গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল এবং গৌর করিবার অব্যর্থ উপায়।
পুন্নাগের কচি ফল দিয়া ক্বাথ প্রস্তুত করিতে হইবে। উক্ত কুাথ জ্বাল দিয়া ভাসমান তৈল পাওয়া যাইবে। উক্ত তৈল সর্বাঙ্গে মাখিতে হয়। পুন্নাগের আরেক নাম রাজচম্পক।
রামায়ণ মহাকাব্যে পুন্নাগের সুন্দর বর্ণনা আছে। রাবণ সীতাকে হরণ করিবার পরের অংশে আছে রাম, ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়া বিষন্ন মনে হাঁটিতেছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়িল পুন্নাগ পুষ্পের
মেলা
তিল্লকাশােক পুন্নাগ বকুলােদ্দাল কামিনী
রম্যোপবন সম্বাধীং পদ্মসম্পীড়িতে কাম। নােট : আমি পুন্নাগ তৈল প্রস্তুত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। কথি জ্বাল দিলে তৈল প্রস্তুত হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোনাে প্রক্রিয়া। আছে।
বৈদ্যদের নথিতে গাত্র বর্ণ ঔজ্জ্বল্যের নিমিত্ত রক্তচন্দন, অনন্তমূল এবং মঞ্জিষ্ঠার উল্লেখ আছে। তবে পুন্নাগের সমকক্ষ কেহ নাই ইহা বারংবার বলা হইয়াছে।
পুন্নাগ প্রসঙ্গে আরাে কোনাে কৌতূহলদ্দীপক তথ্য পাইলে লিপিবদ্ধ করা হইবে।
এই পর্যন্ত লেখার পর দুটি পাতা খালি। কিছুই লেখা নেই। তৃতীয় পাতায় দিনক্ষণ দিয়ে তারা দর্শনের বর্ণনা।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
অদ্য ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ২০শে মে মধ্যরজনী। বিভূতিবাবু হিসাব অনুযায়ী অদ্য রজনী দশ ঘটিকায় সারমেয়। যুগল মধ্যগগনে অবস্থান করিবে। সারমেয় যুগল দর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করিয়াছি। কন্যাদের মাতাকে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিবার জন্যে বলিয়াছিলাম। তিনি শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত বলিয়া অপারগতা প্রদর্শন করিলেন। কিঞ্চিৎ ব্যথিত হইয়াছি। জগতের কোনাে মনােমুগ্ধকর দৃশ্য একা উপভােগ করা যায় না।
আকাশ পরিষ্কার আছে। সন্ধ্যাকালে মেঘ ছিল— এখন মেঘ দূরীভূত হইয়াছে। ঈশ্বরের অসীম কৃপা।
বিভূতিবাবুর পত্রানুযায়ী সারমেয় যুগলের একটির গলায় এই মণ্ডলের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারকাটি অবস্থিত। এই তারকাটির প্রভা তৃতীয় মাত্রার। তারকাটির নাম চার্লসের হৃদয়। সম্রাট প্রথম চার্লসের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই নামকরণ।
সারমেয় যুগলের উল্লেখ বেদে আছে। ইহাদের বলা হইয়াছে যমের দুয়ারের প্রহরী। এই মণ্ডলের দুইটি উজ্জ্বল তারকার একটির ভারতীয় নাম জ্যেষ্ঠ কালকজ্ঞ আরেকটির নাম কনিষ্ঠ কালকজ্ঞ। জ্যৈষ্ঠ কালকজ্ঞ একটি বিষম তারা এবং অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত। যে চারটি তারা দিয়া কন্যার হীরক নামক বিখ্যাত চিত্রটি গঠিত জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ তার একটি।
আজ সারমেয় যুগল দেখিবার সৌভাগ্য যেন হয় তার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিয়াছি।
মিসির আলি দ্রুত পাতা উল্টালেন। ডায়েরিতে বিচিত্র সব বিষয়ে লেখা আছে। জ্যামিতিক চিহ্ন আছে। তার ব্যাখ্যা আছে। জায়গায় জায়গায় টীকা–টিপ্পনি আছে। যেমন জ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে জ্ঞান।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
জ্ঞান দুই প্রকার। পবিত্র জ্ঞান এবং অপবিত্র জ্ঞান। অপবিত্র জ্ঞান ঈশ্বর কর্তৃক অনুমােদিত। আদি মানব আদমের পতন হইয়াছিল ঈশ্বর কর্তৃক অনুমােদিত জ্ঞান আহরণের জন্যে। অনুমােদিত জ্ঞান অতীব রহস্যময় জ্ঞান। যদিও পরিত্যাগ লাভের
জন্যে এই জ্ঞানের প্রয়ােজন নাই ।পুন্নাগ ফুলের কথা কয়েক পাতা পরেই আবার পাওয়া গেল।
পুন্নাগ সৌরভ্যং ভুবন এয়েহপি বিদিতং পুষ্পেষু লােকোত্তরং কীৰ্ত্তিঃ কিঞ্চ দিগঙ্গনাঙ্গণগতা কিস্তৃেতদেকংশৃনু। সর্বান্যেব গুণানি যন্নিগিরতি পুন্নাগে তে সুন্দরা।
উজঝণ্ডি খলু কোটরেষু গরল জ্বালাদ্বিজিহ্বালী। অর্থ : হে পুন্নাগ, তােমার সুগন্ধ ত্রিভুবন খ্যাত। তােমার যশ ও খ্যাতি দিগাঙ্গনারা নিজ অঙ্গনে ছড়াইয়া রাখে। তবু তােমার
একটি অখ্যাতি। তোমার শরীরের কোটরে বাস করে বিষধর সর্প।
নােট : পুন্নাগ বৃক্ষের কোটরে বিষধর সর্প বাস করে এই তথ্য জানা ছিল না। হায় এই বিপুল বসুধার কত অল্পই না আমি জানি!
দরজায় খট খট শব্দ হচ্ছে। বই নামিয়ে মিসির আলি বললেন, কে ?
চাচাজি আমি লিলি। আপনার কিছু লাগবে?
আমার কিছু লাগবে না। আপনার ঘরের ছিটকিনি বরকতকে ঠিক করতে বলেছিলাম। বরকত কি ঠিক করেছে?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
হ্যা ঠিক করেছে। ছিটকিনি লাগিয়েছেন?
ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুমুবেন। ভুলবেন না যেন। কুকুরগুলি মাঝে মাঝে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে এই জন্যে বলছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখেন আপনার মাথার কাছে এলশেশিয়ান তাহলে ভয়েই হার্টফেল করবেন।
অবশ্যই ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুমাব। তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন? ভেতরে এসাে।
আপনি আসতে বলছেন না, এই জন্যে আসতে পারছি না। আমি আপনার জন্যে পান নিয়ে এসেছি।
এসাে ভেতরে এসাে। লিলি পানের বাটা হাতে ঘরে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে দূরবীনওয়ালা। আমার দায়িত্ব হলাে আপনাকে জাগিয়ে রাখা।
কেন বলতাে?
দূরবীনওয়ালার ধারণা হয়েছে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হবার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে তখন তারা দেখা যাবে। বৃষ্টির পর আকাশ না–কি ঝকঝকে হয়ে যায়। তখনই তারা দেখার আসল মজা।
ও আচ্ছা।
আপনি একবার ঘুমিয়ে পড়লেতাে আর আপনাকে জাগানাে ঠিক হবে না। তাই আপনাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা। এখন বলুন কি করলে আপনি জেগে থাকবেন?
জেগে থাকা আমার জন্যে কোনাে সমস্যা না। আমি অনেক রাত জাগি। তুমি আমাকে জেগে থাকতে বলেছ আমি জেগে থাকব।
অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ছেন ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
মরা মানুষের ডায়েরি পড়ে লাভ কি বলুনতাে ? মানুষটাতাে মরেই গেছে। এরচে‘ জীবিত মানুষের ডায়েরি পড়া ভালাে। আপনি এত আগ্রহ করে পুরনাে ডায়েরি পড়েন জানলে আমি ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতাম । চাচাজি নিন পান
খান।
মিসির আলি পান হাতে নিলেন । লিলি চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসেছে। তাকে ক্লান্ত লাগছে। পর পর দু’বার হাই তুলল। মিসির আলি বললেন, তােমার ঘুম পাচ্ছে তুমি ঘুমিয়ে পড়। সুলতানকে বলে রেখো বৃষ্টি কমলে যেন আমাকে খবর দেয় আমি জেগে থাকব।
আমার সঙ্গে গল্প করতে আপনার ভালাে লাগছে না তাই না ? আপনার মন পড়ে আছে অশ্বিনী বাবুর লেখাতে। ঠিক বলছি না চাচাজি ? মিসির আলি বললেন, ডায়েরিটা পড়ে শেষ করতে ইচ্ছা হচ্ছে এটা ঠিক । তার মানে এই না যে তােমার সঙ্গে কথা বলতে ভালাে লাগছে না। তুমি খুব গুছিয়ে কথা বল।