আজ চিত্রার বিয়ে পর্ব:০৮ হুমায়ূন আহমেদ

আজ চিত্রার বিয়ে পর্ব:০৮

শায়লা টেলিফোন রেখে খাবার ঘরের দিকে এগুলেন। রহমান সাহেব কাপড় পরছেন। রাতে তাঁর চেহারায় যে অস্বাভাবিকতা ছিল, এখন তা নেই। শায়লা বললেন, কোথায় যাচ্ছ? রহমান সাহেব বললেন, কোথায় আর যাব? অফিসে যাচ্ছি।তুমি বোধ হয় জান না, আজ চিত্রার এনগেজমেন্ট হবে না। সরাসরি বিয়ে হয়ে যাবে।জানি।শায়লা অবাক হয়ে বললেন, জনি মানে? কে বলেছে? চিত্রা বলেছে। ও তার স্যুটকেস গুছিয়ে রেখেছে।শায়লা বানু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মেয়ে তাঁকে কিছুই বলে নি অথচ ঠিকই তার বাবাকে বিয়ের খবর দিয়েছে। সুটকেস গুছিয়ে রেখেছে। হয়তো দেখা যাবে মীরাও সব জানে। শুধু তিনিই কিছু জানেন না।শায়ালা বললেন, আমি তোমার অফিসে যাবার দরকার নেই।ছুটি নিয়ে আসিনি তো।মেয়ের বিয়ের জন্যে একদিন অফিস কামাই করতে পারবে না? এমনই কঠিন তোমার অফিস?

খবর্দার তুমি অফিসে যাবে না।রহমান সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি অফিসে গিয়ে ছুটি নিয়ে আসি? এক ঘণ্টা লাগবে। যাব আর আসব।যেতেই হবে? এক ঘন্টার মধ্যে চলে আসব।শায়লা তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিত্রার খোঁজে গেলেন। যে মেয়ের আজ বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেই মেয়েকে কঠিন কোনো কথা বলা মোটেই ঠিক হবে না। তারপরেও তিনি জানতে চাইবেন— এত বড় একটা খবর তাকে না দিয়ে সে তার বাবাকে কি কারণে দিল। হঠাৎ করে তিনি কেন এত গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেন? চিত্রা সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। খুব বেশি সাজগোজ সে কখনো করে না। আজ একটু সেজেছেও। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে। চোখে কাজল। গালে হালকা পাউডার। মনে হচ্ছে সে বাইরে কোথাও যাচ্ছে, তারই প্রস্তুতি।শায়লা অবাক হয়ে বললেন, তুই কোথায় যাচ্ছিস?

চিত্রা বলল, যেখানেই যাই এগারোটার আগেই চলে আসব মা।শায়লা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তুই এগারোটায় আসবি না, রাত দশটায় আসবি তা তো জানতে চাচ্ছি না। আমি জানতে চাচ্ছি তুই যাচ্ছিস কোথায়? বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি।আজ তুই কোথাও বের হতে পারবি না।কেন? বিয়ের দিন কনে ঘর থেকে বের হতে পারে না। নিয়ম নেই।চিত্রা হাসি মুখে বলল, পুরনো কালের নিয়ম-কানুন এখন কেউ মানে না মা। বিয়ের দিন কনেকে ঘর থেকে বের হতে হয়। পার্লারে গিয়ে চুল বাঁধতে হয়।আমি তোর সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। তুই ঘর থেকে বের হবি না।মা আমিও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। আমাকে যেতেই হবে। খুবই জরুরি।যেতেই হবে?

হ্যাঁ, যেতেই হবে। আমাকে ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি যাবই।শায়লা আহত গলায় বললেন, তাহলে অপেক্ষা কর তোর বড় গলা আসুক। বড় খালার গাড়ি নিয়ে যাবি। তোর সঙ্গে মীরা যাবে।মীরা কি আমার পাহারাদার? তুই যা ভাবার ভেবে নে। মীরা অবশ্যই তোর সঙ্গে যাবে।মা শোন, তুমি রেগে যায়। লেগে যাবার মতো কিছু হয় নি। আমি বড় বালার গাড়ি নিয়ে কোথাও যাব না। রিকশা নিয়ে যাব। এবং অবশ্যই মীরাকে সঙ্গে নেব না। তুমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছ।আমি ভয় পাব কেন?

অবশ্যই তুমি ভয় পাচ্ছ। ভয়ে তোমার চোখ ছোট হয়ে গেছে। ভয়টা দূর কর মা। গল্প উপন্যাসে দেখা যায় যে দিন বিয়ে সেদিন সকালবেলা মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করে। এই কাজ আমি কখনো করব না। আমি যখন বলছি এগারোটার মধ্যে ফিরব। অবশ্যই ফিরব। এখন আমাকে একটু সাহায্য কর তো মা, দেখ তো টিপটা যে দিয়েছি টিপটা কি মাঝখানে হয়েছে? শায়লা কিছু না বলে চলে গেলেন। তার চোখে পানি এসে গেছে। চোখের পানি তিনি মেয়েকে দেখতে চান না। তার খুবই মন খারাপ লাগছে। সংসারে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে। অথচ তিনি একা সংসারকে বুকে আগলে এই অবস্থায় এনেছেন।মীরা আজ স্কুলে যায় নি। শায়লা তাকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছেন। ঘরে নানান কাজকর্ম আছে। মীরার সাহায্য দরকার। অথচ মীরা কাজ করার কিছু পাচ্ছে না। সব কাজকর্ম আগেই গোছানো। কাজ খুঁজে নিয়ে কাজ করার মতো মেয়ে মীরা না।

তার ইচ্ছা করছে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে পড়তে শুরু করা। এই কাজটা করার সাহস হচ্ছে না। মা খুব রাগ করবেন। বেশি রেগে গেলে হাত থেকে টান দিয়ে বই ছিঁড়ে ফেলবেন। মীরা ঘর থেকে বের হল। তার হাতে শীর্ষেন্দুর একটা বই— ঘুনপোকা। বারান্দার কোনো আড়াল বের করে বই পড়তে শুরু করতে ইচ্ছা করছে। বাগান বিলাস গাছটার আড়ালে বসা যায়। বাগান বিলাসের আড়ালে বসলে চট করে মা তাকে দেখতে পাবেন না। অথচ মা ডাকলেই সে শুনতে পাবে। তবে গাছ ভর্তি শুয়োপোকা। গায়ে শুয়োপোকা না উঠলেই হল।মীরা কি করছ।মীরা চমকে উঠল। মজনু ভাই। নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়ে চমকে দিয়েছে। মীরা গম্ভীর গলায় বলল, কি ব্যাপার? তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি।কি জিনিস?

কাঁঠালচাপা ফুল। তীব্র গন্ধ। শাহবাগের মোড়ে বিক্রি করছিল দুটাকা পিস। আমি দরদাম করে তিনটা কিনেছি পাঁচ টাকায়। ফুলটার এমন গন্ধ–আধমাইল দূর থেকে পাওয়া যায়।মীরা একবার ভাবল ফুল নেবে না। তারপরেও নিল।মজনু বলল, একটা গ্রাস ভর্তি করে পানি নাও–তার ওপর ফুলগুলি দিয়ে রাখ— দেখ কি গন্ধ হয়। দেখবে গন্ধে মাথা ধরে যাবে।যে গন্ধে মাথা ধরে যায় সেই গন্ধ শুঁকে লাভ কি? কথার কথা বললাম, গন্ধে তো আর সত্যি মাথা ধরে না।মীরা বলল, আচ্ছা মজনু ভাই, আপনি কি আমাদের বাসার টেলিফোন নাম্বার জানেন? মজনু বলল, হ্যাঁ জানি। তোমাদের টেলিফোন নাম্বার জানি। চিত্রার মোবাইল টেলিফোনের নাম্বারও জানি। কখন কোন দরকার হয়। চিত্রার আজ এনগেজমেন্ট না?

হ্যাঁ।চাচিকে বল যে আমি আজ সারাদিন ফ্রি করে রেখেছি। যে কোনো কাজে আমি আছি। আমার পরিচিত এক ডেকোরেটর আছে তাকে বললেই আধঘণ্টার মধ্যে মরিচ বাতি দিয়ে গেট সাজিয়ে দেবে। অন্যেরা যা নেয় তার অর্ধেক চার্জ করলে। যাও চাচিকে জিজ্ঞেস করে এসো।মা মরিচবাতির গেট করাবে না। কাজেই জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।তবু জেনে আস। প্লেট থালা জগ এইসব লাগবে কি-না। তার কাছে সব লেটেষ্ট ডিজাইনের থালা বাসন।মীরা বলল, মজনু ভাই আপনাকে একটা উপদেশ দেই শুনুন। আজ মার মেজাজ খুবই খারাপ। আপনি দয়া করে মার সামনে পড়বেন না। উনি আপনার ওপর রেগে আছেন।আমার ওপর রেগে আছেন কেন?

আপনি খুব ভালো করেই জানেন কেন? আপনি প্রায়ই বাসায় টেলিফোন করেন। করেন না।মনুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে চোখ নামিয়ে নিল। এতক্ষণ সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই মীরার সঙ্গে কথা বলছিল। এখন আর বলতে পারছে না। তার কপাল ঘামছে।মীরা বলল, নিজের পরিচয় না দিয়ে দিনের পর দিন টেলিফোন করা কি ঠিক? মজনু বলল, ঠিক না।কেন আপনি টেলিফোন করেন? মজনু বলল, তুমি টেলিফোনে খুব সুন্দর করে হ্যালো বল। এটা শোনার জন্যে কথা বলি। তুমি হ্যালো বলার পরই আমি টেলিফোন রেখে দেই।

মীরা কঠিন গলায় বলল, বাজে কথা বলবেন না। আপনি হড়বড় করে অনেক কথা বলেন। নিজের নাম মজনু, আমাকে লাইলী বানিয়ে প্রেমের রেলগাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। আমি বোকা মেয়ে না। আমার সঙ্গে চালাকি করতে যাবেন না। মজনু ফিসফিস করে বলল, আর কোনোদিন টেলিফোন করব না।কথাবার্তার এই পর্যায়ে শায়লা বের হয়ে এলেন। তিনি মেয়ের হাতের কাঁঠালচাপা ফুল দেখলেন, মজনুকে দেখলেন। অতি দ্রুত দুই এর সঙ্গে দুই যোগ করে চার করলেন। মজনুর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, মজনু তোমার ভাই নিজাম সাহেব কি অফিসে চলে গেছেন না এখনো বাসায় আছেন? মজনু চাপা গলায় বলল, বাসায় আছেন।তুমি তোমার ভাইকে পাঠিয়ে দাও তো। আমার দরকার আছে।মজনু মনে হল হাঁপ ছেড়ে বাচল। সে প্রায় দৌড়ে গেল তার ভাইকে খবর দিতে।

ভাড়াটে হিসেবে নিজাম সাহেবকে শায়লা পছন্দ করেন। চুক্তিপত্রে আছে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভাড়া দিতে হবে, নিজাম সাহেব তিন তারিখের আগেই বাড়ি ভাড়া শোধ করে দেন। বাড়ির টুকিটাকি রিপেয়ারিং এর জন্যে বাড়িওয়ালার কাছে ধন্যা দেন না। নিজেই মিস্ত্রী ডাকিয়ে সারিয়ে নেন। গত মাসে মিস্ত্রি ডাকিয়ে কলের লিক সারালেন। এবং মিস্ত্রিকে নিয়ে শায়লার কাছে এসে বললেন, ভাবী আপনাদের পানির কলে কোনো সমস্যা থাকলে সারিয়ে নিন। আমার চেনা মিস্ত্রী। ভালো কাজ করে। এ রকম ভাড়াটে পাওয়া ভাগ্যের কথা।নিজাম সাহেব বসার ঘরে ঢুকে হাসি মুখে বললেন, ভাবী কোথায়? অফিসে যাবার মুখে জরুরি তলব। ভাড়া বাড়াচ্ছেন না-কি? শায়লা বললেন, চা খাবার জন্যে ডেকেছি ভাই। ভাপা পিঠা করেছি। ভাপা পিঠা দিয়ে এক কাপ চা খান।বাড়ি ভাড়া তাহলে বাড়ছে না? যাক বাঁচলাম। আপনার মেয়ের না-কি আজ এনগেজমেন্ট?

শায়লা বললেন, আপনার মেয়ে বলছেন কেন ভাই? মেয়ে তো আপনারও।নিজাম সাহেব বললেন, আপনি খুবই ভাগ্যবতী মহিলা। আমার স্ত্রীর কাছে ছেলে সম্পর্কে শুনেছি। ভাগ্যগুণেই শুধু এমন ছেলে পাওয়া যায়।দোয়া করলেন ভাই।অবশ্যই দোয়া করি। ঘাস দিলে দোয়া করি।আপনি কিন্তু আমার মেয়ের এনগেজমেন্টের সময় উপস্থিত থাকবেন। অফিস শেষ করে সোজা বাসায় চলে আসলেন।রোজই তো তাই আসি। আজ না হয় আরো ঘন্টাখানিক আগে চলে আসব। আর মজনুকে বলে যাচ্ছি যে কোনো কাজ ঘর ঝাঁট দেয়া থেকে শুরু করে বাথরুম পরিষ্কার সব ওকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। কোনো সমস্যা নেই।

শায়লা চায়ের কাপ নিজাম সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সহজ গলায় বললেন, মজনু সম্পর্কে একটা কথা বলার জন্যে আপনাকে ডেকেছি ভাই। আপনাকে আমি খুব কাছের মানুষ মনে করি বলেই বলছি। আপনার সঙ্গে ভাড়াটে বাড়িওয়ালা সম্পর্কে থাকলে কখনো বলতাম না।নিজাম সাহে চিন্তিত গলায় বললেন, ঘটনা কি? শায়লা বললেন, ঘটনা খুবই সামান্য। আপনার কানে তোলার মতো কোনো ঘটনাই না। কিন্তু আমার ছোট মেয়েটা খুবই নরম টাইপের। সে দারুণ আপসেট। এই জন্যেই আপনাকে বলা।ব্যাপারটা বলুন তো ভাবী। ঘটনা মনে হয় কিছুটা আঁচ করতে পারছি। ঐ শুয়রের বাচ্চা মীরা মা-মণির কাছে প্রেমপত্র পাঠিয়েছে।প্রায় সে রকমই। তবে প্রেমপত্র না–মজনু প্রায়ই বাসায় টেলিফোন করে। মীরা টেলিফোন ধরলে–আজেবাজে কথা বলে। অশ্লীল কথা।বলেন কি?

শায়লা বললেন, ভাই এটা কোন বড় ব্যাপার না। মেয়ে বড় হলে এরকম সমস্যা বাবা-মাকে পোহাতেই হয়। আপনাকে ব্যাপারটা জানতামই না। আপনাকে খুব কাছের মানি জানি বলেই বলছি। ভাই আরেকটা ভাপা পিঠা দেই।দিন আরেকটা পিঠা খাই। শরীরে শক্তি করে নেই। তারপর দেখেন কি করি। আজ আমি এই শুয়োরের বাচ্চার পটকা গেলে ফেলব। ওর কিছু উপকার করব বলে সেরে নিয়ে এসেছিলাম। উপকারের ঘাড়ে লাথি। বাজারের পয়সা মারা। বিল দেয়ার জন্যে টাকা দিয়ে পাঠালে, বাসায় ফিরে এসে বলে টাকা পকেট মার হয়েছে, এতো নৈমিত্তিক ঘটনা। এখন আবার হয়েছে প্রেম কুমার। ছাল নাই কুত্তার বাঘের মতো ডাক। ডাক আমি বের করছি।শায়লা বললেন, একটু ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দিলেই হবে।

নিজাম সাহেব বললেন, শাস্তির ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন ভাবী। শাস্তি নিয়ে কিছু বললে আমি খুবই মাইন্ড করব।নিজাম সাহেব খুব আয়োজন করেই শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। মীরাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে একশ এক বার কান ধরে উঠ-বোস। প্রতিবার উঠবোস করার সময় মুখে বলতে হবে মীরা আমার মা।শাস্তি পর্ব শুরু হয়েছে। মজনুর  হাত-পা কাঁপছে। চোখ লাল। শরীর দিয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছে। সে উঠবোস করছে বিড়বিড় করে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলছে— মীরা আমার মা। মীরা আমার মা। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে নিজাম সাহেব উঠ-বোসের হিসাব রাখছেন, ছয়-সাত-আট-নয়-দশ-এগারো…।

শায়লা রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। মীরা তার কাছে ছুটে গিয়ে বলল, মা এসব কি হচ্ছে? মজনু ভাইকে কান ধরে উঠবোস করাচ্ছে। মা প্লিজ বন্ধ কর। মা আমি তোমার পায়ে পড়ি।শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, ন্যাকামী করবি না। ন্যাকামী করার মত কিছু হয় নি। শাস্তি পাওয়া দরকার ছিল, শাস্তি হচ্ছে।মা প্লিজ, প্লিজ।শায়লা কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মীরা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল। তার ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। সে দরজার দিকে একঝলক তাকালো। গেটের বাইরে অনেক লোকজন জড় হয়েছে। সবাই খুব মজা পাচ্ছে। মীরা মজনুকে দেখতে পাচ্ছে না, তবে নিজাম সাহেবের গলার স্বর শুনতে পারছে— একত্রিশ, বত্রিশ, তেত্রিশ, চৌত্রিশ… একশ হতে আরো অনেক বাকি।

টেলিফোন বাজছে। মীরা টেলিফোনের কাছেই বসে আছে। তার টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। সে মনে মনে একটা প্রতিস্থা করেছে— জীবনে কখনো টেলিফোন ধরবে না। শায়লা রান্নাঘর থেকে বললেন, মীরা টেলিফোন ধর।মীরা টেলিফোন ধরল। তার সারা শরীর দিয়ে বরফের মতো শীতল কিছু বয়ে গেল। সেই ছেলেটা না বলছে।হ্যালো মীরা তুমি কেমন আছ? ভালো।আজ তো তোমার বোনের এনগেজমেন্ট, দেখছ তোমার সব খবর প্লাশি। আচ্ছা তুমি কি এনগেজমেন্টের উপলক্ষে শাড়ি পরবে? জানি না।অবশ্যই জান— ধুধু আমাকে বলতে চাচ্ছ না।

মীরা টেলিফোন রেখে দিল। সে মস্ত বড় একটা ভুল করেছে। টেলিফোন যার সঙ্গে তার কথা হয় সে মজনু ভাই না। অন্য কেউ। মজনু ভাই ও টেলিফোন করে কিন্তু সে হ্যালো শুনেই রেখে দেয়। মীরার শরীর কাঁপছে। সে কি করবে? নিজেই বারান্দায় ছুটে গিয়ে বলবে–নিজাম চাচা যথেষ্ট হয়েছে। আর না। এটা সে বলতে পারবে না। তার এত সাহস নেই। আপা থাকলে বলতে পারত। আপাকে দেখে মনে হয় সাহস নেই। কিন্তু তার অনেক সাহস।নিজাম সাহেবের গলা শোনা যাচ্ছে। সত্তুর, একাত্তুর, বাহাত্তুর…। মজনু ভাই তার সঙ্গে বিড়বিড় করছেন, মীরা আমার মা। মীরা আমার মা। তবে এখন আর আমার শব্দটা শোনা যাচ্ছে না। এখন শোনা যাচ্ছে–মীরা মা। মীরা মা। আবারো টেলিফোন বাজছে। সেই ছেলে নিশ্চয়ই আবারো টেলিফোন করেছে। শায়লা রান্নাঘর থেকে ধমক দিলেন— মীরা টেলিফোন ধরছিস না কেন?

মীরা টেলিফোন ধরল। তার মাথা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। টেলিফোনে কে কথা বলছে, কি বলছে–কিছুই বুঝতে পারছে না। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ছাদ থেকে কে যেন লাফ দিয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। মীরা বলল, জ্বি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা। ওপাশ থেকে কে যেন বলল, এটা কি রং নাম্বার হয়েছে? মীরা তার উত্তরেও বলল, জ্বি আচ্ছা।মীরার সমস্ত মনোযোগ বারান্দায়।সেখানে শাস্তি পর্ব শেষ হয়েছে। নিজাম সাহেব বলছেন যে ভাবে এক বস্ত্রে আমার বাসায় উঠেছিলি— ঠিক সেই ভাবে এক বস্ত্রে এখন বের হয়ে যাবি। গেট খুলে বের হয়ে যাবি। পেছন দিকে ফিরে তাকাবি না। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষার কথা এতদিন শুধু বই-এ পড়েছি। আজ দেখলাম বাস্তবে।মীরা জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মজনু ভাই চলে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা সে দেখতে চাচ্ছে। মানুষটা গেট দিয়ে বের হবার সময় একবারও কি পেছন ফিরে তাকাবে না? রহমান সাহেব ছুটির দরখাস্তু নিয়ে নিজেই বড় সাহেবের কাছে গেলেন। বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, স্যার আজ আমার মেয়ের বিয়ে।বড় সাহেব বললেন, মেয়ের বিয়ে?

Read more

আজ চিত্রার বিয়ে পর্ব:০৯ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *