আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

আয়নাঘর

তাহের দুটা পাচশটাকার নােট বের করলতিনি বিরসমুখে নােট দুটা হাতে নিলেনতাহের বলল, উত্তর দিকে ভাঙা দেয়াল ঠিক করার জন্যে টাকা চেয়েছিলেনপাঠিয়েছিলামদেয়াল তাে ঠিক হয় নি। 

আয়নাঘর

বললেই ঠিক হয় নাইট, সুরকি, সিমেন্ট আনাইতে হয় শহর থাইক্যাবর্ষা মৌসুমে নৌকা দিয়া আনতে হয়বিরাট যন্ত্রণা। 

টাকাটা কি করেছেন? আছে ঢাকা আলাদা করা আছেবাড়িটার কি অবস্থা ! ভূতের বাড়ি বলে মনে হচ্ছেআলাের কোন ব্যবস্থা 

করেছেন

দুইটা হারিকেন আছেমােমবাতি আছেএকটা টর্চের ব্যবস্থা করুন। 

আইচ্ছা করববললেই তাে হয় নাসব আনতে হয় শহর থাইক্যাতােমরারে একটা উপদেশ দেই দোতলায় থাকবাএকতলায় নামনের প্রয়োজন নাই। 

কেন?সাপের উপদ্রপগত চইত মাসে সাপের কামড়ে একটা গরু মারা গেলকার্বলিক এসিডের ব্যবস্থা করতে পারবেন? এখানে কোন ফার্মেসি আছে?” 

আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

নাতুমি বললে ছেলে একটারে শহরে পাঠাইতে পারিএরা কিছুই করে নাবাদাইম্যা হইছেশহরে যাইতে বললে ফাল দিয়া উঠে। 

দিন, কাউকে পাঠিয়ে দিন। 

যাওনের খরচ দেওআর কি আনা লাগব কাগজে লেইখ্যা দেওসাপের অষুধ ? অষুধে কিছু হয় না কপালে লেখা থাকলে অষুধের বােতলের ভিতরে বসা থাকলেও সাপে কামরাইবআমি কাগজে লিখে দিচ্ছিদয়া করে আনাবার ব্যবস্থা করুনএকশ’ টাকাদিচ্ছি যাওয়ার খরচএতে হবে?” 

আরাে কিছু দেও। একশটেকা আইজকাইল কোন টেকাই নাতুমি থাক বেদেশেএই জন্যে বুঝতাছ নাআর একটা কথা, তােমার পরিবাররে নিয়া আমরার বাড়িত একদিন যাওয়া বাড়ির মেয়েছেলেরা দেখতে চায়এরা আবার কার কাছ থাইক্যা জানি হুনছে বিলাতের মাইয়াছেলে পিসাব পায়খানার পরে পানি নেয় নাবড় ঘিন্নাকর, কিন্তু কি আর করা! যে দেশে যে নিয়ম! তােমার আমার করণের কিছু নাই। 

তাহের বিরক্তমুখে বলল, ঠিক আছে আপনি এখন যানরাতে খাবার পাঠিয়ে দেবেনখাবার পানি পাঠাবেন। 

আইচ্ছাতােমরা নিশ্চিত হইয়া ঘুমাওছেলে দুইটারে বইল্যা দিছি রাইতে পাহারা দিতেএরা কাজকাম কিছুই করে নাবাদাইমাযে কয়দিন থাকবা এরা পাহারা দিবকিছু খরচবরচ দিও

আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

তাহের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললতার মনটাই খারাপ হয়ে গেল| লিলিয়ান হারিকেন হাতে দোতলার বারান্দায় এসে দাড়িয়েছেতাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছেইস্কান্দর আলি দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তােমার ইসতিরি বড়ই সৌন্দর্যএইটা বিপদের কথাডাকাইতে সন্ধান পাইলে বড়ই খুশি হইবইস্কান্দর আলির দুই ছেলেও গভীর আগ্রহ নিয়ে 

দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেতাদের চোখে পলক পড়ছে নালিলিয়ান বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল, উপরে চলে আসদোতলাটা অসম্ভব সুন্দরমার্বেল পাথরের মেঝে। 

লিলিয়ানের খুব ভাল লাগছেসে হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছেতার ভাবভঙ্গি কিশােরীর মতযে ঘরে আজ রাতে তারা থাকবে সেই ঘরদেখে সে মুগ্ধবিশাল দুটা জানালাজানালার পাশে দাড়ালেই দূরের ব্রহ্মপুত্র দেখা যায়নদীতে চর পড়েছেচরের ধবধবে সাদা বালি চাদের আলােয় চিকচিক করছেকি হাওয়া! উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়শােবার ঘরটা কি প্রকাণ্ড ! যেন ফুটবল খেলার মাঠমাঠের মাঝখানে খাট পাতা হয়েছেকালাে রঙের একটা খাট, যার চারদিকে রেলিং দেয়াখাটে সরাসরি উঠার উপায় নেই, এত উচুটুলে পাদিয়ে উঠতে হয়ঘর ভর্তি ভারী ভারী আলমিরালিলিয়ান প্রতিটি আলমিরা খুলে দেখলসব শূন্যখাটের মাথার কাছে গােল শ্বেত পাথরের টেবিল

আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

বাড়ির অনেক দরজাজানালা লােকজন খুলে নিয়ে গেছেএগুলি নেয় নি কেন

লিলিয়ান বলল, এই টেবিল, এই খাট যে কোন মিউজিয়াম লুফে নেবেমনে হচ্ছে হাজার বছরের পুরানাে| লিলিয়ানের মুগ্ধতা তাহেরকে স্পর্শ করছে নাসে বেশ ক্লান্তবারান্দায় রাখা বালতির পানিতে হাতমুখ ধুয়ে সে বিছানায় বিরসমুখে বসে আছেবাড়িতে রাত্রিযাপন ঠিক হবে কি না তা বুঝতে পারছে নাসাপের ব্যাপারটা তাকে চিন্তিত করছে। 

লিলিয়ান বলল, কথা বলছ না কেন? কি বলব?তােমাদের এইসব ফার্নিচারের বয়স কত

তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, এদের বয়স দুবছরের মত সবই আমার দাদার বাবা বানিয়েছিলেনখাটটা বর্মা থেকে কেনাএই যে বাড়ি দেখছ, এই বাড়িও উনার করা। 

খুব ধনী মানুষ ছিলেন

হতদরিদ্র ছিলেনপরের বাড়িতে কামলা খাটতেনসুপারির ব্যবসা করে ধনী হনমাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি লাখের বাতি জ্বালিয়েছিলেন। 

লাখের বাতিটা কি

আমাদের অঞ্চলে নিয়ম ছিল কেউ লাখপতি হলে লাখের বাতি জ্বালাতে হতএকটা লম্বা বাঁশের মাথায় হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরের উঠানে রেখে দিতএই 

হল লাখের বাতিদূর থেকে দেখে লােকজন বুঝত এই অঞ্চলে একজন লাখপতি 

আছে। 

এই নিয়ম কি এখনাে আছে?| পাগল হয়েছ? এই নিয়ম থাকলে উপায় আছে? আজ কোন বাড়িতে লাখের বাতি জ্বালালে কালই ডাকাতি হবেসেই বাড়িতে যদি তােমার মত রূপবতী কেউ থাকে তাহলে তাে কথাই নেই

আয়নাঘর-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ

আমার মনে হয় বাড়িতে এসে তোমার ভাল লাগছে না। 

এখন পর্যন্ত ভাল লাগার মত কোন কারণ ঘটে নিআমার কাছে কিন্তু অসাধারণ লাগছেভাঙা বাড়ি অসাধারণ লাগছে

পুরনাে বাড়ি ভাঙা তো থাকবেইএই অঞ্চলের জন্যে পুরনাে বাড়ি সুন্দর মানিয়ে গেছেঝকঝকে নতুন বাড়ি এখানে মানাতাে নাআমি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছি আর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। 

ভয়ে ? না ভয়ে নামনে হচ্ছে এই সব ঘরগুলিতে কত না স্মৃতি, কত রহস্য আমি ঠিক করেছি আজ সারারাত ঘুমুব না‘ 

হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঘুরবে?হঁ্যা খুব ভাল কথাঘুরে বেড়াওদয়া করে আমাকে ঘুমুতে দিওআমি খুব ক্লান্ত হয়ে আছিডিনার শেষ হওয়া মাত্র শুয়ে পড়ব। 

 

Read more

আয়নাঘর-পর্ব-(১৬)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *