আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ৭ হুমায়ূন আহমেদ

আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ৭

শামসুদ্দিন চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। রফিক নিচু গলায় বলল, ভাইজান, আমি জানি কথাগুলি মিথ্যা। এই নিয়ে আমার মনে কোনো রকম সন্দেহ নাই। রাহেলা অসুস্থ। আপনাকে সে খুবই পছন্দ করে। মানসিক অসুস্থতা, অতিরিক্ত পছন্দ সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা রাহেলার মাথায় জট পাকিয়ে গেছে। ভাইজান, আপনি এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার খুব খারাপ লাগছে। নেন, একটা সিগারেট নেন।শামসুদ্দিন হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলেন তিনি সিগারেট ধরাতে পারছেন না। তাঁর হাত কাঁপছে।

রফিক বলল, ভাইজান, আমি খুব লজ্জিত যে আপনাকে এত বড় অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছি। রাহেলা এতটা অসুস্থ ছিল না। আপনি আমেরিকা যাবেন এটা শোনার পর থেকে সে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি যে কী বিপদে পড়েছি–এক আল্লাহপাক জানেন। আর কেউ জানে না।আমি যদি অন্য কোথাও চলে যাই তাতে কি সুবিধে হবে? ভাইজান, আমি বুঝতে পারছি না।আমি কি বিষয়টা নিয়ে রাহেলার সঙ্গে কথা বলব?

এটাও তো বুঝতে পারছি না।পৃথুর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রফিক উঠে শোবার ঘরের দিকে রওনা হলো। শামসুদ্দিন সিগারেট হাতে মূর্তির মতো বসে রইলেন। তার কাছে মনে হলো তার চারপাশের ঘর-বাড়ি দুলছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। এক্ষুণি মাথার উপরের ছাদ ভেঙে নিচে নেমে আসছে।শোবার ঘরে পৃথু মুখে হাত চাপা দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে হাত চাপা দিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে। থামাতে পারছে না। হাতের ফাক দিয়ে চাপা কান্না বের হয়ে আসছে। রাহেলা ছেলের সামনে দাড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি কঠিন। তার এক হাতে মাছ কাটার বটি। পৃথু এক একবার কেঁদে উঠছে, রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে বলছে–খবরদার! শব্দ বের হলে বটি দিয়ে গলা কেটে দুটুকরা করে ফেলব। খবরদার! রফিক ঘরে ঢুকে বলল, কী হয়েছে?

রাহেলা বলল, তোমাকে বলার মতো কিছু হয় নি।রফিক বলল, বুটিটা আমার হাতে দাও। প্লিজ দাও। পৃথু ভয় পাচ্ছে। বটিটা দাও।রাহেলা বটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, আমাকে একটা বেবিটেক্সি ডেকে দাও। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না।রাতের বেলা কোথায় যাবে? কোথায় যাব এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।রফিক বলল, রাতটা থাক। সকাল হোক, তুমি যেখানে যেতে চাও আমি দিয়ে আসব।রাহেলা বলল, ভাইজানের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে শুইট করে কী কথা বলেছ?

উনি আমেরিকা কবে যাবেন, টিকিট হয়েছে কিনা এইসব জিজ্ঞেস করছিলাম।রাহেলা, একসপ্রেসো কফি খাবে? মোড়ে একটা নতুন ফাস্ট ফুডের দোকান হয়েছে, তারা খুব ভালো একসপ্রেসো কফি বানায়। এক কাপ দশ টাকা। খাবে? রাহেলা কিছু বলল না। রফিক উৎসাহের সঙ্গে বলল, নিয়ে আসি এক কাপ কফি। ভালো না লাগলে ফেলে দিও। পৃথু ব্যাটা, কফি খাবি নাকি? পৃথু চোখ মুছতে মুছতে বলল, খাব। তাহলে চল তোকে কফি খাইয়ে আনি আর তোর মার জন্যে কফি নিয়ে আসি। তার আগে একটা কাজ কর বাবা, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। সার্ট পর। জুতা পায়ে দে। তুই কি নিজে নিজে জুতার ফিতা বাঁধতে পারিস? পারি।

ভেরি গুড। আমার সামনে জুতার ফিতা বাঁধ। ফিতা বাঁধা পরীক্ষা হবে।পৃথু হেসে ফেলে বাথরুমের দিকে রওনা হলো। একটু আগেই পরিস্থিতি কী ভয়ঙ্কর ছিল। তার মা আরেকটু হলে বটি দিয়ে তাকে কেটেই ফেলত। বাবা এসে ফু মন্ত্র দিয়ে সব ঠিক করে দিল। বাবার মধ্যে পাওয়ার আছে। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো পাওয়ার। তবে বাবার পাওয়ারটা দেখা যায় না।রাহেলা খাটে এসে বসেছে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। রফিক বলল, শরীরটা কি খারাপ লাগছে? রাহেলা বলল, সামান্য খারাপ লাগছে।রফিক বলল, রেস্ট নাও। ঠিক হয়ে যাবে।রাহেলা বলল, ভাইজান হঠাৎ করে আমেরিকা যাবার জন্যে কেন পাগল হয়েছে এটা আমি চিন্তা করে বের করে ফেলেছি।কেন আমেরিকা যাচ্ছেন? বীথির সঙ্গে দেখা করার জন্যে।বীথিটা কে?

ভাইজান এক সময় ব্যাংকে চাকরি করত। বীথি নামের একটা মেয়ে ছিল তাঁর কলিগ। ভাইজানের সঙ্গে বীথির বিয়ে ঠিক হলো। বরযাত্রী নিয়ে ভাইজান বিয়ে করতে গেল নরসিংদি। আমিও ছিলাম বরযাত্রীর দলে। মওলানা এসে বিয়ে পড়াতে গেল। মেয়ে বলল, না। আমি রাজি না! কবুল বলব না।কেন? কেন আমি জানি না। কেউ জানে না। ভাইজান ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নানান দুঃখধন্ধের মধ্যে পড়ল। শেষমেষ একটা স্কুল মাস্টারি জোগাড় করল। সারা জীবন বিয়ে করল না।বীথি মেয়েটা আমেরিকায় থাকে?

হ্যাঁ। বিয়ে করে অনেক দিন আগে চলে গেছে। শোন, যেভাবেই হোক ভাইজানের যাওয়া আটকাতে হবে। তাঁকে ঐ মেয়ের সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে দেওয়া হবে না।অবশ্যই। রাহেলা চাপা গলায় বলল, ভাইজান আলাভোলা মানুষ। যখন তখন অসুখবিসুখ বাধায়। ভাইজানকে তো আমি কিছুতেই বিদেশের মাটিতে ছাড়ব না।তাকে ছাড়া উচিতও হবে না।বাচ্চা হবার সময় আমি বাঁচি না মরি তার মাই ঠিক। তখন যদি ভাইজান কাছে না থাকে তার সঙ্গে তো আমার দেখাই হবে না।ঐ দিকটা আমি চিন্তা করি নি। আসলেই তো তোমার বাচ্চা হবার আগে কিছুতেই তাকে যেতে দেয়া হবে না। তুমি নিশ্চিত থাক।পৃথু জুতা পরে এসেছে। সে বাবার সামনে জুতার ফিতা বাঁধার পরীক্ষা দিয়ে বাঁ পায়ের জুতায় ফেল করল।

ডান পায়ের জুতায় পাশ করল। রফিক বলল, তুই একশতে পঞ্চাশ পেয়েছিস। এটা খারাপ না। ত্রিশ হলো পাস মার্ক। পাস মার্কের চেয়েও বিশ বেশি পেয়েছিস। চল এবার কফি খেয়ে আসি। রাহেলা তুমিও চল। হাঁটতে হাঁটতে যাই। কাছেই তো।রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। রফিক বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়–পৃথু যেহেতু কঠিন একটা পরীক্ষায় ফিফটি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে সেই উপলক্ষে চাইনিজ খেয়ে ফেললে কেমন হয়? অনেকদিন বাইরে খাওয়া হয় না।পৃথু বলল, খুব ভালো হয় বাবা।রাহেলা বলল, ভাইজানকে নিয়ে চল। তাকে ফেলে রেখে আমি চাইনিজ খেতে যাব না।রফিক বলল, কী বলো তুমি তাকে রেখে যাব না-কি? অবশ্যই তাকে নিয়ে যাব।

শামসুদ্দিন কিছুতেই বাইরে যেতে রাজি হলেন না। শেষে ঠিক হলো তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে আসা হবে।শামসুদ্দিন বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন। হঠাৎ করেই তার শরীর খারাপ করেছে। মাথার দুলুনি প্রবল হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকলে কম দোলে। উঠে বসলেই চারপাশের জগৎ দুলতে থাকে। মনে হয় তিনি নৌকায় বসে আছেন। নদীতে প্রবল ঢেউ উঠেছে। নৌকা দুলছে। নৌকার সঙ্গে তিনিও দুলছেন।কলিংবেল বাজছে। রফিকরা গিয়েছে আধঘণ্টাও হয় নি। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে? শামসুদ্দিন দেয়াল ধরে ধরে এগোলেন। দরজা খুললেন। দরজার ওপাশে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। যেন সে কোনো মানুষ না। প্রেতলোক থেকে ফিরে এসেছে। শামসুদ্দিন বললেন, জয়নাল, তোমার কী হয়েছে?

জয়নাল বিড়বিড় করে বলল, চাচাজি পানি খাব।ঘরে এসে বসো। পানি এনে দিচ্ছি! তোমার এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে।চাচাজি আমি পাসপোর্টটা হারিয়ে ফেলেছি।পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছ? জি। মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট দুটা এক সঙ্গে ছিল। পিক পকেট হয়ে গেছে।শামসুদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, এসো ঘরে এসে বসো। আমি পানি এনে দিচ্ছি। সারা দিন কিছু খাও নি, তাই না? জয়নাল জবাব দিল না। শামসুদ্দিন হাত ধরে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। পানি এনে খাওয়ালেন। তারপর গায়ে হাত রেখে বললেন, তুমি তোমার পাসপোর্টটা আমার কাছে রেখে গেছ। এটা ভুলে গেলে কীভাবে? জয়নাল এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে শামসুদ্দিনের কথা বুঝতে পারছে না। শামসুদ্দিন সুটকেস খুলে পাসপোর্ট বের করে জয়নালের হাতে দিলেন। জয়নাল পাতা উল্টে নিজের ছবি দেখে অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। শামসুদ্দিনের চোখে পানি এসে গেল। তিনি পরপর তিনবার বললেন–আহারে! আহারে! আহারে!

অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নড়ছে। জয়নাল উঠতে পারছে না। কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে, ডিমের ওমলেট হবে। কাঁচা তেলে ডিম ঢেলে দিলে তেলের গন্ধ থাকবে। তেল বেশি গরম হয়ে গেলে আবার ধক করে তেলে আগুন জ্বলে উঠবে। এই কড়াইটার হয়তো কোনো সমস্যা আছে। তেল সামান্য গরম হলেই আগুন লেগে যায়।জয়নাল বলল, কে? যে কড়া নাড়ছিল সে জবাব দিল না। আরো জোরে কড়া নাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে বাড়িওয়ালা কেয়ারটেকারকে পাঠিয়েছে। মাত্র দুমাসের বাড়ি ভাড়া বাকি, ব্যাটার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ঘন্টায় সুন্টায় লোক পাঠাচ্ছে। জয়নাল মনে মনে বলল, দূর কুত্তা। তেল মনে হয় গরম হয়েছে। সে ধীরেসুস্থে ডিম চলল। আজকের ওমলেটটা মনে হয় অসাধারণ হবে, কারণ ডিমে দুই চামচ দুধ দেয়া হয়েছে। ওমলেটটা সোনালি বর্ণ ধারণ করে ফুলে উঠছে।

এখন শুধু যে কড়া নড়ছে তা-না, দরজায় ধাক্কাও পড়ছে। জয়নাল তেমন পাত্তা দিল না। ওমলেট কড়াই থেকে নামিয়ে দরজা খোলার জন্যে রওনা হলো। কেয়ারটেকার ব্যাটাকে কী বলতে হবে মনে মনে ঠিক করে ফেলল। তাকে বলতে হবে – সোমবার সন্ধ্যাবেলায় এসে টাকা নিয়ে যাবেন। পাওনাদারদের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলে বুঝ দিতে হয়। পরে এসে টাকা নিয়ে যাবেন বললে এরা বুঝ মানে না। নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বললে বুঝ মানে।দরজা খোলার পর জয়নালের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ঘুরে হুড়মুড় করে সিড়িতে পড়ে যাবে। গড়াতে গড়াতে নেমে যাবে এক তলায়। কড়া নাড়ছে ইতি। ইতি না হয়ে যদি পিঠে ডানা লাগানো সত্যিকার কোনো পরী দেখত তাহলেও এত অবাক হতো না।ইতি বলল, আপনি কি এই গুহায় বাস করেন? এতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি দরজা খুলছিলেন না কেন? জয়নাল বলল, আমরি এই ঠিকানা কোথায় পেয়েছ?

আলম ভাইয়ের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। আপনি কি আমাকে দূরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবেন না ভেতরে ঢুকতে দেবেন? এসো, ভিতরে এসো।দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আমি কি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকব না-কি? জয়নাল এক পাশে সরল। তার মাথার চর এখনো ধামে নি। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা এখনো আছে। ইতি ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে চারদিক দেখছে।বেলা সাড়ে এগারোটার সময় ডিম ভাজছেন কেন? এটা আপনার সকালের নাশতা না-কি দুপুরের লাঞ্চ জয়নাল বলল, ওমলেট খাবে ইতি?

ইতি বলল, কী আশ্চর্য কথা, দুপুর সাড়ে এগারোটার সময় আমি ওমলেট খাব কেন? আপনি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না, একটা সার্ট গায়ে দিন। খালি গায়ে ঘুরছেনকুৎসিত লাগছে। লুঙ্গি এত উচু করে পরেছেন কেন? টেংরা টেংরা পা দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গি তো আর হাফপ্যান্ট না। লুঙ্গি পরতে হয় লুঙ্গির মতো।

জয়নাল খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। কী অবস্থা! পরীর চেয়ে দশগুণ সুন্দরী একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর সে কিনা খালি গায়ে হাঁটু পর্যন্ত উচু একটা লুঙ্গি পরে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। লুঙ্গি নামাতে যাওয়াও এখন ঠিক হবে না। হাত যেভাবে কাপছে লুঙ্গির গিট খুলতে গিয়ে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আগে লম্বা একটা পাঞ্জাবি পরা দরকার। ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি দুটা থাকার কথা। এখন হয়তো পাঞ্জাবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা বিপদ যখন আসে তখন সেই বিপদের লেজ ধরে আরেকটা বিপদ আসে। দেখা যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িওয়ালা কেয়ারটেকারকে পাঠাবে। সেই কুত্তা কেয়ারটেকার ইতির সামনেই বাড়িভাড়া নিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করবে।জয়নাল বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন ইতি, বসো। চা খাবে?

ইতি বসতে বসতে বলল, না।কোক পেপসি এইসব কিছু খাবে? আনিয়ে দিই? কিছু আনিয়ে দিতে হবে না। আপনি আমাকে দেখে এত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কেন? তুমি আসবে ভাবি নি তো।ইতি বসতে বসতে বলল, আপনার গুহা খুবই অদ্ভুত, কিন্তু সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন। সুন্দর একটা পেইন্টিংও দেখি আছে। পেইন্টিংটা কার? আমার এক বন্ধুর আঁকা। আর্ট কলেজে পড়ত, থার্ড ইয়ারে উঠে পড়া ছেড়ে দিল।কেন? মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। এখন গাঁজা-টাজা খায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ওর নাম আবদুর রহমান।উনার ছবিটা তো অসম্ভব সুন্দর। আমি ছবি থেকে চোখ ফেরাতে পারছি। ছবির মেয়েটা কে?

ইতি একদৃষ্টিতে ছবি দেখছে এটা একটা ভালো সুযোগ। জয়নাল ইতির পেছনে দাঁড়িয়ে অতি দ্রুত কাপড় বদলাচ্ছে। তার ভাগ্য ভালো, মেরুন রঙের ইস্ত্রি-করা পাঞ্জাবিটা পাওয়া গেছে। এই পাঞ্জাবিটাতেই তাকে সবচে সুন্দর মানায়। কালো প্যান্টের সঙ্গে মেরুন কালারের পাঞ্জাবি।ছবির মেয়েটা কে আমি জানি না। রহমানের কাছ থেকে ছবিটা কিনেছিলাম।কত দিয়ে কিনেছেন? রহমানের মাথা খারাপ তো! ছবির দাম উল্টা-পাল্টা লিখে রেখেছিল। পনেরো হাজার লেখা ছিল। আমি তাকে দুপ্যাকেট বেনসন সিগারেট দিয়ে ছবি নিয়ে চলে এসেছি।

কী বলেন আপনি! বন্ধু মানুষ তো! কিছুক্ষণ কাউ কাউ করে বলেছে- যা ছবি নিয়ে ভাগ। একদিন দেখবি এই ছবিই আট-দশ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবি। ছাগলটা নিজেকে কী যে ভাবে!যে এত সুন্দর ছবি আঁকে সে নিজেকে কিছু একটা ভাবতেই পারে।ইতি এখনো ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। জয়নালও এবার আগ্রহের সঙ্গে তাকাল। রহমানের ছবি নিয়ে এসে সে তার ঘরে টানিয়ে রেখেছে ঠিকই কোনোদিন এইভাবে দেখা হয় নি। জঙ্গলের ছবি। শীতকালের জঙ্গল। গাছের পাতা বিবর্ণ। বেশিরভাগ গাছেরই পাতা ঝরে গেছে। আবার কুয়াশাও আছে। পনেরো-ষােল বছরের এক গেঁয়ো মেয়ে জঙ্গলে এসেছে শুকনা পাতা এবং খড়ি টোকাতে। তার হাতে ভারি খড়ির বোঝা।

তার মুখটা এমনভাবে আঁকা যেন মনে হয় সে তার সামনের একজনকে বলছে, বোঝাটা খুব ভারি। কষ্ট করে আমার মাথায় তুলে দিন তো!ইতি বলল, আবদুর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবেন।জয়নাল বলল, তার সাথে অনেক দিন দেখা হয় না। যদি দেখা হয় ধরে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাব।এটা জয়নালের মুখের কথা। আবদুর রহমানকে সে কোনোদিনও ইতির বাসায় নিয়ে যাবে না। ইতি চ্যান বেঙ টাইপ মেয়ে, যে-কোনো ছেলের সাথে তার ইয়ে হয়ে যেতে পারে।ইতি বলল, আমি খুঁজে খুঁজে আপনার ঠিকানা বের করে কেন এসেছি বলুন তো? কেন এসেছ?

আপনাকে দুটা খবর দিতে এসেছি। একটা খারাপ খবর একটা ভালো খবর। কোনটা আগে বলব? খারাপ খবরটাই আগে বলে।আগে খারাপ খবর শুনলে ভালো খবর শুনতে চাইবেন না। খারাপ খবরটা আগে বলব? হুঁ।খারাপ খবর হচ্ছে আমাদের ফ্যামিলিতে আপনাকে নিয়ে ডিসকাশন হয়েছে। ফ্যামিলির সবার সিদ্ধান্ত আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না।ও, আচ্ছা! আমার খালু সাহেব আপনার সম্পর্কে কী বলেছেন জানেন? উনি বলেছেন–ঐ ছেলে বিরাট ধান্ধাবাজ। আমেরিকায় পৌঁছে হয় সে গ্যাস স্টেশনে কাজ নিবে, গাড়িতে তেল ভরবে, আর নয়তো হোটেলে থালাবাসন মাজবে। দেশে চিঠি লিখবে আমি ডিসি পোস্ট পেয়েছি। অর্থাৎ ডিস ক্লিনার। এই ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া আর মেয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে ইছামতি নদীতে ফেলে দেয়া এক জিনিস।জয়নাল বলল, এত নদী থাকতে ইছামতি নদীর কথা আসল কী জন্যে?

ইতি বলল, খালু সাহেবের বাড়ি ইছামতি নদীর পাড়ে, এই জন্যে ইছামতি নদীর কথা এসেছে।ও, আচ্ছা!আর আমার মা বলেছেন, বাপ-মা মরা এতিম ছেলে। এতিমকে সাহায্য করা যায়, এতিমের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না।ও, আচ্ছা! আর আমার বাবা আপনার সম্পর্কে বলেছেন–ফাজিল টাইপ ছেলে, সারাক্ষণ কথা বলে, এমন ভাব ধরে কথা বলে যেন দুনিয়ার সব কিছু জানে। এর কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। চালবাজ জামাই আমার পছন্দ না। এই হলো খারাপ সংবাদ। এখন ভালো সংবাদটা শুনবেন? এর পরে ভালো সংবাদ আর কী থাকবে?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *