অমানুষ পর্ব – ১৫ হুমায়ূন আহমেদ

অমানুষ পর্ব – ১৫

জামশেদের জ্ঞান ফিরল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। সে তাকাল চারদিকে। ছোট্ট একটি ঘর। সে শুয়ে আছে বিছানায়। তার গায়ে একটি পরিষ্কার চাদর। মাথার কাছে চল্লিশ পাওয়ারের একটি বাল্ব জ্বলছে। পায়ের কাছে ছোট্ট একটি টেবিলে এক জগ পানি। শক্ত লোহার দরজা। ভারী দুটো তালা ঝুলছে সেখানে। এ-ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। জামশেদ কয়েকবার ডাকল; কেউ আছে এখানে? কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। জামশেদ ঢকঢক করে পুরো জগ পানি খেয়ে ঘুমুতে গেল। বড় ঘুম পাচ্ছে।

ভিকনিডিয়ার সঙ্গে ক্যানটারেলার দেখা হয় পরদিন সকাল দশটার দিকে। ভিকানডিয়া গর্জে উঠল, কোথায় ছিলে কাল সারারাত সমস্ত শহর চষে ফেলা হয়েছে তোমার জন্যে।ক্যানটারেলা চুপ করে রইল।ভিকানডিয়া বলল, ঘটনা খুব দ্রুত ঘটছে, বুঝতে পারছ তো?

পারছি।পুলিশ জানিয়েছে ওরা যে-লোকটাকে ধরেছে সে জামশেদ নয়।ভোরবেলার খবরের কাগজে তা-ই পড়লাম।এখন আমাদের কাজ কী বুঝতে পারছ? যেভাবেই হোক জামশেদকে ধরা।ক্যানটারেলা শান্তুম্বরে বলল, সে যদি এ-শহরে থাকে তা হলে ধরা পড়বেই।তোমার ধারণা সে এ-শহরে নেই?

এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।শহর থেকে বেরুবার সব কটা পয়েন্টে আমাদের লোক থাকবে। এবং আমাদের আরেকটি কাজ করতে হবে। জামশেদের ছবি বড় করে ছাপিয়ে সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে দিতে হবে।ছবি পাওয়া গেছে?

অমানুষ পর্ব – ১৫

হ্যাঁ, ছবি জোগাড় হয়েছে। ছবির নিচে লেখা থাকবে, ওকে ধরিয়ে দিন।তাতে কোনো লাভ হবে না। এ-শহরের লোকজন ওকে ধরিয়ে দেবে না।ভিকানডিয়া সরু গলায় বলল, তোমার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর থেকে আমার আস্থা কমে যাচ্ছে। আমরা শুধু ছবিই ছাপাব না। ছবির সঙ্গে এ-ও লিখে দেব, একে ধরিয়ে দিতে পারলে পঁচিশ হাজার ইউ এস ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। পুরস্কারের টাকাটা আমরা একটা ব্যাংকে জমা করে দেব। তাও লেখা থাকবে।ক্যানটারেলা চুপ করে রইল।ভিকানডিয়া বলল, তোমার ধারণা এতে কাজ হবে?

হতে পারে।সন্দেহ থাকলে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে পঞ্চাশ হাজার ইউ এস ডলার করে দাও। টাকায় সবই হয়।তা হয়।আমি এই ঝামেলার দ্রুত নিষ্পত্তি দেখতে চাই।আমরাও চাই, ভিকানডিয়া।টুনটুন করে ডোরবেল বাজছে।এতরার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। কে হতে পারে? রাত প্রায় নটা। রুম সার্ভিস হবে না নিশ্চয়ই। দরজার পিপ হোল দিয়ে যে-লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, সে ব্রিটিশ। অত্যন্তু ভদ্র চেহারা। এ তার কাছে কী চায়?

এতরা দরজা খুলতেই বাইরে দাঁড়ানো লোকটি বলল, আপনাকে বিরক্ত করবার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত।কে আপনি? বলছি। তার আগে ভেতরে এসে বসতে পারি কি? আমার পক্ষে বেশি সময় দেয়া সম্ভব নয়। আমি আজ সকালেই ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছেছি। অসম্ভব ক্লান্তু।আজ সকালে এসেছেন কথা ঠিক নয়, মিঃ এতরা। আপনি এসেছেন পরশু। আমি ভেতরে আসতে পারি?

আসুন।ভদ্রলোক ভেতরে এসেই বললেন, আমি হচ্ছি লয়েডস ইনস্যুরেন্সের একজন তদন্তকারী অফিসার। আমার নাম রেমন্ড কিন।এতরা কিছু বলল না। লোকটি অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে সোফায় বসে হাসিমুখে বলল, অ্যানি নামের একটি মেয়ের ইনস্যুরেন্স পলিসির ব্যাপারে আপনাকে দুএকটি কথা জিজ্ঞেস করব। অবিশ্যি আপনি যদি অনুমতি দেন।আপনি কী করে জানলেন যে আমি এখানে আছি। আমার ঠিক এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা নয়।

অমানুষ পর্ব – ১৫

মিঃ এতরা, এটা জানার জন্যে আমাদেরকে শার্লক হোমস হবার প্রয়োজন হয় না। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্যে দুজন গিয়েছিলেন ইতালি। তারা ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে জেনেছে আপনি ইংল্যান্ডের টিকিট কেটেছেন। আমি তাই এখানকার হোটেলগুলিতে খোঁজ করেছি। আপনি যদি অন্য কোনো নামে হোটেল রিজার্ভেশন করতেন, তা হলে অবিশ্যি আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হত না।আমি অন্য নামে সিট রিজার্ভ করব কেন?

কথার কথা বলছি মিঃ এতরা। অবিশ্যি ইচ্ছা থাকলেও আপনি তা পারতেন না। কারণ হোটেল সিট রিজার্ভেশনের সময় বিদেশী নাগরিকদের পাসপোর্ট দেখাতে হয়।এতরা সিগারেট ধরাল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।মিঃ এতরা, এখন কি আমি দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? না, এখন পারেন না। আমি খুবই ক্লান্ত। আপনাকে কাল আসতে হবে। রাত নটা আলোচনার জন্যে ভালো সময় নয়।

রেমন্ড কিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, আমি কাল সকালে আসব। বিরক্ত করার জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত।দশটার পর আসবেন। আমি অনেক দেরি করে উঠি।আমি আসব ঠিক সাড়ে দশটায়। ইতালি সম্পর্কে কিছু গল্পগুজবও করা যাবে।ইতালি সম্পর্কে গল্পগুজব করার কিছু নেই।থাকবে না কেন? আমি দুদিন আগের খবর জানি সেখানে জামশেদ নামের একটি লোক গ্রেফতার হয়েছে পুলিশের কাছে। এ নিয়ে ইতালিতে তুমুল উত্তেজনা।এতরা চাপা স্বরে বলল, জামশেদ গ্রেফতার হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে। আমরা জামশেদের ব্যাপারেও উৎসাহী। অ্যানির ইনস্যুরেন্সের বিষয়ে ওকেও দরকার। কাজেই আমরা ওর ব্যাপারে খোঁজ রাখার চেষ্টা করছি। মিঃ এতরা! বলুন। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনিও জামশেদের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী।না, আমি উৎসাহী নই। আমি উৎসাহী হব কীজন্যে?

অমানুষ পর্ব – ১৫

ও, সরি। আমারই ভুল হয়েছে। আচ্ছা মিঃ এতরা, আমরা কাল ভোরে কথা বলব।দশটার পর।ঠিক সাড়ে দশটায় আমি আসব। গুড নাইট।এতরা টেলিফোনে ব্রুম সার্ভিসকে কফি দিতে বলল। তার দুমিনিট পরেই বলল কফি দেবার প্রয়োজন নেই। তার কিছুই ভালো লাগছে না। তার কেন জানি প্রচণ্ড ভয় করতে লাগল। ইংল্যান্ডে আসার পরিকল্পনাটি কাঁচা। তার উচিত ছিল দেশেই থাকা। দেশে নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরো জোরদার করা যেত।

এখন ফিরে গেলে কেমন হয়? কাল সকাল দশটার আগেই রওনা হয়ে গেলে মন্দ হয় না। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ঐ ছাগলটির সঙ্গে কোনো কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না।এতরা রাত তিনটায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এল। ভোর সাড়ে চারটায় ফ্রান্সের কনকর্ডের একটি টিকিট পাওয়া গেছে। সেখান থেকে বাসে করে ইতালি চলে যাওয়া যাবে। ভালো লাগছে না, কিছুই ভালো লাগছে না।

জামশেদ সমস্ত দিন শুয়ে রইল।প্রচণ্ড খিদে। কিন্তু কোনো খাবার নেই। এক জগ পানি ছিল তা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। জামশেদের শুয়ে থাকা কিংবা বসে বসে বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আরকিছু করবার নেই। চুপচাপ বসে থাকার ব্যাপারটি খুবই বিরক্তিকর। জামশেদ ঘুমুতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। স্নায়ু উত্তেজিত। সে মনে-মনে পরবর্তী পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে গিয়ে বাধা পেল। পরবর্তী পরিকল্পনা করাও অর্থহীন।

এখান থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। অলৌকিক কোনো ব্যাপার বা সৌভাগ্য এসব জিনিসে জামশেদের বিশ্বাস নেই। কাজেই পরবর্তী কোনো পরিকল্পনা তৈরির আগে বরং মৃত্যুর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নেয়াই ভালো।কী হয় মৃত্যুর পর? মৃত্যুর ওপারেও কি কোনো জগৎ আছে? সুখী কোনো ভুবন?

অমানুষ পর্ব – ১৫

যেখানে কষ্ট নামক ব্যাপারটি মেই। ক্ষুধার কষ্ট নেই। গ্লানি ও বঞ্চনার কষ্ট নেই। আনন্দ ও উল্লাসের একটি অপরূপ ভুবন। ভাবতে ভাবতে জামশেদের ঘুম এসে গেল। অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখল সে।যেন অ্যানি ছুটতে ছুটতে আসছে, তার বদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, এই ভালুক, তুমি এখানে আটকা পড়ে আছ কেন? বুদ্ধির দোষে আটকা পড়েছি।এমন বোকা কেন তুমি?

অ্যানি মাথা দুলিয়ে খুব হাসতে লাগল। রিনরিনে মিষ্টি গলায় হাসি। ঘুম ভেঙে উঠে বসল জামশেদ।এখন কি দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। ঘরে সবসময় বাতি জ্বলছে। কোনোরকম শব্দটও কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না। ক্ষুধার তীব্রতাও ক্রমে ক্রমে মরে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই ধরে সে আছে আটচল্লিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। ত্রিশ ঘণ্টা পার হলে খিদে মরে যায়। শুধু তৃষ্ণা থাকে। তৃষ্ণাও কমে আসে পঞ্চাশ ঘণ্টায়।

না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা জামশেদের আছে। একবার সে এবং বেন ওয়াটসন না খেয়ে সাত দিন ছিল। সে ছিল একটি ছেলেমানুষি ব্যাপার। বেন ওয়াটসন একদিন বলল, জামস, একটা বাজি ধরলে কেমন হয়?

কিসের বাজি?

না খেয়ে থাকায় বাজি। কে বেশি সময় থাকতে পারে।

কত টাকা বাজি?

পঞ্চাশ ইউ এস ডলার।

ঠিক আছে।

বেন ওয়াটসনের কাজই হচ্ছে বাজি ধরা। সবকিছুতেই সে একটা বাজি ধরে ফেলবে। এবং অবধারিতভাবে হারবে। না খেয়ে থাকার বাজিতেও তা-ই হল।ত্রিশ ঘণ্টার মাথায় ওয়াটসন পঞ্চাশ ডলারের নোট এনে মুখ কালো করে বলল, আবার হারলাম। এসো এবার খানাপিনা করা যাক।জামশেদ বলল, তুমি খাওয়াদাওয়া করো। আমি দেখতে চাই না-খেয়ে কতদিন থাকা যায়।

অমানুষ পর্ব – ১৫

আর দেখাদেখি কী, তুমি তো জিতবেই।বাজি-টাজি না। পরীক্ষা করতে চাই, না-খেয়ে কতদিন থাকা যায়।জামশেদ ঝুলে রইল সাতদিন পর্যন্ত। বেন ওয়াটসন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। সামান্য বাজি ধরা থেকে এ কী ঝামেলায় পড়া গেল! শেষমেশ পাঁচশো ডলার নিয়ে সাধাসাধি, যেন জামশেদ কিছু-একটা মুখে দেয়। ইস, কীসব দিন গিয়েছে!

সে বিছানায় উঠে বসল। আবার শুয়ে পড়ল। উঠে বসা এবং শুয়ে থাকা এই দুটি মাত্র কাজ তার। প্রথম দিকে খানিক হাঁটাহাঁটি করা যেত, এখন আর যায় না। শোয়ামাত্রই ঝিমুনি এসে গেল জামশেদের। আর প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল অ্যানি দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ কেমন যেন বিষণ্ণ। কথা বলছে টেনে টেনে।

বুড়ো ভালুক।

উঁ

খুব কষ্ট হচ্ছে?

তা হচ্ছে, অ্যানি।

মানুষের এত কষ্ট কেন বুড়ো ভালুক?

কী জানি অ্যানি।

আমি কারোর কষ্ট দেখতে পারি না। খুব কান্না পায়।জামশেদের মনে হল অ্যানি কাঁদতে শুরু করেছে। সে হাত বাড়াল অ্যানিকে সান্ত্বনা দিতে, তখনই তন্দ্রা কেটে গেল। আবার সেই আগের ছোট্ট ঘর। চল্লিশ পাওয়ারের হলুদ একটা বাতি। জামশেদের পেটে পাক দিয়ে উঠল। বমি হবে বোধহয়। হয়, এরকম হয়। একটা সময় আসে যখন শরীর বিদ্রোহ করতে শুরু করে। চোখ কিছু দেখতে চায় না। পা চলতে চায় না। মস্তিষ্ক স্থবির হয়ে আসে। জামশেদ মেঝেতে বমি করল।

অমানুষ পর্ব – ১৫

বস ভিকানডিয়া ঠাপ্তস্বরে বলল, একটি লোক হাওয়া হয়ে যেতে পারে না।ফাজিন জবাব দিল না।লোকটি নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রটন্ত্র জানে না। নাকি তোমরা বলতে চাও সে অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো মানুষ? সে খুব সম্ভব ইতালিতে নেই। ইতালিতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাকে খোঁজা হয়নি। আমার ধারণা সে জীবিত নেই।এরকম ধারণা হবার কারণ কী?

কোনো কারণ নেই, আমার মনে হচ্ছে এরকম।কারণ ছাড়াই যারা বিভিন্ন জিনিস ভাবে ওরা ছাগল সম্প্রদায়ভুক্ত বলেই আমি মনে করি।ফাজিন কিছু বলল না।ভিকানডিয়া তিক্তস্বরে বলল : ওর বন্ধু ওয়াটসন কী বলছে? ও কিছুই বলছে না।বলাবার চেষ্টা করেছ? হ্যাঁ করেছি। পেন্টাথল ইনজেকশন দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ও কিছু জানে না। জানলে বলত।কী বলে সে?

সে বলে যে ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জামশেদ ওর সঙ্গে দুরাত ছিল।সেই দুরাত ওদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে? বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি। জামশেদ কথা বলে কম।ভিকামডিয়া চুরুট ধরাল।ফাজিন বলল, ওয়াটসনকে নিয়ে এখন কী করব?

আমাকে জিজ্ঞেস করছ? এইসব ছোট জিনিস নিয়ে কেন তোমরা আমাকে বিরক্ত কর? যদি দেখ ওকে ধরে রেখে আর কোনো লাভ নেই তা হলে আপদ বিদেয় করো। বস্তায় ভরতি করে ফেলে দাও সমুদ্রে।

 

Read more

অমানুষ শেষ – পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *