৃথিবী ছাড়াও তাে আরাে অনেক গ্রহ আছে যেখানে একসময় মানুষ ছিল। এখন নেই। এখন শুধু গাছ। 

গাছদের জন্যে এটা তাে ভালােই, তাই নয় কি তিনি? শুধু ওরা থাকবে আর কেউ থাকবে না। 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ 

তিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল, তারপর মৃদুস্বরে বলল, না ভালাে না। ওরা সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়। সারাজীবনে ওরা যত জ্ঞান লাভ করেছে এগুলি মানুষকে বলতে চায়। কিন্তু বলার আগেই ম য শেষ হয়ে যায়। ওরা বলতে পারে না। এই জন্যে ওদের খুব কষ্ট। 

মানুষকে ওরা ওদের কথা বলতে পারছে না কেন? 

বলতে পারছে না কারণ মানুষতাে এখনাে খুব উন্নত হয়নি। ওদেরকে অনেক উন্নত হতে হবে। কিন্তু তা হবার আগেই তাে ওরা শেষ হয়ে যায়। 

এইসব কথা কি তােমার আশেপাশের গাছদের কাছ থেকে জানলে? 

অন্য গাছ আমাকে বলেছে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন ওরা বলে। তুমি যেসব গাছের ছবি আঁকো সেইসব গাছ? তিন্নি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। 

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। বুড়াে চাওয়ালা বলল, শইলটা কি অখন ঠিক হইছে? কাইল আবার আইসেন। 

না কাল আসতে পারব না। কাল আমি ঢাকা চলে যাব। আবার যখন আসব তখন কথা হবে। 

বরকত সাহেবের সঙ্গে দেখা হল চায়ের টেবিলে। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। ভালােমতাে চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে মিসির আলির ওপর বেশ বিরক্ত। মিসির আলি এই বিরক্তির কারণ ঠিক ধরতে পারলেন না। মিসির আলি বললেন, আপনার শরীর কেমন? 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ 

আমার শরীর ভালােই। আমার শরীর খারাপ হওয়ার তাে কোনাে কারণ ঘটেনি। আপনি ঢাকায় এতদিন কী করলেন? 

তেমন কিছু করতে পারি নি, খোঁজখবর করছি। খোঁজখবর তাে যথেষ্টই করা হল আর কত? আপনি মনে হয় আশা ছেড়ে দিয়েছেন। 

হ্যা, ছেড়ে দিয়েছি। এই সমস্যার কোনাে সমাধান নেই। আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন। সেইজন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার পারিশ্রমিক হিসেবে একটি চেক আপনার জন্যে তৈরী করে রেখেছি। কাদের আপনাকে দেবে। আমি চাই না এ ব্যাপারটি নিয়ে আপনি আর মাথা ঘামান। 

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। 

ভাগ্যকে স্বীকার করে নেবার চেষ্টা করছি। যা ঘটছে এটা আমার ভাগ্য। 

জানতে পারেন না। আমি ঐসব নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। সমস্ত ব্যাপারটা থেকে আমি হাত ধুয়ে ফেলতে চাই।। 

মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, গােড়া থেকেই আপনি অনেক কিছু আমার কাছ থেকে গােপন করেছেন। যেটা উচিত হয়নি। 

বরকত সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি ধারণা করেছিলাম আপনি নিজেই তা ধরতে পারবেন। এখন দেখছি আমার ধারণা ঠিক নয়। আপনি কিছুই ধরতে পারেন নি। 

একেবারেই যে ধরতে পারিনি তা নয়। আমার ধারণা আপনার স্ত্রী আপনাকে বলে গিয়েছিল তিনি মেয়েটি বড় হলে কেমন হবে। অর্থাৎ আজকের এই সমস্যার ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনার স্ত্রী ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। 

এই জাতীয় ধারণা হবার পেছনে আপনার যুক্তি কী ? যুক্তি অবশ্যই আছে। এবং বেশ কঠিন যুক্তি। বলুন, শুনি আপনার কঠিন যুক্তি। 

অন্যভুবন-হুমায়ূন আহমেদ 

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। বরকত সাহেবের চোখের দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। এবং শান্ত স্বরে বললেন, আমি প্রথমেই লক্ষ্য করলাম আপনি আপনার মেয়ের অস্বাভাবিকতাগুলি মােটামুটি সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন। তেমন বিচলিত হন নি। আমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনাে ব্যক্তিকে জানান নি। এ থেকেই মনে হয়েছে আপনার মেয়ের এইসব অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত। এই প্রস্তুতি কোথেকে আসতে পারে? আমার মনে হয়েছে কেউ নিশ্চয় আগেই আপনাকে বলেছে। কে বলতে পারে। আমার মনে হয়েছে আপনার স্ত্রীর কথা। কারণ আপনার স্ত্রী হচ্ছেন…।। 

বরকত সাহেব মিসির আলির কথা শেষ করতে দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন এবং কঠিন স্বরে বললেন, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আপনি এখন যান, পরে কথা বলব। 

মিসির আলি নিঃশব্দে উঠে এলেন। চলে গেলেন বাগানে। বড়ইগাছটি খুঁজে বের করবেন। তিনি বড়ইগাছের একটা গর্তে দাঁড়িয়ে থাকে। এ গর্তটিও পৰীক্ষা করে দেখবেন। কিন্তু সেই সুযােগ হল না। ভয়াবহ একটি ব্যাপার ঘটল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *