আমি এবং আমরা পর্ব:০৩ হুমায়ূন আহমেদ

আমি এবং আমরা পর্ব:০৩

একদিন ঠিক দুপুর বেলায় এসে গলা নিচু করে বললেন, তন্ময়, বাবা একটা কথা শোন–তোমার মা তোমাকে একটু দেখতে চায়। শুধু একপলক দেখবে। তোমার মার খুব শরীর খারাপ। হয়তো বাঁচিবে না। তোমাকে খুব দেখার ইচ্ছা! তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? দুপুর বেলা তো তোমার বাবা বাসায় বেশিক্ষণ থাকেন না। তখন নিয়ে যাব। দেখা করিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। যাবে? এই দেখ, তোমার মা একটা চিঠিও দিয়ে দিয়েছেন। চিঠিটা পড়।আমি চিঠিটা না পড়েই তৎক্ষণাৎ বললাম, হ্যাঁ।তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, কাউকে কিছু বলবে না। কাউকে কিছু বললে তোমাকে নিতে দেবে না।আমি কাউকে কিছু বলব না।

আমি তোমাকে নিতে আসব না-বুঝলে? তুমি করবে কি-দুপুর বেলায় সুযোগ বুঝে গেট দিয়ে বাইরে চলে আসবে। এক দৌড়ে সদর রাস্তায় চলে আসবে। একটা বেবিট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে না-ঐখানে আমি থাকব। তুমি আসামাত্র তোমাকে নিয়ে চলে যাব। আসতে পারবে না? পারব।দেখো, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। জানতে পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোমার বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন না। উনি সেই মানুষই না। আমি একজন দরিদ্র মানুষ… আমি যাব।কবে আসবে? আপনি বলুন।আগামীকাল পারবো? হুঁ। পারব।

উনাকে খুব চিন্তিত মনে হলেও আমি মোটেই চিন্তিত হলাম না। আমার মনে হলকেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই আমি চলে আসব। তা ছাড়া শীতের দুপুরে সর্দার চাচা পাকা বারান্দায় পাটি পেতে রোদে ঘুমায়। বাবা বাসায় থাকেন না। তিনি ফেরেন। সন্ধ্যায়। গেটে যে থাকে সেও ঝিমুতে থাকে। এক ফাঁকে ঘর থেকে চলে গেলেই হল! তাই করলাম। সবাইকে ফাকি দিয়ে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি বেবিট্যাক্সি স্ট্র্যান্ডের কাছে মাস্টার সাহেব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সিগারেট। তাঁকে দেখে দারুণ চিন্তিত মনে হল। ভীত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন। আমাকে দেখে তার উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল। তিনি বললেন, কেউ দেখে নি তো?

আমি বললাম, না।তিনি বললেন, চল একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে নি।উনি যখন বেবিট্যাক্সি দরদাম করছেন তখনই সর্দার চাচা উপস্থিত হলেন। আমাদের দুজনকেই বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাবা আসলেন সন্ধ্যাবেলা। তিনি আমাকে কিছুই বললেন না, কিন্তু স্যারের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। সেই শাস্তি ভয়াবহ শাস্তি। একতলার দারোয়ানের ঘরে দরজা বন্ধ করে মার! সেই ঘরের ভেতর আমিও আছি। বাবা চাচ্ছিলেন যেন শাস্তির ব্যাপারটা আমিও দেখি।স্যারকে মারছিল সর্দার চাচা। আমি একটা খাটের উপর দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর দৃশ্য থরথর করে কাপতে কাঁপিতে দেখছি। স্যার একসময় রক্তবমি করতে লাগলেন এবং একসময় কাতর গলায় বললেন, আমারে জানে মারবেন না। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে।

সর্দার চাচা হিসহিস করে বললেন,-চুপ। শব্দ করলে কইলজা টান দিয়া বাইর কইরা ফেলামু। চুপ।এরপর কী হল আমার মনে নেই। কারণ, আমার জ্ঞান ছিল না। আমি অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে যাই। জ্ঞান হলে দেখি আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। সর্দার চাচা আমার মাথায় পানি ঢালছেন।আমি বললাম, উনি কি মারা গেছেন? সর্দার চাচা বললেন, আরে দূর বোকা! মানুষ অত সহজে মরে না। মানুষ মারা বড়ই কঠিন। তারে রিকশায় তুল্যা বাসায় পাঠায়ে দিছি।রক্তবমি করছিল? পেটে আলসার থাকলে অল্প মাইর দিলেই নাকে-মুখে রক্ত ছোটে। ও কিছু না।উনি তা হলে মরেন নাই? না না। আইচ্ছা ঠিক আছে-তোমারে একদিন তার বাসায় নিয়া যাব নে! আমি উনার বাসায় যাব না।এইটাই ভালো। কী দরকার?

সর্দার চাচা আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। স্যারকে ঐরাতে ভয়ংকরীভাবে মারা হয়েছিল। অচেতন অবস্থায় তাঁকে গভীর রাতে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়। সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর আগে তাঁর জ্ঞান ফেরে নি। কাজেই তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু বলে যেতে পারেন নি। মুশফেকুর রহমান চুপ করল। হাই তুলতে তুলতে বলল, আজ এই পর্যন্ত থাক। ঠাণ্ডা বেশি লাগছে। মিসির আলি বললেন, আপনার স্যারের নাম কী? উনার নাম জানি না। খুব অল্পদিন পড়িয়েছিলেন। নাম জানা হয় নি। উনি ছিলেন একজন পেশাদার প্রাইভেট টিউটর। ছাত্র পড়ানো ছাড়া আর কিছু করতেন না।উনি আপনাকে কতদিন পড়িয়েছিলেন? সপ্তাহ দুই। কিংবা তার চেয়েও কম। আমার শৈশবের ঘটনা আপনার কাছে কেমন লাগল? মোটামুটি লেগেছে। সাজানো গল্প। যত সুন্দরই হোক সাজানো গল্প ভালো লাগে না।মুশফেকুর রহমান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, সাজানো বলছেন কেন?

গল্পটা সাজানো মনে করার পেছনে আমার অনেকগুলো কারণ মনে আসছে। যে ভদ্রলোক মাত্র দু সপ্তাহ আপনাকে পড়িয়েছেন তিনি এই সময়ের ভেতর আপনাকে গোপনে নিয়ে আপনার মার সঙ্গে দেখা করিয়ে আনার মতো দুঃসাহসিক পরিকল্পনা হাতে নেবেন তা বিশ্বাস্য নয়। আমার মনে হয়, ঘটনাটা এরকম-আপনি বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলেন। যখন আপনার সর্দার চাচা আপনাকে ধরুল তখন শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যে মাস্টার সাহেবকে জড়িয়ে গল্পটা তৈরি করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় হয়তো মাস্টার সাহেব সামনে পড়ে গেছেন। যে কারণে আপনাকে আপনার বাবা কোনো শাস্তি দেন নি। আপনার সর্দার চাচা ঐ নিরীহ মানুষটিকে এমন ভয়ংকর শাস্তি কোন দিল তাও পরিষ্কার হচ্ছে না। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত একটি শিশুঁকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। আর অপরাধ ধরা হলেও মৃত্যুদণ্ড তার শাস্তি হতে পারে না।মুশফেকুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমার গল্প আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না?

না। কারণ গল্পে ফাঁক আছে।সুদূর শৈশবের গল্প বলছি। ফাঁক থাকাই তো স্বাভাবিক।ফাঁকগুলো অনেক বড়।মুশফেকুর রহমান বলল, স্যার, শুরুতেই আপনি আমাকে একজন ভয়ংকর মানুষ ধরে নিয়েছেন। আমার কারণেই তা করেছেন। আমি নিজেকে ভয়ংকর মানুষ হিসেবেই আপনার সামনে উপস্থিত করেছি। যে কারণে অতি সামান্য অসামঞ্জস্যও আপনার কাছে অনেক বড় লাগছে। গল্পে ফাঁক আছে বলে যে দাবি আপনি করছেন, আমি সেই ফাঁক ঠিক ধরতে পারছি না। আমি শুধু বলছি যে,–যা ঘটেছে তা আপনাকে আমি বলার চেষ্টা করেছি। স্যার, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন। আপনাকে মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন আমার নেই।মিসির আলি বললেন, আমাকে সত্য বলারও তো প্রয়োজন নেই।প্রয়োজন আছে। সব ঘটনা আপনাকে ঠিকঠাকমতো জানানো দরকার।

আপনি ঠিকঠাকমতো বলছেন না। কী করে আপনি জানলেন যে মাস্টার সাহেবকে মেরে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়? যদি ফেলেও আসে আপনাকে কেউ সেই তথ্য দেবে না। ক্লাস ফোরে যে ছেলেটি উঠেছে সে পরদিন খবরের কাগজ পড়ে এই তথ্য উদ্ধার করবে তা বিশ্বাস্য নয়। মাস্টার যে মারা গেছে। এটিও আপনার জানার কথা না। আপনার সর্দার চাচা কি আপনার কাছে স্বীকার করেছিলেন? না স্বীকার করেন নি। তবে পরদিন খুব ভীত ভঙ্গিতে আমাকে বলেছিলেন-বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে। পুলিশ এলে আমি যেন বলি-আমি এই মাস্টারকে চিনি না।পুলিশ কি এসেছিল?

জি এসেছিল, তবে আমার সঙ্গে পুলিশের কোনো কথা হয় নি। বাবার সঙ্গে কথা বলে তারা খুব খুশি মনে চলে যায়।মাস্টার সাহেব যে বাহাদুর শাহ পার্কে পড়েছিলেন এই তথ্য কোথায় পেলেন? মুশফেকুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হল কথাটা বলবেন কি বলবেন না তা ঠিক করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেন– এই তথ্য আমি মাস্টার সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছি।তার মানে? যে মাস্টার সাহেবের কথা আপনাকে বললাম, উনি তাঁর মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে বাস করছেন।কী বললেন?

ঐ মৃত ব্যক্তি গত একুশ বছর ধরে আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের বাড়িতে বাস করেন। আমি জানি ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য। হাস্যকর। এটা যে বিংশ শতাব্দী তাও আমি জানি। মানুষ চাঁদে নেমেছে, চাঁদের মাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ আছে। এটি যেমন সত্যি–আমার স্যার আমাদের বাড়িতে বাস করছেন এটিও তেমনি সত্য। আমি চাই আমার ঐ স্যারের সঙ্গে আপনার দেখা হোক, কথা হোক। তিনি আপনার মতোই বুদ্ধিমান। কিংবা কে জানে আপনার চেয়েও হয়তো বুদ্ধিমান। তাঁকে আপনার পছন্দ হবে।উনি আমাকে চেনেন? হ্যাঁ চেনেন। আমি যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি তা তিনি জাসেন। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী।যে দুজন খুন হয়েছে, তারা কারা? একজন সর্দার চাচা। অন্যজন আমার বাবা।মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। মুশফেকুর রহমান বলল, আপনি কি আমার স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন? না।না কেন?

একজন এসে আমাকে বলবে–তার বাড়িতে একটি প্ৰেতাত্মা বাস করছে, সেই প্ৰেতাত্মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়–আর ওমনি আমি কথা বলার জন্যে রওনা হব–তা হয় না। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, মানসিকভাবে অসুস্থ নই।আপনি কি কোনো কৌতূহল বোধ করছেন না? প্রেতাত্মা বিষয়ে কোনো কৌতূহল বোধ করছি না। তবে আপনার ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে আপনি খুবই অসুস্থ একজন মানুষ। আপনার মার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। উনি কি জীবিত আছেন? জি, জীবিত আছেন। আমি জানতাম। আপনি আমার মার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। আমি উনার ঠিকানা লিখে এনেছি। এই কাগজে লেখা আছে।মিসির আলি যন্ত্রের মতো ঠিকানা লেখা কাগজ হাতে নিলেন।ভদ্রমহিলার নাম মোমেনা খাতুন।

১৮/২ তল্লাবাগে তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। টেলিফোন নাম্বার দেওয়া আছে। মিসির আলি অনেকবার টেলিফোন করলেন। রিং হয়। কিন্তু কেউ ধরে না। সেট হয়তো নষ্ট হয়ে আছে। নম্বর খুঁজে বাড়ি বের করার কাজটা তিনি একেবারেই পারেন। না। তিনি জানেন তন্ত্রাবাগে উপস্থিত হয়ে যদি বলেন, ১৮/২ বাড়িটা কোথায়, তা হলেও কোনো লাভ হবে না। যাকে জিজ্ঞেস করা হবে সে এমনভাবে তাকাবে যে এই নাম্বার শুনে সে বড়ই চমৎকৃত বোধ করছে। এমন অদ্ভুত নাম্বার কোত্থেকে এসেছে বুঝতে পারছে না। আরেক দল আছে যারা নাম্বার শুনে বলবে-ও আচ্ছা, আঠার বাই দুই। নাক বরাবর যান, তারপর লেফটে যাবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে। এরা সবজান্তার কাজটা করে কিছু না জেনে। অন্যকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পেতে চায়।

এলাকার বাড়িঘরের নম্বর সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। যারা থ্রি-ফোরে পড়ে। মানুষের মতো বাড়ির নাম্বার আছে-এই বিষয়টি তাদের হয়তো আলোড়িত করে। তারা মনে রাখার চেষ্টা করে। বাড়ির নাম্বার নিয়ে বিব্রত মানুষকে সত্যিকার অর্থেই এর সাহায্য করতে চায়।এদের একজনের সাহায্য নিয়েই মিসির আলি ১৮/২ তল্লাবাগ খুঁজে বের করলেন। সরু রাস্তার উপর বিরাট বাড়ি। বাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে সবই বড় বড়। ড্রয়িংক্রিমে বিশাল আকৃতির সোফা। দেয়ালে কাবা শরিফের প্রকাণ্ড বাঁধাই ছবি। একটি টিভি আছে-একে কত ইঞ্চি টিভি বলে কে জানে। সিনেমার পর্দার মতো বড় স্ক্রিন। শুধু বাড়ির দরজা-জানালা ছোট ছোট। প্রথম দর্শনেই মিসির আলির মনে হল-সোফা, টিভি এগুলো এ বাড়িতে ঢোকাল কীভাবে?

ড্রয়িংরুমে বেশকিছু লোক। গাদাগাদি করে সোফায় বসে আছে। বাড়িতে কোনো উৎসব হয়তো। সবাই সেজেগুঁজে আছে। অল্পবয়সী বালিকারাও ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে গালে রোজ মেখে সেজেছে। সবাইকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।মিসির আলির মনে হল মোমেনা খাতুন নামের এই বৃদ্ধ মহিলার প্রতি কারো কোনো কৌতূহল নেই। আগ্রহও নেই। একজন অপরিচিত ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শুনেও কেউ কোনো গা করছে না। মধ্যবয়স্ক এক লোক বিরস মুখে থললেন, বসুন দেখছি।বলেই তিনি কর্ডলেস টেলিফোনে কাকে যেন ধমকাতে লাগলেন। লোকটার পরনে হালকা কমলা রঙের স্যুট।

গলায় ছোট ছোট ফুল আঁকা টাই-তবে তার প্যান্টের জিাপার খোলা। সবাই তা দেখছে, কেউ কিছু বলছে না। মনে হয় বলার সাহস পাচ্ছে না।মিসির আলি সোফায় বসে রইলেন একা একা। আঠার-উনিশ বছরের একটা মেয়ে ঝড়ের গতিতে বসার ঘরে ঢুকে মিসির আলিকে বলল-আপনি কি কার রেন্টাল থেকে এসেছেন? এত দেরি যে? বলেই জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করে ভেতরে চলে গেল। উঁচু গলায় বলল, বাস চলে এসেছে মা।বোঝা যাচ্ছে এরা দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছে। পিকনিক হবার সম্ভাবনা। শীতকালের শুক্রবারে পিকনিক লেগেই থাকে। পিকনিক হলে মোমেনা খাতুনের দলটির সঙ্গে যাবার কথা! ইচ্ছা না থাকলেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পিকনিকে নিয়ে যেতে হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও

টেলিফোন হাতে ভদ্রলোক কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন এবং একটি কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বলছেন। একসময় লাইন কেটে গেল কিংবা ওপাশের অরলোক লাইন ছেড়ে দিলেন। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। মিসির আলি আবার বললেন, আমি একটু মোমেনা খাতুনের সঙ্গে কথা বলব।আপনাকে অপেক্ষা করতে বললাম না। ব্যস্ততাটা তো দেখতে পাচ্ছেন? নাকি পাচ্ছেন না। সবাই গায়ে-হলুদে যাচ্ছে।কিছু মনে করবেন না। আপনার প্যান্টের জিাপার খোলা।ভদ্রলোক এমনভাবে মিসির আলির দিকে তাকালেন যেন মিসির আলি নিজেই জিপার খুলেছেন। মিসির আলি বললেন, উনি আছেন তো?

হ্যাঁ, আছেন। কিছুক্ষণ ওয়েট করুন। ভিড় কমুক, তারপর আপনাকে আন্টির কাছে নিয়ে যাব। জাষ্ট দেখা দিয়ে চলে যাবেন। বেশিক্ষণ বিরক্ত করবেন না? কথা বলা পুরোপুরি নিষেধ। আন্টির আবার বেশি কথা বলার অভ্যাস। কথা বলে বলে রোগ বাড়াচ্ছেন।বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলা অসুস্থ। সম্ভবত হাসপাতালে ছিলেন। সম্প্রতি বাসায় আনা হয়েছে। অনেকেই তাকে দেখতে আসছে বলেই মিসির আলিকে এ বাড়ির সবাই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে।ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর একজন কাজের মেয়ে এসে বলল, ভিতরে আসেন, জুতা খুইলা আসেন।

লম্বা বারান্দা পার হয়ে মিসির আলি ছোট একটা ঘরে ঢুকলেন। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। মেঝে মনে হয় ডেটল দিয়ে ধুয়েছে। ঘরময় ডেটলের গন্ধ। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে খাট পাতা। মিসির আলি ভেবেছিলেন বৃদ্ধ এক মহিলাকে শুয়ে থাকতে দেখবেন। তা দেখলেন না। মোমেনা খাতুন। একদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখে চশমা। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। গায়ের কাপড়টিও সাদা, মাথার চুল সাদা। যে বিছানায় বসেছেন সেই বিছানার চাদরটাও সাদা। সব মিলে সুন্দর একটি ছবি।মিসির আলি বললেন, আপনি কেমন আছেন?

ভদ্রমহিলা স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, জি ভালো।ভদ্রমহিলার কান ঠিক আছে। কথাও জড়ানো হয়, তবে চোখের দৃষ্টির সম্ভবত কিছু সমস্যা আছে। তিনি তাকিয়ে আছেন। অন্যদিকে।আপনি অসুস্থ জানতাম না। অসুস্থ জানলে আসতাম না।আমি ভালো আছি। বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তাররা বলল, কিছু হয় নাই।আমি খানিকক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলব–যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আমার পরিচয় আপনাকে দেওয়া দরকার। আমার নাম মিসির আলি। আমি… আপনার পরিচয় দিতে হবে না। আমার ছেলে তার ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিল, সে বলেছে আপনি আসবেন।আপনার ছেলে আপনাকে দেখতে আসে নি।না, আসে না। এর আগে একবার জরায়ুর টিউমার অপারেশন হয়েছিল–তিন মাস ছিলাম হাসপাতালে। খবর পেয়েও দেখতে এল না। মরেও যেতে পারতাম। আমি তো তার মা। বলুন আপনি-আমি তার মা না? অবশ্যই আপনি মা?

বেশি কথা বলা বোধহয় আপনার নিষেধ! আমি বরং এক কাজ করি–এমনভাবে প্রশ্ন করি যেন হ্যাঁ-না বলে জবাব দেওয়া যায়।কথা কলা নিষেধ-এটা আপনাকে কে বলল? কোনো নিষেধ না। ডাক্তার এমন কিছু বলে নাই। এইসব কথা এই বাড়ির লোকজন বানিয়েছে-। যেই আসে তাকে বলে-কথা বলা নিষেধ। যাক, বাদ দিন। কী যেন বলছিলাম– আপনি বলছিলেন—আগে একবার আপনার জরায়ুর টিউমার অপারেশন হয়েছিল–তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন। আপনার ছেলে খবর পেয়েও আপনাকে দেখতে আসে নি। আপনি আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন-আপনি তার মা কিনা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *