আমি পরীক্ষা বন্ধ করে দিলাম। রূপা চলে যাবে এই ভয়ে যে বন্ধ করলাম তা না। পঞ্চম দিনের দিন গাছটা মরে গেল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, গাছটা চতুর্থ দিনে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল–পাতাগুলি হয়েছিল নীলচে এবং কাণ্ডটা হয়ে গেল ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের। রক্তের কারণে যে গাছ মরে গেছে তা কিন্তু না। বরং গাছটাকে অনেক বেশি সজীব লাগছিল। গাছটা মারা গেল পিঁপড়ার আক্রমণে। রক্তের লোভে ঝাকে ঝাকে পিঁপড়া এসে গাছটাকে আক্রমণ করল। গাছের শিকড় কেটে লণ্ডভণ্ড করে দিল।
আমি ঠিক করলাম এই পরীক্ষাটা আমি আবার করব। এইবার করব এমনভাবে যেন পিপড়া গাছ আক্রমণ করতে না পারে। টমেটো গাছ নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। কনট্রোলড এক্সপেরিমেন্ট। আটটা গাছ থাকবে। চারটায় পানির বদলে রক্ত দেয়া হবে। চারটায় পানি। টমেটো হবার পর খেয়ে দেখা হবে–টমেটোর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি-না।
গাছের পরীক্ষার পর পর রূপা আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল, যে কথা আপনাকে শুরুতে বলেছি। ভদ্রলোক নানান প্রশ্ন-ট্রশ্ন করলেন। খুব চালাকি ধরনের প্রশ্ন, যাতে আমি বুঝতে না পারি ব্যাপারটা কী। আমি প্রতিটি প্রশ্নের এমন জবাব দিলাম যে ভদ্রলোক মোটামুটি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের প্রশ্নের এবং আমার উত্তরের কিছু নমুনা দেই।
প্রশ্ন : আপনি কি দুঃস্বপ্ন দেখেন?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : প্রতি রাতেই দেখেন?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : একই দুঃস্বপ্ন ঘুরে ফিরে দেখেন, না একেকদিন একেক দুঃস্বপ্ন?
উত্তর : একই দুঃস্বপ্ন ঘুরে ফিরে দেখি।
প্রশ্ন : কী দেখেন?
উত্তর : দেখি আমি মাছ কুটছি। মাছটা পরিচিত মনে হচ্ছে। আমি খুব চিন্তিত–মাছ আবার পরিচিত হবে কী করে? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। এটা আসলে মাছ না। আমি একটা মানুষকে কেটে কুচি কুচি করছি। সেই মানুষটা আর কেউ না, আমি নিজে। আমি খুব ঘাবড়ে যাই। তারপর রান্না চড়াই। নিজেকেই নিজে রান্না করি। তারপর খেতে বসি। নিজেকেই নিজে খাই। খেতে গিয়ে দেখি টেস্ট পাচ্ছি না। রান্না ভালো হয় নি। লবণ বেশি হয়েছে।
প্রশ্ন : আমার মনে হচ্ছে এই স্বপ্নটা আপনি বানিয়ে বানিয়ে বললেন।
উত্তর : ঠিক ধরেছেন।
প্রশ্ন : এটা কেন করলেন?
উত্তর : খুব অদ্ভুত কিছু দুঃস্বপ্ন আমি দেখতে চাই কিন্তু দেখতে পারি না। সাধারণ দুঃস্বপ্ন দেখি। এই জন্যেই মাঝে মাঝে আমি দুঃস্বপ্ন কল্পনা করি।
প্রশ্ন : সাধারণ দুঃস্বপ্ন বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
উত্তর : সেটা আপনাকে বলব না ভাই। বললে আপনি হাসবেন।
প্রশ্ন : আপনি কি অন্ধকারকে ভয় পান?
উত্তর : না, পাই না। আলো ভয় পাই।
প্রশ্ন : আলো ভয় পান মানে?
উত্তর : দিনের বেলা কেমন জানি ভয় ভয় করে। সূর্য ডোবার পর ভয়টা কেটে যায়।
প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী বলছিলেন আপনি বাঁদরের সঙ্গে কথা বলেন। এটা কি সত্যি?
উত্তর : অবশ্যই সত্যি। সে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে কেন? রূপা মিথ্যা কথা বলার মেয়ে না।
প্রশ্ন : বাদরের সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলেন?
উত্তর : বেশিরভাগ সময় জোকস বলি। এরা জোকস ধরতে পারে। হাসে।
প্রশ্ন : বাঁদর হাসে?
উত্তর : অবশ্যই হাসে। বাঁদরের সঙ্গে মানুষের মিল সবচে’ বেশি, ওরাও মানুষের মতো কাঁদে এবং হাসে। বাঁদরের হাসি খুবই অদ্ভুত। এরা শরীর দুলিয়ে হাসে। হাসার সময় একজন আরেকজনের গায়ে ধাক্কা দেয়। বাঁদরের হাসি কখনো শুনেছেন?
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, না।
আমি বললাম, শুনতে চান?
তিনি বললেন, হ্যাঁ শুনতে চাই।
আমি বললাম, তাহলে কোনো একদিন আমার বাসায় চলে আসুন। আমি আপনাকে বাঁদরের হাসি শুনিয়ে দেব।ভদ্রলোক বললেন, অবশ্যই আসব। আমার ছোট ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব। সে মজা পাবে।আমি বললাম, ভাবিকেও সঙ্গে নিয়ে আসুন। উনিও মজা পাবেন। জন্তুদের কাণ্ডকারখানা দেখলে মহিলারাই সবচে বেশি মজা পান।সাইকিয়াট্রিস্ট বুঝতেও পারলেন না যে আমি এখন প্রশ্ন করা শুরু করেছি এবং তিনি উত্তর দিচ্ছেন। পাশার দান উল্টে গেছে।
আমি : বাঁদর ছাড়াও আরো একটা প্রাণী হাসতে পারে, তার নাম জানেন?
সাইকিয়াট্রিস্ট : না।
আমি : প্রাণীটার নাম বাঘ। জিম করবেট তার শিকারের বইয়ে বাঘের হাসির কথা বলেছেন। রানীক্ষেতের মানুষখেকো বাঘিনীর অংশে লেখা আছে। জিম করবেট পড়েছেন?
সাইকিয়াট্রিস্ট : না।
আমি : জিম করবেটের নাম শুনেছেন?
সাইকিয়াট্রিস্ট : না।
আমি : জিম করবেট পড়তে চাইলে আমি আপনাকে দিতে পারি। আমার লাইব্রেরিতে আছে। দেব এনে?
সাইকিয়াট্রিস্ট : আচ্ছা।
কথাবার্তার শেষে ভদ্রলোক আমাকে এক গাদা ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিলেন। বিছানাতে যাবার এক ঘণ্টা আগে দু’টা করে ট্যবলেট খেতে হবে।আমি বললাম, ভাই, আমার তো ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। বিছানায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। ইচ্ছা-মৃত্যুর মতো আমার হলো ইচ্ছা-ঘুম। ঘুম আমার সমস্যা না।তিনি বললেন, সমস্যা না হলেও খাবেন।আমি বললাম, আপনি যখন খেতে বলছেন তখন অবশ্যই খাব।আপনার নার্ভ যাতে ঠাণ্ডা থাকে, নিউরোলজিক্যাল কানেকশানসে যেন গণ্ডগোল না হয় তার জন্যে এই ওষুধগুলি দিয়েছি।আমি বললাম, থ্যাংক য্যু।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি আমার মোবাইলের একটা নাম্বার দিচ্ছি। যে-কোনো সমস্যায় টেলিফোন করবেন। আমি কখনো মোবাইল অফ করি না।রাতেও টেলিফোন করতে পারব? অবশ্যই পারবেন।গভীর রাতে টেলিফোন করলে বিরক্ত হবেন না তো? কী আশ্চর্য কথা, বিরক্ত হবে কেন? রাতে ঘুম ভেঙে টেলিফোন ধরতে হলে অনেকেই বিরক্ত হন। সবচে’ বেশি বিরক্ত হন ডাক্তাররা।আমি কখনো বিরক্ত হই না। কারণ পেশেন্টের কথা শোনা আমার ডিউটি।দ্রলোক সত্যি সত্যি বিরক্ত হন কি-না তা দেখার জন্যে আমি সেই রাতেই টেলিফোন করলাম (সময় দু’টা দশ মিনিট)। অনেকবার রিং হবার পর ভদ্রলোক টেলিফোন ধরলেন। ঘুম ঘুম গলায় বললেন, কে?
আমি বললাম, ভাই, আমার নাম ফখরুদ্দিন চৌধুরী। আজ সন্ধ্যায় রূপা আমাকে নিয়ে আপনার বাসায় গিয়েছিল। রূপা অবশ্যি বলেছিল আপনি তাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। এখন বুঝতে পারছি ঘটনা তা না। আপনি একজন পাগলের ডাক্তার।পাগলের ডাক্তার এ ধরনের কথা বলবেন না। পাগল বলে কিছু নেই। মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে পাগল বলা সামাজিক অপরাধ।সরি।বলুন কী ব্যাপার? এত রাতে টেলিফোন করেছেন কেন? সমস্যা কী?
আপনি বলেছিলেন আমি যে-কোনো সময় আপনাকে টেলিফোন করতে পারি। আপনি বিরক্ত হবেন না।কী জন্যে টেলিফোন করেছেন কাইন্ডলি বলুন। ঘুম থেকে উঠে টেলিফোন ধরেছি।ঘুম-বিষয়ক একটা প্রশ্ন ছিল।কী প্রশ্ন? মানুষের জন্যে ঘুমের ওষুধ আছে। গাছের জন্যে কি এ ধরনের ওষুধ আছে? কী বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না।এমন কোনো ওষুধ কি আছে যা খেলে গাছ ঘুমিয়ে পড়ে? গাছ যে ঘুমায় তা আমরা জানি। কিছু কিছু গাছ যেমন তেঁতুল সন্ধ্যাবেলায় পাতা বন্ধ করে দেয়। আমি জানতে চাচ্ছি এমন কোনো ওষুধ কি আছে যা খেলে দিনেদুপুরে গাছ ঘুমিয়ে পড়বে? এইটাই আপনার প্রশ্ন?
জি।এই প্রশ্ন করার জন্যে রাত দু’টার সময় টেলিফোন করেছেন? জি।আমি এই প্রশ্নের জবাব জানি না।বলেই ভদ্রলোক টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন।আমি রাত সাড়ে তিনটার দিকে আবার টেলিফোন করলাম। আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক টেলিফোন ধরবেন না। মোবাইলে আমার নাম্বার দেখেই সাবধান হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি ধরলেন। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ভাই, ভালো আছেন? তিনি জড়ানো গলায় বললেন, কে? আমার নাম ফখরুদ্দিন। রূপার সঙ্গে সন্ধ্যায় আপনার বাসায় গিয়েছিলাম।কী ব্যাপার?
একটা প্রশ্ন ছিল।আপনি দয়া করে ঘুমুতে যান।প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্যে মনের ভেতর খুঁতখুঁতানি তৈরি হয়েছে। ওটা দূর। হলে ঘুম আসবে না।কী প্রশ্ন বলুন।গাছ-বিষয়ক একটা প্রশ্ন। গাছের জীবন আছে এটা তো আমরা জানি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন পাগল হয়ে যায়, গাছের বেলায় কি সে-রকম হতে পারে? আমবাগানের একটা আম গাছ পাগল হয়ে গেল–এরকম। দশটা আম গাছ ভালো, একটা আম গাছ বদ্ধ উন্মাদ। কিংবা আপনাদের পরিভাষায় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত।
ভদ্রলোক টেলিফোন অফ করে দিলেন। রাত চারটার দিকে আবার করলাম, তখনো টেলিফোন অফ। ভোর পাঁচটায় করলাম, তখনো অফ। রবার্ট ব্রুসের মতো অসীম ধৈর্যে আমি টেলিফোন করেই যেতে থাকলাম। এক সময় না এক সময় তিনি তার মোবাইল অন করবেন, তখন যেন তার সঙ্গে কথা বলা যায়।সকাল সাড়ে নটায় তিনি টেলিফোন ধরলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, কে? আমি বললাম, ভাই, আমার নাম ফখরুদ্দিন চৌধুরী। রূপাকে নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায়…
বাক্য শেষ করার আগেই ভদ্রলোক টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন। সারাদিনে তিনি আর টেলিফোন চালু করলেন না। আমি অবশ্যি সারাদিনই চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কর্মহীন মানুষদের ধৈর্য ভালো হয়। যে-কোনো তুচ্ছ কাজে তারা লেগে থাকতে পারে। এরা খুব ভালো বর্শেল হয়। ছিপ ফেলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে পারে। পুকুরে মাছের ঘাই শুনে বলে দিতে পারে–কী মাছ, কত বড় মাছ।কর্মহীন মানুষ বার্ডওয়াচার হয়। দুরবিন হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। মা-পাখি শিশুদের খাওয়াচ্ছে। দিনে ক’বার খাওয়াচ্ছে, কী খাওয়াচ্ছে সব তারা জানে। তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, বলুন তো দেখি, একশ্রেণীর বক আছে যাদের থুতনিতে ছাগলের দাড়ির মতো দাড়ি। দাড়িওয়ালা বকদের নাম কী? তারা সঙ্গে সঙ্গে বলবে নাম–মেছো বক।
এরা আমার মতো বইপড়া জ্ঞানী হয়। রাজ্যের বই পড়ে পড়ে মাথার স্মৃতিকোষ অর্থহীন জ্ঞানে বোঝাই করে রাখে। কেউ দর্শনের বই পড়ে পড়ে হয়। দার্শনিক। কেউ গাছপালার বই পড়ে পড়ে শখের বোটানিস্ট। ইউনিভার্সিটির পাস করা বোটানিস্টকে যদি জিজ্ঞেস করেন–আচ্ছা স্যার, ভুইআমলা গাছের নাম জানেন? তাঁরা ভুরু কুঁচকে বলবেন–ভুইআমলা? দেশী গাছ? সাইন্টিফিক নাম কী বলুন তো? একজন শখের স্বশিক্ষিত বোটানিস্টকে জিজ্ঞেস করুন; তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে বলবেন- ও আচ্ছা, ভূমিআমলা–ভূমি আমলকির কথা বলছেন? কেউ কেউ আবার একে বলেন ভুধাত্রী। অন্য আরেকটা নাম আছে–তমালিকা। Euphorbiaceae পরিবারের গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Phyllanthus freteratus. কেন চিনব না? আপনাকে অনেক কথা বলে ফেলেছি। এখন আপনার কী ধারণা হচ্ছে? আমি পাগল? না-কি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পছন্দ করে এমন কেউ?
পাগলরাও কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করে মজা পায়। তারা নিজেরা বিভ্রান্ত বলেই অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করতে চায়। আমার এক বন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনি ইজিচেয়ারে বসে পান খাচ্ছেন। আমাকে দেখেই মোটামুটি আনন্দিত গলায় বললেন, খবর শুনেছ?
আমিতো পাগল হয়ে গেছি। ব্রেইন পুরোপুরি কলাপস করেছে।আমি বললাম, তাই নাকি!তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, হ্যাঁ ঘটনা সে-রকম। আমার ফ্যামিলির লোকজন অবশ্যি আসল কথা ফাঁস করছে না। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে আমার সামান্য মাথা গরম হয়েছে। আমি তো জানি ঘটনা কী।ঘটনা কী? ঐ যে বললাম, পাগল হয়ে গেছি। লক্ষণ কী জানতে চাও? জানতে চাই।ঘটনা হলো–সারাক্ষণ আমার পেটে কে যেন কথা বলে। অর্ধেক বোঝা যায়, অর্ধেক যায় না। আমার পেটে কান রাখলে তুমিও শুনতে পাবে। এসো, শুনে দেখ।
বলেই তিনি পাঞ্জাবি উপরে তুলে পেট বের করলেন। তিনি যা করলেন তা হলো–আমাকে বিভ্রান্ত করলেন। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার মনে হলো–সত্যি সত্যি কেউ বোধহয় তার পেটে কথা বলছে।রূপার সঙ্গে কীভাবে আমার বিয়ে হলো সেই গল্প শুনবেন, না-কি আমার বাড়িতে ভূতের উপদ্রবের গল্পটা শুনবেন? আমি দুটাই বলব। কোনটা আগে শুনতে চান? ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে ভূতেরটা আগে বলতে হয়, তবে ইন্টারেস্টিং বেশি বিয়েরটা। ভূত এবং বিয়ে আমার বেলায় সম্পর্কিত। ফিজিক্সে প্রথমে Cause তারপর Effect. আমার বেলায় ভূতটা Cause, বিয়ে হলো Effect.
ঠিক আছে, ভূত দিয়েই শুরু করি। যদিও ভূতের গল্পটা এখন করতে চাচ্ছিলাম না। ভূতের গল্প যত ভয়ঙ্করই হোক, দিনের বেলা পানসে লাগে। শুধু পানসে না, হাস্যকরও লাগে। যিনি দিনের বেলায় আগ্রহ নিয়ে ভূতের গল্প করেন, সবাই তার দিকে মজা পাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন সে ভূতের গল্প বলছে। না, জোকস বলছে। খুব সিরিয়াস জায়গায় নিজেকে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মনে করেন, এমন শ্রোতা সবাইকে হাসানোর জন্যে বলে বসেন–তারপর ভূতটা কী করল? আপনার সঙ্গে কোলাকুলি করল? যিনি ভূতের গল্প করছেন তিনি তখন রেগে যান। তিনি যতই রাগেন অন্যরা ততই মজা পায়। এই মজাটা আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম না।
যাই হোক, ভূত প্রসঙ্গটা দ্রুত শেষ করে বিয়ের প্রসঙ্গে আসি। এক শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষার দুপুরে আমি ভূত দেখলাম। সরি, একটু ভুল হয়েছে–ভূতের কথা শুনলাম। ঘটনাটা বলি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে বই হাতে নিয়ে বিছানায় গিয়েছি। সরি, আবারো ভুল করেছি। বই না, ম্যাগাজিন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। দুপুরের খাবার পর আমি ম্যাগাজিন পড়ি। রাতে পড়ি বই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে তুন্দ্রা অঞ্চলে বিপন্ন পেঙ্গুইনদের উপর একটা লেখা পড়ছি। সুন্দর সুন্দর ছবি। ছবিগুলি দেখতে ভালো লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। বিছানায় চাদর নেই বলে গায়ে চাদর দিতে পারছি না। চাদর বের করে দেবার জন্যে কাউকে ডাকতে হবে। বিছানায় শুয়ে ডাকলে হবে না, আমাকে দোতলা থেকে একতলায় নামতে হবে।
কারণ আমার কোনো কাজের লোকের দোতলায় উঠার হুকুম নেই। দোতলাটা আমার একার।যে চাদরের উপর শুয়ে আছি তারি অর্ধেকটা নিজের উপর দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। আর্টিকেলের শুরুটা করেছে চমৎকার। জন স্টেইনবেকের উপন্যাসের নাম দিয়ে প্রবন্ধের শুরু–It was a winter of discontent. বাক্যটা শেষ করা মাত্র পরিষ্কার মেয়েলি গলায় একজন কেউ বলল, কী পড়েন? আমি বই নামিয়ে বললাম, কে? তার উত্তরে নারীকণ্ঠ সামান্য হেসে আবারো বলল, কী পড়েন? এর মধ্যে আমি দেখে নিয়েছি যে ঘরে কেউ নেই। ভয় পাই নি খুবই বিস্মিত হয়েছি। তবে অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কে কথা বলে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ একজন হালকা করে নিঃশ্বাস ফেলল। জবাব দিল। আমি দীর্ঘ রচনাটা পড়ে শেষ করলাম। কোনো কথাবার্তা শুনলাম না। পর পর দু’টা সিগারেট টেনে ঘুমুতে গেলাম। ভালো ঘুম হলো। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস। বাতাসে জানালা নড়ছে। খটখট শব্দ হচ্ছে। খুবই বিরক্তি লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঘুমটা পুরোপুরি কাটে নি। আরো কিছুক্ষণ ঘুমানো যায়। এই সময় দুপুরের নারীকণ্ঠ আবার শুনলাম। সে মধুর গলায় বলল, আর কত শুয়ে থাকবেন?
দুপুরের নারীকণ্ঠের কথা কিছুই মনে ছিল না। হঠাৎ সবটা এক সঙ্গে মনে পড়ল। আমি হতভম্ব গলায় বললাম, একী! বিছানা থেকে নামলাম। হাত-মুখ ধুলাম। এবং খুবই স্বাভাবিকভাবে এক তলায় চলে গেলাম। রফিক সঙ্গে সঙ্গে মগভর্তি চা নিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, স্যারের কি শরীর খারাপ? আমি বললাম, না, শরীর ঠিক আছে। তার চোখ থেকে উদ্বিগ্ন ভাব দূর হলো না। রফিক আমার সঙ্গে আছে প্রায় বার বছর। বার বছর দু’জন মানুষ পাশাপাশি থাকলেই একজন আরেকজনের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করে। এটা জগতের অনেক গুরুত্বহীন সাধারণ নিয়মের একটি। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, রফিক, আমাদের বাড়িতে কি ভূত আছে? রফিক সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি স্যার আছে।তুমি কখনো দেখেছ? জি।ভূতটা কী করে? কিছু করে না। হাসে কান্দে। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। মসলা পিষে।মসলা পিষবে কেন? ভূতের কি রান্নাবান্না করার কোনো ব্যাপার আছে?