অরণ্য পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

অরণ্য পর্ব – ৪

নাহ। মেয়েদের গায়ে আমি হাত তুলি না। ছেলে হলে এক চড়ে মাঢ়ির দুটো দাঁত নড়িয়ে দিতাম।মেয়েটির গাল গোলাপি বর্ণ ধারণ করল। সোবাহান ঘর থেকে বেরিয়ে এল। খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিচে গেল। তার ভয় করছিল হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন এসে তাকে ধরে ফেলবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। শুধু বুড়োটি পিছু পিছু নেমে এল। সে তাকাচ্ছে ভয় পাওয়া চোখে। তাকে কি গুণ্ডাদের মতো লাগছে?

রিসিপশনের মেয়েটি টেলিফোনে খুব হাসছে। সকালবেলা তাকে যতটা রূপসী মনে হচ্ছিল এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। সোবাহান তার দিকে তাকিয়ে পরিচিত ভঙিতে হাসল। মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলা বন্ধ রেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে। যেন সে বিস্মিত। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার কী আছে? একজন মানুষ কি আরেকজন মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসবে না!

সোবাহান সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরল। আজও দুপুরে তার খাওয়া হলো না। বৈশাখ মাসের অসম্ভব কড়া রোদ। ঝাঁ ঝাঁ করছে চারদিক। প্রেসক্লাবের কাছে কাটা তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। এক টাকা করে পিস। খেলে হয় একটা।কিনতে গিয়েও কিনল না। মাঝে মাঝে নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা হয়। কড়া রোদেই সে আবার রাস্তায় নেমে পড়ল।

ফরিদ আলি বললেন, সোবাহান কি রোজ রোজই এমন দেরি করে? জলিল সাহেব দাঁত বের করে হাসলেন, তা করে। যুবক মানুষ।যুবক মানুষ হলেই দেরি করে ফিরতে হবে এটা কী কথা? এসে পড়বে। চিন্তা করবেন না।এক্সিডেন্ট হয় নাই তো? আরে এরা চালু ছেলে, এরা এক্সিডেন্ট করবে কী? চাল্লু ছেলে? চাল্লু ছেলে বললেন কেন?

ফরিদ আলি গম্ভীর হয়ে গেলেন। জলিল সাহেব বললেন, রাতও তো বেশি হয় নাই। দশটা বাজে।দশটা কম রাত? এ আপনাদের নীলগঞ্জ না। এটা ঢাকা শহর। এখানে সন্ধ্যা হয় এগারোটায়। নেন ভাই সিগারেট ধরান, নার্ভ ঠান্ডা হবে।আমি সিগারেট খাই না।বাচ্চা ছেলে তো না যে এতটা অস্থির হয়েছেন। অস্থির হওয়ার কিছুই নাই।ফরিদ আলি রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ হাওয়া দিচ্ছে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টি হবে বোধহয়।

সোবাহান এল রাত এগারোটায়। ফরিদ আলি ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কী ব্যাপার, এত দেরি? সোবাহান জবাব দিল না। তাকাল না পর্যন্ত।আমি তো চিন্তায় অস্থির।চিন্তার কী আছে? চিন্তার কী আছে মানে? তোকে বলেছিলাম না রাতের ট্রেনে চলে যাব। ছিলি কোথায় তুই?

সন্ধ্যাবেলা একটা পার্কে গিয়েছিলাম। কেমন করে যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। টায়ার্ড হয়ে ছিলাম।

কোথায় ঘুমালি?

ওইখানে বেঞ্চি আছে। বেঞ্চিতে।

খাওয়াদাওয়া করেছিস?

হুঁ। আপনি খেয়েছেন?

হ্যাঁ। জলিল সাহেবের সঙ্গে খেয়ে এলাম।

ফরিদ আলি সোবাহানের হাত ধরলেন। মৃদুস্বরে বললেন, চল আমার সঙ্গে।কোথায়? নীলগঞ্জে। কয়েকদিন থেকে আসবি। তোর ভাবি খুব করে যেতে বলেছে।একটা কিছু হোক, তারপর যাব।ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করছে। দেখতে দেখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। সোবাহান যে গতিতে হাঁটছিল তার কোনো পরিবর্তন হলো না। ফরিদ আলি তার হাত ধরেই থাকল। দু’জনে ঘরে ঢুকল কাকভেজা হয়ে। ফরিদ আলির মুখ চিন্তাক্লিষ্ট।

সোবাহানের ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারছেন না।তারা ঘুমোতে গেল অনেক রাতে। চৌকিটি ছোট–দু’জনের জায়গা হয় না। ঘেঁসাঘেঁসি করে ঘুমোতে হয়। গত রাতে খুব কষ্ট গেছে। আজ আরাম করে ঘুমানো যাবে। শীতল হাওয়া। ফরিদ আলি বললেন, কাঁথা টাথা কিছু আছে নাকি রে? শীত শীত লাগছে।

বিছানার চাঁদরটা গায়ে দেন। কাঁথা নাই। একটা লেপ আছে শুধু। লেপ দিব? না। এর পরেরবার আসার সময় কাঁথা নিয়ে আসব।সোবাহান কিছু বলল না। ফরিদ আলি বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছিস? না।মনসুর সাহেবের শালীকে দেখেছিস? যূথি? যূথি নাম।

দেখেছি।

মেয়েটি কেমন?

যক্ষ্মারোগী। আর কেমন। কেন?

ফরিদ আলি চুপ করে গেলেন। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। ভালোই লাগছে। সোবাহান বলল, ওই মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করেন কেন? মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ভালো মেয়ে। একটু রোগা এই যা। বিয়ের পর গায়ে গোশত লেগে যাবে। মনে সুখ থাকলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। কত দেখলাম। তোর ভাবিও তো রোগা ছিল। ছিল না? এতসব বলছেন কেন?

তুই মেয়েটাকে বিয়ে কর। রোজগারপাতির কথা চিন্তা করিস না। আল্লাহপাক রুজি রোজগারের মালিক।আপনি কি বিয়ের কথাবার্তা বলেছেন? হুঁ। পাকা কথা দেই নাই। তোকে না জিজ্ঞেস করে দেই কীভাবে! ওদের তোকে পছন্দ হয়েছে।সোবাহান চুপ করে রইল।একটা মানুষ ভালো কি মন্দ সেটা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ভালো মানুষের চেহারায় নূরানী থাকে।মেয়েটার চেহারায় নূরানী দেখলেন?

হুঁ। যাস কই?

একটু বারান্দায় গিয়ে বসি।

এখন আবার বারান্দায় বসাবসি কী? একটা বাজে।

ঘুম আসছে না।

সোবাহান বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গেল। বৃষ্টি পড়ছে সমানে। বৈশাখ মাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হয় না। ঝমঝম করে খানিকক্ষণ বৃষ্টি হয়ে সব শেষ। মুহূর্তে আকাশে তারা ওঠে। আজ বোধহয় সারা রাতই বৃষ্টি হবে। সমস্ত রাত আকাশ থাকবে মেঘলা।কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নাকি মনের ভুল? সোবাহান ভালো করে শুনতে চেষ্টা করল। বৃষ্টির শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ যে কাঁদছে এতে সন্দেহ নেই।

সোবাহান! সোবাহান তাকিয়ে দেখল ফরিদ আলি উঠে আসছেন। সে তার সিগারেট উঠোনে ছুঁড়ে ফেলল।সোবাহান! জি।কাঁদছে কে? মনসুর সাহেবের শালী বোধহয়। প্রায়ই কাঁদে।কেন? কী জানি কেন।ফরিদ আলি বড়ই অবাক হলেন। একজন মানুষ শুধু শুধু কাঁদবে কেন? নীলগঞ্জ থেকে ভাবির চিঠি এসেছে।

চিঠি পড়ে বুঝবার উপায় নেই মহিলাটির পড়াশোনা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। সুন্দর হাতের লেখা। বানান ভুল প্রায় নেই। ভাষাটাও বেশ ঝরঝরে। দুপুরবেলা শরৎচন্দ্র পড়ে পড়ে তার এই উন্নতি। ‘দেবদাস’ ভাবি সম্ভবত মুখস্থ বলে যেতে পারেন। দেবদাস’ তিনি এগারোবার পড়েছেন। সোবাহান ভাবির দীর্ঘ চিঠিটা দু’বার পড়ল।

প্রিয় ভাই,

দোয়া নিয়ো।

বড় খবর হইল তোমার ভাই উত্তর বন্দের জমি বিক্রি করিয়া দিয়াছেন। বিক্রয়ের পর আমি জানিতে পারি। আমার দুঃখ এই তুমি শিক্ষিত ছেলে হইয়াও জমি বিক্রয়ের বিষয়ে নীরব থাকিলে। আমার সঙ্গে তোমার ভাই কোনো পরামর্শ করে নাই। কারণ মেয়েদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ তিনি করেন না। মেয়েদের পরামর্শে সংসার চলিলে নাকি সংসারে আয় উন্নতি হয় না।

জমি বিক্রয়ের টাকায় নামাজঘর তৈরি হইতেছে। নামাজঘর হইল একটা পাকা কোঠা। সেখানে তোমার ভাই এবাদত বন্দেগি করিবেন। এবাদতের জন্যে পাকা ঘর লাগে তাহা জানিতাম না। আমরা মেয়েমানুষেরা অনেক কিছু জানি না।সংসারে নানান ঝামেলা। পরামর্শ করিবার কেহ নাই। তুমি আসিলে ভালো হইত। শুনলাম তোমার শরীরও নাকি খুব খারাপ হইয়াছে। হোটেলে খাওয়া–শরীর নষ্ট হইবে জানা কথা। তুমি ভাই কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে থাক। তোমার ভাইয়ের নামাজঘর দেখিয়া যাও। আল্লাহ তোমাকে সুখে শান্তিতে রাখুক।

তোমার ভাবি

সোবাহান লক্ষ করল চিঠিতে যূথির কথা নেই। তার মানে ভাইসাহেব এই প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। অদ্ভুত লোক!

কার চিঠি এত মন দিয়ে পড়ছেন?

ভাবির চিঠি।

ফরিদ সাহেবের স্ত্রী?

জি।

সুন্দর হাতের লেখা।

সোবাহান চিঠি পকেটে রেখে দিল। জলিল সাহেব বললেন, কোথাও যাচ্ছেন নাকি? জি।আরে, ছুটির দিনে কোথায় যাবেন? বসেন, গল্পগুজব করি।কাজ আছে।আরে ভাই রাখেন কাজ। চলেন ভিসিআর দেখে আসি। আমার চেনা জায়গা।আরেকদিন যাব।আরে না, আরেকদিন আবার কী! চলেন যাই। এমন জিনিস দেখবেন জীবনে ভুলবেন না। মারাত্মক ছবি।

সোবাহানকে বেরুতে হলো তার সঙ্গে। বারান্দায় যূথি দাঁড়িয়ে ছিল। জলিল সাহেব হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ? মেয়েটা অস্পষ্টভাবে কী যেন বলল ঠিক বোঝা গেল না।তোমরা বাইরের মানুষদের দাওয়াত করে খাওয়াও। আমাদের কথা তো মনে করো না। আমাদেরও তো মাঝে মাঝে ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা করে। কী বলেন সোবাহান। সাহেব? করে না?

সোবাহান অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রাস্তায় নেমে জলিল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, মেয়েটা অপুষ্ট কিন্তু তার বুক কেমন ডেভেলপ লক্ষ করেছেন। এর কারণটা বলতে পারেন? পারবেন না? হা হা হা! দুনিয়ার হালচাল কিছু দেখি জানেন না। আজকের দিনটা সময় দিলাম, দেখেন ভেবে-টেবে বের করতে পারেন কি না।

মগবাজার চৌধুরীপাড়ার বাড়িটা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বের করা গেল না। সোবাহান বিরক্ত হয়ে বলল, বাড়ি চিনেন না নিয়ে এলেন কেন? আরে ভাই চিনি। চিনব না কেন? রাতের বেলা এসেছিলাম, তাই ঠিক ইয়ে হচ্ছে না। বাড়ির সামনে লোহার গেট।লোহার গেট তো সব বাড়ির সামনেই।তাও ঠিক।ঘণ্টাখানিক খোঁজাখুঁজি চলল। জলিল সাহেব হাল ছাড়ার পাত্র নন। সোবাহান বলল, বাদ দেন, চলেন ফিরে যাই।

ফিরে গিয়ে তো সেই শুয়েই থাকবেন। আসেন আরেকটু দেখি। এই গলিটা চেনা লাগছে।চেনা গলিতেও কিছু পাওয়া গেল না। জলিল সাহেবও একসময় হাল ছেড়ে দিলেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, লাচ্ছি খাবেন নাকি? নাহ।আরে ভাই খান, আমি পয়সা দেব।পয়সা আমার কাছে আছে, আপনার দিতে হবে না। ইচ্ছে করছে না।আরে চলেন চলেন।

লাচ্ছির দোকানটিতে ভিড় নেই। দৈয়ের উচ্ছিষ্ট খুড়িগুলিতে মোটা মোটা মাছি ভনভন করছে। ঘরের ভেতরে ভ্যাপসা গরম, তবে মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসও গরম।জলিল সাহেব এক গ্লাস লাচ্ছি শেষ করতে আধা ঘণ্টা সময় নিলেন। লাচ্ছি শেষ করে পান আনালেন, সিগারেট আনালেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, বুড়ো হয়ে গেছি, বুঝলেন। ছুটির দিনগুলিতে কী করব বুঝতে পারি না।বিশ্রাম করেন।

বিশ্রাম করেই বা হবেটা কী? সংসার দরকার। ঝামেলা দরকার। ঝামেলা অশান্তি এইসব না থাকলে বেঁচে থাকা যায় না। পান খাবেন নাকি একটা? মুখের মিষ্টি ভাবটা যাবে।জি-না, খাব না।এই তো দেখেন না আমার সংসারের কোনো দায়দায়িত্ব নাই। ছোট বোন ছিল বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার দিন চলে না। দুপুরবেলা দৈয়ের দোকানে বসে থাকি।

জলিল সাহেব, আমি এখন যাব।সোবাহান উঠে দাঁড়াল।আরে এই রোদের মধ্যে কী যাবেন? বসেন বসেন, রোদ কমুক। আরেকটা লাচ্ছি খান।আপনি খান।সোবাহান রাস্তায় নেমে পড়ল। জলিল সাহেব লাচ্ছির শূন্য গ্লাস সামনে নিয়ে বসে রইলেন। তাকে ঘিরে নীল রঙের পুরুষ্ট মাছিরা উড়তে লাগল।

দুপুরে কোথাও যাওয়া যায় না। দুপুর হচ্ছে গৃহবন্দির কাল। সোবাহান উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরল অনেকক্ষণ। আজও তার দুপুরে খাওয়া হয়নি। সকাল থেকে এ পর্যন্ত চা খাওয়া হয়েছে সাত কাপ। সমুচা দুটি। তিনটি নোতা বিস্কিট। এক গ্লাস লাচ্ছি। এখন ক্ষিধে জানান দিচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে হোটেলে উচ্ছিষ্ট খাবার ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। ভাত হয় কড়কড়া। বেয়ারাগুলি ঝিমায়। তিনবার ডাকলে তবেই

সাড়া দেয়। অসময়ের কাস্টমারদের প্রতি এদের কোনো মমতা নেই।সোবাহান মাঝারি সাইজের একটা হোটেলে ঢুকে পড়ল। এক প্লেট ভাত আর ডাল-গোশতের অর্ডার দিয়ে বসে রইল। ভাতের প্লেট নামিয়ে বয়টি দাঁত বের করে বলল, ডাল-গোশত নাই, ইলিশ মাছ আছে। আনুম? বয়টির ডান হাতে একটা ফেঁড়া। সাদা হয়ে পেকে আছে। সোবাহানের ক্ষিধে মরে গেল।কি, খাইবেন না? না।

কোথায় খাওয়া যায়? খাওয়ার কি কোনো জায়গা আছে? সোবাহানের বমি বমি ভাব হলো। ভাতের থালাটির পাশে পেকে ওঠা ফোড়ার ছবিটি উঠে আসছে। কিছু কিছু ছবি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হতে থাকে। সে বাসে চাপা পড়া একটা কুকুর দেখেছিল। একবার। মাথাটা থেতলে মিশে গেছে। চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। সোবাহানের মনে হয়েছিল চোখ দুটি এখনো সবকিছু দেখছে। অবাক হয়ে জগতের নিষ্ঠুরতা দেখছে।

মৃত্যুর পর যেন চোখ দুটির দেখার শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এরকম মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই, তবু মনে হয়। সোবাহান মিলিদের বাড়ির দিকে রওনা হলো।আরে সোবাহান ভাই, আপনি! কেমন আছ? ইস! এই রোদের মধ্যে কেউ আসে? হেঁটে এসেছেন, না? ঘুমাচ্ছিলে নাকি? আমি দিনে ঘুমাই না। যেসব মেয়ের বয়স একুশ তারা দুপুরে ঘুমায় না।মিলি, ঠান্ডা দেখে এক গ্লাস পানি দাও।

একটু বিশ্রাম করে নিন। এখন ঠান্ডা পানি খেলে সর্দি-গর্মি হবে। আসেন বারান্দায়। বসেন। বারান্দায় ঠান্ডা।সোবাহান বারান্দায় বসে রইল। গা দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। পুকুরে গলা। পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মিলি তাকিয়ে আছে। কে বলবে এই মেয়ের বয়স একুশ। পনেরো-ষোল বছরের কিশোরীর মতো লাগছে। ভারী মিষ্টি একটি মুখ।একটা টেবিল ফ্যান এনে দেই? নাকি ঘরের ভেতর ফ্যানের নিচে বসবেন?

এখানেই বসব। তুমি পানি আন।মিলি পানি আনতে গেল। সোবাহান হাত-পা ছড়িয়ে এলিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে সে আসে এ বাড়িতে। আসার তেমন কোনো কারণ নেই। মিলির বড় ভাইয়ের বন্ধু, সেই সূত্রে আসে। নিন, পানি নিন।শুধু পানি নয়, একটা প্লেটে দুটি সন্দেশ। সোবাহান লোভীর মতো সন্দেশ খেল। তার এতটা ক্ষিধে পেয়েছে আগে বোঝা যায়নি। মিলি সহজ স্বরে বলল, আপনি দুপুরে কিছু খাননি, তাই না? হুঁ।কেন, খাননি কেন?

সোবাহান না খাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করল না। আরেক গ্লাস পানি চাইল। মিলি বড় একটা কাঁচের জগে পানি নিয়ে এল। পানির ওপর বরফের টুকরো ভাসছে। কাঁচের জগটি ঝকঝক করছে। বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে চারপাশে দেখেই তৃষ্ণা কমে যায়।সোবাহান ভাই, আপনি দুমাস পরে এলেন। আপনার কথা মা প্রায়ই বলেন।খালা কেমন আছেন? ভালো না।এখনো কান্নাকাটি করেন? হুঁ। এবং এখনো বিশ্বাস করেন ভাইয়া বেঁচে আছে। মিলিটারিরা তাকে পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করে রেখেছে।

বেশির ভাগ মা-ই তাই ভাবে। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয় ও হয়তো বেঁচেই আছে।মিলি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বলল, খেতে আসুন সোবাহান ভাই। খাবার দেওয়া হয়েছে।খাবার দেওয়া হয়েছে মানে? দুপুরে তো খাননি। টেবিলে ভাত দিতে বলেছি।চারটার সময় ভাত খেতে বসব নাকি? হ্যাঁ বসবেন। আসুন। সিগারেট ফেলে দিন।শোনো, মিলি।অল্প চারটা খান। আসুন।সোবাহানকে উঠতে হলো। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত নিয়ে বসতে হলো।

কাজের মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে দূরে। মিলি তার ধবধবে ফর্সা হাতে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। হাতভর্তি লাল টকটকে কাঁচের চুড়ি। অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবি। স্বপ্নদৃশ্যের মতো।মিলি, বাসায় কেউ নাই? না। আব্বা আম্মা খালার বাসায় গেছেন। ছ’টার মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি কিন্তু মার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারবেন না।আরেকদিন আসব। আজ আমার যেতে হবে এক জায়গায়।আপনি এলে মার সঙ্গে দেখা করতে চান না।

সোবাহান চুপ করে রইল। মিলি বলল, মা আপনাকে দেখলেই কান্নাকাটি করে তাই আপনার ভালো লাগে না। ঠিক না? সোবাহান জবাব দিল না। মিলি বলল, এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? আস্তে আস্তে খান। ডাল নিয়ে ভালো করে মাখুন। শুকনা শুকনা খাচ্ছেন কেন?সোবাহান কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। মিলি বলল, চাকরির কিছু হয়েছে আপনার? নাহ।

মা যে আপনাকে এক ভদ্রলোকের কাছে যেতে বলেছিলেন, যাননি? রহমান সাহেব কে যেন।এখনো দেখা হয়নি।দেখা করবেন। আপনার চাকরি হবে।আমার কিছু হবে টবে না মিলি। আমি গ্রামে চলে যাব।এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন? অনেকদিন চেষ্টা করলাম। আর ভালো লাগে না। উঠি মিলি?

 

Read more

অরণ্য পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *