‘সে অনেক অনেক দিন আগের কথা।’ দাদু কথা শেষ না করতেই মাহিরা বলল,……‘তা কতদিন আগের কথা দাদু?’………‘সেটাতো বলতে পারবো না। তবে এটা জানি যে, সে অনেক অনেক দিন আগের কথা।’ দাদু বললেন। ‘এক দেশে এক বন ছিল আর ছিল একটা গ্রাম।’
মাহিরা বলল, ‘দাদু, দেশটার নাম কী?’……..‘একদেশ। এর চে বেশি জানি নে।’……….‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে বলো একটা দেশে একটা গ্রাম থাকে? একটা বন থাকে? অনেক গ্রাম থাকে। অনেক বন থাকতে পারে।’
‘তা হবে হয়তো। তোমরা লেখাপড় করে জেনেছো। আমরা গল্প শুনে জেনেছি।’ দাদু বললেন। ‘এখন গল্পটা শুনবে নাকি শুনবে না?’……….মাহিরা বলল, ‘শুনবোই তো। বলো তারপর কি হল।’…….‘সেই বনে একটা কুকুর ছিল। আর ছিল এক বিড়াল।’
‘মাহিরা বলল, ‘দাদু, একটা বনে একটা কুকুর আর একটা বিড়াল থাকে না? অনেক অনেক প্রাণীই থাকে।’…….দাদু বলল, ‘বলব না গল্প।’ রাগ করে চুপটি মেরে বসে রইল।……মাহিরা দাদুর নিকট এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আর বলবো না কিচ্ছুটি। এবার বল। আমি চুপটি মেরে শুনছি।’
দাদু এবার খুশি হয়ে বলল, ‘শোন তাহলে,….একদিন বিড়ালটা একটা নেংটি ইঁদুরের তাড়া খেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঢুকে পড়ল বনে। একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। এখন আর ভয় নেই। তবে বুকের ধুকধুকানি এখনো যায়নি। বাব্বা, বাঁচা গেল এ যাত্রা।
এমন সময় কুকুরটাও হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বনে। সেও শিয়ালের তাড়া খেয়েছে। কুকুরটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বিড়াল মাসি তুমিও তাড়া খেয়ে এসেছো বুঝি?’…..বিড়াল বলল, ‘হ্যাঁ, এমন তাড়া জীবনে এই প্রথম। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরে যাব যে। কিছু একটা উপায় বের কর হে।’
কুকুর বলল, ‘বাড়িতে বাড়িতে এখন পাহারায় থাকে শিয়াল। জানোইতো, শিয়াল খুব চালাক প্রাণী। ওর সাথে আর পারি না।’…….বিড়াল বলল, ‘তোমার মত আমারও একই দশা। প্রত্যেক বাড়িতে এখন ইঁদুর পাহারায় থাকে। ইঁদুরের অত্যাচারে বাড়িতে আর ঢোকার কায়দা নেই।’
গ্রামে বল আর শহরে বল সব জায়গায় এখন বাড়িতে বাড়িতে শিয়াল পাহারায় থাকে। দেশি, বিদেশি শিয়াল রেখে দিয়েছে বাড়িওয়ালা।…বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চারা ইঁদুর পোষে। ইঁদুর ওদের খুব ভালো লাগে। বিড়ালেরা মাছ খেয়ে পালাই। বিড়াল তাড়াতেই এই ব্যবস্থা। এখন একটা নেংটি ইঁদুরের ভয়ে বিড়াল পালিয়ে বাঁচে।
একদিন বনের সমস্ত কুকুর আর বিড়াল একজায়গায় হল।……বিড়াল সর্দার বলল, ‘তোমরা সবাই জান পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিলিন হয়ে যাব। শুধু আমরাই না, কুকুর জাতিও শেষ হয়ে যাবে।’
কুকুর সর্দার বলল, ‘একদিন আমরাই বাড়ি পাহারা দিতাম। শিয়াল তাড়িয়ে বেড়াতাম রাত বিরাতে। অথচ আজ আমরা বাড়ি কর্তার তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। শিয়ালেরা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এটা লজ্জার ব্যাপার। ছি ছি ছি।’
বিড়াল সর্দার বলল, ‘একদিন আমরাও প্রতিটি বাড়ির বাচ্চাদের কাছে প্রিয় ছিলাম। ছোট ছেলেমেয়েরা কোলের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকতো। মাছ খেত দিত। ইঁদুর তাড়াতে আমাদের বাড়িতে রাখা হত। কিন্তু আজ আমাদেরকেই ইঁদুরের তাড়া খেতে হচ্ছে?’
সভার মধ্যে থাকা একটা বৃদ্ধ কুকুর বলল, ‘বাছারা, কুকুর ছিল বিশ^স্ত প্রাণী। বাড়ির কর্তারা হাঁস মুরগি ছাগল পালন করে। এসব পশুগুলোকে শিয়ালের হাত থেকে রক্ষা করতে বাড়িতে কুকুর পোষা হত। চোর ডাকাত যেন না ঢুকতে পারে এজন্য কুকুর পুষতো। কুকুরকে খাবার দিত তিন বেলা। বড় আদর যতেœ ছিল এই কুকুর জাতি। কিন্তু এক সময় এই কুকুর তার মনিবকে কামড় দিতে শুরু করল। বাড়ির হাস মুরগি ছাগল ধরে খেতে লাগল। তখন বাড়ির কর্তারা কুকুর খেদিয়ে দিল। পোষ মানাতে লাগল শিয়াল জাতিকে।’
সভায় বসে থাকা বৃদ্ধ বিড়াল বলল, ‘ঠিক আমাদেরও ওরকম দিন ছিল। বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমাদের আদর করে পুষতো। দুধ খেতে দিত। মাছ খেতে দিত। এক সাথে ঘুমাত। পাতের এক মুষ্ঠি ভাত রেখে দিত আমাদের জন্য। কিন্তু দিন দিন এই বিড়াল জাতি চুরি করতে শিখল। মনিবের পাতের পাশে বসে থাকতো। মনিব এদিক ওদিক তাকালেই পাত থেকে মাছ চুরি করে খেত। এজন্য তারা বিড়াল তাড়িয়ে দিয়ে ইঁদুর পুষতে লাগল।’
বিড়াল বলল, ‘এখন আমাদের উপায় কী? কী করলে আগের দিন ফিরে পাব?’……..বৃদ্ধ কুকুর বলল, ‘আবার আমাদেরকে মনিবের বিশ^স্ত হয়ে উঠতে হবে।’…..বিড়াল বলল ‘সেটা কীভাবে?’….‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।’ কুকুর বলল।
সকলেই বলল, ‘কি বুদ্ধি, কি বুদ্ধি?’….বৃদ্ধ কুকুর বলল, ‘রাতের বেলা আমরা গ্রামের আশে পাশে থাকব। গ্রামে যখন চোর ঢুকবে তখন আমরা ঘেউ ঘেউ ডেকে মানুষদেরকে জাগিয়ে তুলব। তাহলে মানুষেরা আবারও আমাদেরকে আগের মত খাবার দিয়ে দয়া করে বাড়িতে রাখবে। তাড়াবে না।’
বৃদ্ধ বিড়াল বলল, ‘তোমরা বুকে সাহস রাখ। ইঁদুর দেখে ভয়ে পালাবে না। দাঁড়াও ইঁদুরের মুখোমুখি। বাড়িতে বাড়িতে খুঁজে দেখো ইঁদুর কোনো জিনিসপত্র কাটছে কিনা। কাটা জিনিসপত্র খুঁজে খুঁজে বাড়িওয়ালার সামনে টেনে বের কর। বাড়িওয়ালা যখন দেখবে তার মূল্যবান কাগজপত্র কেটে দিচ্ছে তখনই ইঁদুর তাড়িয়ে বিড়াল রাখবে ঘরে।’
এভাবেই কুকুর তার স্থান দখল করে নিল। বিড়াল আবার আগের মত আদর পেয়ে বাড়ির ছোট্ট সোনামনিদের সাথে খেলার সুযোগ পেল।