তাহের দু‘টা পাচশ‘ টাকার নােট বের করল। তিনি বিরসমুখে নােট দুটা হাতে নিলেন। তাহের বলল, উত্তর দিকে ভাঙা দেয়াল ঠিক করার জন্যে টাকা চেয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলাম। দেয়াল তাে ঠিক হয় নি।
বললেই ঠিক হয় না। ইট, সুরকি, সিমেন্ট আনাইতে হয় শহর থাইক্যা। বর্ষা মৌসুমে নৌকা দিয়া আনতে হয়। বিরাট যন্ত্রণা।
‘টাকাটা কি করেছেন? ‘আছে ঢাকা আলাদা করা আছে। ‘বাড়িটার এ কি অবস্থা ! ভূতের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। আলাের কোন ব্যবস্থা
করেছেন?
‘দুইটা হারিকেন আছে। মােমবাতি আছে। ‘একটা টর্চের ব্যবস্থা করুন।
‘আইচ্ছা করব। বললেই তাে হয় না। সব আনতে হয় শহর থাইক্যা। তােমরারে একটা উপদেশ দেই – দোতলায় থাকবা। একতলায় নামনের প্রয়োজন নাই।
“কেন?” ‘সাপের উপদ্রপ। গত চইত মাসে সাপের কামড়ে একটা গরু মারা গেল। ‘কার্বলিক এসিডের ব্যবস্থা করতে পারবেন? এখানে কোন ফার্মেসি আছে?”
আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
‘না। তুমি বললে ছেলে একটারে শহরে পাঠাইতে পারি। এরা কিছুই করে না। বাদাইম্যা হইছে। শহরে যাইতে বললে ফাল দিয়া উঠে।
‘দিন, কাউকে পাঠিয়ে দিন।
‘যাওনের খরচ দেও। আর কি আনা লাগব কাগজে লেইখ্যা দেও। সাপের অষুধ ? অষুধে কিছু হয় না – কপালে লেখা থাকলে অষুধের বােতলের ভিতরে বসা থাকলেও সাপে কামরাইব। ‘আমি কাগজে লিখে দিচ্ছি। দয়া করে আনাবার ব্যবস্থা করুন। একশ’ টাকা। দিচ্ছি যাওয়ার খরচ। এতে হবে?”
‘আরাে কিছু দেও। একশ’ টেকা আইজকাইল কোন টেকাই না। তুমি থাক বেদেশে। এই জন্যে বুঝতাছ না। আর একটা কথা, তােমার পরিবাররে নিয়া আমরার বাড়িত একদিন যাওয়া । গ। বাড়ির মেয়েছেলেরা দেখতে চায়। এরা আবার কার কাছ থাইক্যা জানি হুনছে – বিলাতের মাইয়াছেলে পিসাব পায়খানার পরে পানি নেয় না। বড় ‘ঘিন্নাকর’, কিন্তু কি আর করা! যে দেশে যে নিয়ম! তােমার আমার করণের কিছু নাই।
তাহের বিরক্তমুখে বলল, ঠিক আছে আপনি এখন যান। রাতে খাবার পাঠিয়ে দেবেন। খাবার পানি পাঠাবেন।
‘আইচ্ছা। তােমরা নিশ্চিত হইয়া ঘুমাও। ছেলে দুইটারে বইল্যা দিছি রাইতে পাহারা দিতে। এরা কাজকাম কিছুই করে না। বাদাইমা। যে কয়দিন থাকবা এরা পাহারা দিব। কিছু খরচ–বরচ দিও।
আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
তাহের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। | লিলিয়ান হারিকেন হাতে দোতলার বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে। তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ইস্কান্দর আলি দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তােমার ইসতিরি বড়ই সৌন্দর্য। এইটা বিপদের কথা। ডাকাইতে সন্ধান পাইলে বড়ই খুশি হইব। ইস্কান্দর আলির দুই ছেলেও গভীর আগ্রহ নিয়ে
দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে পলক পড়ছে না। লিলিয়ান বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল, উপরে চলে আস। দোতলাটা অসম্ভব সুন্দর। মার্বেল পাথরের মেঝে।
লিলিয়ানের খুব ভাল লাগছে। সে হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি কিশােরীর মত। যে ঘরে আজ রাতে তারা থাকবে সেই ঘর। দেখে সে মুগ্ধ। বিশাল দুটা জানালা। জানালার পাশে দাড়ালেই দূরের ব্রহ্মপুত্র দেখা যায়। নদীতে চর পড়েছে। চরের ধবধবে সাদা বালি চাদের আলােয় চিকচিক করছে। কি হাওয়া! উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। শােবার ঘরটা কি প্রকাণ্ড ! যেন ফুটবল খেলার মাঠ। মাঠের মাঝখানে খাট পাতা হয়েছে। কালাে রঙের একটা খাট, যার চারদিকে রেলিং দেয়া। খাটে সরাসরি উঠার উপায় নেই, এত উচু। টুলে পা। দিয়ে উঠতে হয়। ঘর ভর্তি ভারী ভারী আলমিরা। লিলিয়ান প্রতিটি আলমিরা খুলে দেখল। সব শূন্য। খাটের মাথার কাছে গােল শ্বেত পাথরের টেবিল।
আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
এ বাড়ির অনেক দরজা–জানালা লােকজন খুলে নিয়ে গেছে। এগুলি নেয় নি কেন?
লিলিয়ান বলল, এই টেবিল, এই খাট যে কোন মিউজিয়াম লুফে নেবে। মনে হচ্ছে হাজার বছরের পুরানাে। | লিলিয়ানের মুগ্ধতা তাহেরকে স্পর্শ করছে না। সে বেশ ক্লান্ত। বারান্দায় রাখা বালতির পানিতে হাত–মুখ ধুয়ে সে বিছানায় বিরসমুখে বসে আছে। এ বাড়িতে রাত্রিযাপন ঠিক হবে কি না তা বুঝতে পারছে না। সাপের ব্যাপারটা তাকে চিন্তিত করছে।
লিলিয়ান বলল, কথা বলছ না কেন? ‘কি বলব?” “তােমাদের এইসব ফার্নিচারের বয়স কত?
তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, এদের বয়স দু‘শ বছরের মত । সবই আমার দাদার বাবা বানিয়েছিলেন। খাটটা বর্মা থেকে কেনা। এই যে বাড়ি দেখছ, এই বাড়িও উনার করা।।
‘খুব ধনী মানুষ ছিলেন?
‘হতদরিদ্র ছিলেন। পরের বাড়িতে কামলা খাটতেন। সুপারির ব্যবসা করে ধনী হন। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি লাখের বাতি জ্বালিয়েছিলেন।
‘লাখের বাতিটা কি?
‘আমাদের অঞ্চলে নিয়ম ছিল – কেউ লাখপতি হলে লাখের বাতি জ্বালাতে হত। একটা লম্বা বাঁশের মাথায় হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরের উঠানে রেখে দিত। এই
হল লাখের বাতি। দূর থেকে দেখে লােকজন বুঝত এই অঞ্চলে একজন লাখপতি
আছে।
‘এই নিয়ম কি এখনাে আছে?‘ | ‘পাগল হয়েছ? এই নিয়ম থাকলে উপায় আছে? আজ কোন বাড়িতে লাখের বাতি জ্বালালে কালই ডাকাতি হবে। সেই বাড়িতে যদি তােমার মত রূপবতী কেউ থাকে তাহলে তাে কথাই নেই।
আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
‘আমার মনে হয় এ বাড়িতে এসে তোমার ভাল লাগছে না।
এখন পর্যন্ত ভাল লাগার মত কোন কারণ ঘটে নি। ‘আমার কাছে কিন্তু অসাধারণ লাগছে। ‘ভাঙা বাড়ি অসাধারণ লাগছে?
‘পুরনাে বাড়ি ভাঙা তো থাকবেই। এই অঞ্চলের জন্যে পুরনাে বাড়ি সুন্দর মানিয়ে গেছে। ঝকঝকে নতুন বাড়ি এখানে মানাতাে না। আমি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছি আর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
ভয়ে ? ‘না ভয়ে না। মনে হচ্ছে এই সব ঘরগুলিতে কত না স্মৃতি, কত রহস্য – আমি ঠিক করেছি আজ সারারাত ঘুমুব না।‘
‘হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঘুরবে?” ‘হঁ্যা। ‘খুব ভাল কথা। ঘুরে বেড়াও। দয়া করে আমাকে ঘুমুতে দিও। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে আছি। ডিনার শেষ হওয়া মাত্র শুয়ে পড়ব।
Read more