আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৬)-হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি

মাস্টারকে প্রায়ই দেখি কুয়ার ওপর বসে থাকেআচমকা ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে কুয়ার ভেতর ফেলে দিবিপারবি না ?

আমিই মিসির আলিপারার কী আছে? এক ধাক্কায় সব সমস্যার সমাধানখুবই গহিন কুয়ানিচে বিষাক্ত গ্যাসএকবার পড়লে আর দেখতে হবে নাকাজটা যে তুই করেছিস সেটাও কেউ বুঝবে নাভাববে নিজে নিজে পড়ে গেছেআমার অবশ্যি ধারণা কেউ কোনােদিন জানবেও না যে এইখানে একজন মানুষ পড়ে আছে। 

মন্দিরের ভেতরের স্মৃতি এরপর আর আমার কিছু মনে নেইহয়তাে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলামএই ঘটনার তৃতীয় দিনের দিন আমি মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারকে ধাক্কা দিয়ে কুয়ায় ফেলে দেইকুয়াটা খুব গভীর তাে বটেই ধাক্কা দেয়ার অনেক পরে ঝপাং শব্দটা কানে আসেআল্লাগাে আল্লাগাে শব্দটি দুবার শােনা যায়তারপর সব নিস্তব্ধআমি খুব স্বাভাবিকভাবে কুয়ার পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করিতারপর ঘরে চলে আসি। 

মাস্টার সাহেব বাড়িতে নেই এটা নিয়ে বাড়ির কাউকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল নাকারণ তখন আমার মায়ের শরীর খুবই খারাপশ্বাস কষ্ট হচ্ছেএখন মারা যান তখন মারা যান অবস্থামওলানা ডাকা হয়েছেমওলানা তওবা করিয়েছেনখবর পেয়ে বাবা চলে এসেছেন ঢাকা থেকেমা সেই যাত্রা রক্ষা পেয়ে যানবাবা উৎফুল্ল মনে ঢাকায় ফিরে যানযাবার আগে আরেকজন নতুন মাস্টার ঠিক করে যানমুহম্মদ ইদরিশের বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সে ভালাে কোনাে সুযােগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছেনিমকহারাম টিমকহারাম বলে তাকে অনেক গালাগালিও করেন। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৬)-হুমায়ূন আহমেদ

মার শরীর আরেকটু ভালাে হলে আমরা আবার ঢাকা শহরে চলে আসিমুহম্মদ ইদরিশ কুয়ার ভেতর থেকে যায়তার বিষয়ে কেউ কিছুই জানে নাআমি নিজেও ব্যাপারটা ভুলে যাইএকবার শুধু রাতে মন্দিরে দেখা নারী মূর্তিকে স্বপ্নে দেখিস্বপ্নটা রকমআমি মন্দিরের বারান্দায় বসে পেয়ারা খাচ্ছিনারী মূর্তি এসে আমার সামনে দাঁড়ালপরিচিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, এই বাদর! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি বললাম চিনতে পারছি। 

অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন ? নাকি আমার গায়ে কাপড় নেই বলে তাকাতে লজ্জা লাগছে। 

আমি বললাম, লজ্জা লাগছে। 

চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল তাহলে লজ্জা লাগবে নাএখন বল দেখি ইদরিশ মাস্টারের উচিত শিক্ষা হয়েছে না

আমি বললাম, হয়েছেদেখলি কেউ কিছু বুঝতে পারে নি। 

মানুষের শরীর পচে গেলে খুবই দুর্গন্ধ হয়কুয়াটাতাে অনেক গভীর এই জন্যে পচা গন্ধ নিচে জমে আছে উপরে আসতে পারছে নাবুঝতে পারছিস

আমি তােকে একটা বিষয়ে সাবধান করতে এসেছিকোন বিষয়ে ? তুই কুয়ার ধারে একা একা যাবি নাগেলে কি হবে

ইদরিশ মাস্টার তােকে ডাকবে তুই বাচ্চা মানুষতােডাক শুনে ভয় টয় পেতে পারিস। 

আচ্ছা কুয়ার পারে যাব না। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৬)-হুমায়ূন আহমেদ

কখনাে কোনােদিনও কুয়ার ভেতরে কি আছে উঁকি দিয়ে দেখতে যাবি নাদেখতে গেলেই মহাবিপদ। 

আচ্ছা দেখতে যাব না। 

ইদরিশ মাস্টারের প্রসঙ্গ এইখানেই শেষঅনেক বছর পর ইদরিশ মাস্টারের প্রসঙ্গটা আমার আবার মনে আসেতখন আমি বিলেতে পড়াশােনা করছিকোন এক উইক এন্ডে হঠাৎ একটা বই হাতে এলবইটার নাম The crystal door. বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিসJames Hauler. তিনি এই বইটিতে বললেন মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খােলে নামানুষ যদি কোন কারণে ভয়ংকর কোন চাপের মুখােমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crysta door

জেমস হাউলার বলছেনএই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনাে পায় নাকারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখােমুখি হতে হয় নাজেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দুধরনের বাস্তব আছেএকটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি 

অদৃশ্য জগতের বাস্তবতাস্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা cystal door হলাে অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *