আয়নাঘর-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ

আয়নাঘর

তা ছাড়া মা’র সঙ্গে তিন মিনিট কথা বলাও যাবে না। একবার টেলিফোন হাতে পেলে তিনি ছাড়বেন না। রাজ্যের কথা বলতে থাকবেন। লিলিয়ান যদি বলে – এখন রাখি মা, বিল উঠছে। মা বলবেন – আর একটু, জুরুরী কথাটাই বলা হয় নি।

আয়নাঘর

তোর পজার চাচা ঐদিন কি করেছে শােন। ঐ লােকটার আক্কেল বলে এক জিনিস এখনাে হল না। এদিকে তার ডেনটিস্ট বলেছে তার নাকি তিনটা আক্কেল দাঁত। এমন কথা কি শুনেছিস কখনো — তিনটা আক্কেল দাঁত ?
বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে লিলিয়ানের ঘুম এল শেষ রাতে। ঘুম আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সে অপরিচিত একটা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল নদী। পানিতে কানায় কানায় ভর্তি। নদী, নদীর ওপাশে বন-সব জোছনায় থৈ-থৈ করছে।

হঠাৎ মাঝ নদীতে কালােমত কি দেখা গেল। স্রোতের প্রবল টানে ভেসে যাচ্ছে। লিলিয়ান দেখতে পাচ্ছে না তবু পরিষ্কার বুঝতে পারছে। নদীর স্রোতে যে জিনিসটা ভেসে যাচ্ছে তা একটা মৃতদেহ। মৃতদেহটা লিলিয়ানের চেনা। খুব চেনা। মৃত মানুষ প্রশ্নের জবাব দেয় না। তবু লিলিয়ান চিল্কার করে উঠল
– কে কে কে?

আয়নাঘর-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ

স্বপ্নে সবই সম্ভব। মৃতদেহ কথা বলল। অনেক কষ্টে পানির উপর উঠে বসল।
ক্ষীণ গলায় বলল, লিলিয়ান আমি। ওরা আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে। তুমি আমাকে বাঁচাও।
লিলিয়ান আতংকে অস্থির হয়ে বলল, আমি কি করে তােমাকে বাঁচাব? তুমি তাে মরেই গেছ।

‘বাঁচাও লিলিয়ান বাঁচাও। প্লীজ প্লীজ। এই সময় নদীর স্রোত বেড়ে গেল। জলের প্রবল টান উপস্থিত হল। শোঁ-শো শব্দ হতে লাগল। মৃতদহটি ভাটির দিকে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে। অনেক অনেক দূর থেকে সে ডাকছে – লিলিয়ান লিলিয়ান।

লিলিয়ান নদীর পাড় ঘেঁসে ছুটতে শুরু করেছে। খানাখন্দ ঝােপঝাড় ভেঙে সে ছুটছে। মনে হচ্ছে সে আর দৌড়াতে পারবে না। হুমড়ি খেয়ে পড়বে। মৃতদেহ এখনাে তাকে ডাকছে। মৃতদেহের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। সেই স্বর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লিলিয়ানের কান পর্যন্ত পৌছাতে পারছে না। | এই অবস্থায় লিলিয়ানের ঘুম ভাঙল। তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জেগে উঠার পরেও সে অনেকক্ষণ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপল। তার ভয়ের অনেকগুলি কারণের একটি হচ্ছে, যে যুবকের মৃতদেহটি ভেসে যাচ্ছিল সেই যুবক তার চেনা। যুবকের নাম – তাহের। দেখা হয়েছিল ইয়েলাে স্টোন পার্কে। তার গায়ে ছিল হলুদ রঙের গলাবন্ধ স্যুয়েটার। স্বপ্নেও সেই একই স্যুয়েটার ছিল, তবে তার রঙ ছিল ধূসর।

তীব্র ভয় অনেকটা যেমন হঠাৎ আসে তেমনি হঠাৎই চলে যায়। রােদ উঠার সঙ্গে সঙ্গে লিলিয়ানের ভয় কেটে গেল। শুধু যে ভয় কাটল তাই না, হাসিও পেতে লাগল। তার মনে হল সে এমন কিছু ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে নি। নদী। দেখেছে নদী কোন ভয়ংকর জিনিস নয়। নদী দেখার কারণও আছে। আগের দিন পুরাে সময়টা কাটিয়েছে ওল্ড ফেইথফুল হৃদের তীরে। তাহের নামের ছেলেটিকে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছে সেটাও স্বাভাবিক। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাক্ষাৎ পর্বও খুব সুখকর ছিল

আয়নাঘর-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ

মস্তিষ্ক এই ব্যাপারগুলিই তার নিজের মত করে সাজিয়েছে। লিলিয়ানের পরিষ্কার মনে আছে – ছােটবেলায় সে যার সঙ্গেই ঝগড়া করত রাতে তাকেই স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্নগুলিও হত ভয়ংকর।
লিলিয়ান ঠিক করল আজ ইউনিভার্সিটিতে যাবে না। আজ একটামাত্র ক্লাস। এই ক্লাস এমন জরুরী নয়। না করলে ক্ষতি হবে না। তারচে বরং ক্যান্টিনে যাওয়া যাক। কোন কাজ পাওয়া যায় কি-না সেই চেষ্টা করা যেতে পারে। চার-পাঁচ ঘন্টা কাজ করতে পারলে – ইয়েলাে স্টোন পার্কের খরচ কিছুটা উঠে আসবে।

ক্যান্টিনে কোন কাজ পাওয়া গেল না। সে সুইমিং পুলের দিকে গেল। অকারণে
যাওয়া। সাঁতার কাটতে হলে টিকিট লাগবে। তার টিকিট কাটার মত ডলার নেই। কি অদ্ভুত দেশ এই আমেরিকা। কারাে মুখে ডলার ছাড়া অন্য শব্দ নেই।
লিলিয়ান বেশ অনেকক্ষণ সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা দেখল। তার কাছে সব সময় মনে হয় পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্যের একটি হচ্ছে – মানুষের সঁতারের দৃশ্য। মানুষ যদি উড়তে পারত তাহলে সেই দৃশ্য নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হত।

লিলিয়ান স্যান্ডউইচ কিনে ইউনিভার্সিটি বােটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে গেল। লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে তার এখানে একটি প্রিয় জায়গা আছে। মেপল গাছের নিচের বাঁধানাে বেদী। গাছের পাতা হলুদ হতে শুরু করেছে। কি সুন্দর লাগছে গাছটাকে। সে একা একা সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছের নিচে বসে রইল। আরাে কিছুক্ষণ বসত। শীত শীত করছে। সুয়েটারে শীত মানছে না। তা ছাড়া ঘুমও পাচ্ছে। পড়াশােনা করা। দরকার। মনে হচ্ছে আজ পড়া হবে না। সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হবে।

আয়নাঘর-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ

আশ্চর্য ব্যাপার আজ রাতেও লিলিয়ানের ঘুম হল না। শেষ রাতের দিকে তামত হল। তদ্রায় দেখল দুঃস্বপ্ন। আগের রাতের স্বপ্নটাই অন্যভাবে দেখা। সে এবং তাহের দৌড়াচ্ছে। প্রাণপণে ছুটছে। তাদের তাড়া করছে ভয়ংকর কিছু মানুষ। তাহের বলছে, লিলিয়ান আমার হাত ধর। আমি দৌড়াতে পারছি না। প্লীজ, আমার হাত ধর। প্লীজ।
লিলিয়ান চিৎকার করে জেগে উঠল। নিজেকে শান্ত করতে তার সময় লাগল। হিটিং কয়েল দিয়ে গরম এক কাপ কফি খেয়ে মা’কে চিঠি লিখতে বসল।

আমার কি জানি হয়েছে – দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন। আমার রাতে ঘুম হচ্ছে না। তুমি চার্চে গিয়ে আমার নামে দুটা বাতি জ্বালিও …
এই পর্যন্ত লিখেই লিলিয়ান চিঠি ছিড়ে ফেলল। এ ধরনের চিঠি মা’কে দেয়ার কোন মানে হয় না। তিনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় পড়বেন। তাঁর হাঁপানীর টান উঠে যাবে। সে নতুন একটি চিঠি লিখল। সেখানে খুব সুন্দর করে লেখা হল – ইয়েলাে স্টোন পার্কে বেড়াতে যাবার বর্ণনা। ইউনিভার্সিটি সুইমিং পুলে সঁতারের আনন্দ বিবরণ।

ভাের সাতটায় সে তৈরি হল ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্যে। আয়নায় একবার নিজেকে দেখল। দু’রাত ঘুম হয় নি। কিন্তু চেহারায় ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। তার নিজের কাছে মনে হল আজ তার চোখ অন্যদিনের চেয়েও অনেক উজ্জ্বল।

আয়নাঘর-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ

আজ লাঞ্চ আওয়ারের আগে কোন ক্লাস নেই। কিন্তু টার্ম পেপার জমা দিতে হবে – লাইব্রেরীতে বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করতে হবে। বিরক্তিকর কাজগুলির মধ্যে একটি। যে বইটি তার প্রয়ােজন দেখা যাবে সেটি ছাড়া সব বইই আছে।
এককেদিন একেকজনের ভাগ্য খুব ভাল থাকে। আজ লিলিয়ানের ভাগ্য খুবই
ভাল। যে বইগুলি তার দরকার ছিল সবই সে পেয়ে গেল – বাড়তি পেল একটি মনােগ্রাফ – তার টার্ম পেপারের সঙ্গে মনােগ্রাফের কোন বেশকম নেই। টুকে ফেললেই হয়। দু ঘন্টার মধ্যে টার্ম পেপার লেখা শেষ হল। লিলিয়ান কফি হাউসে কফি খেতে গেল। ঘুমঘুম লাগছে। কফি খেয়ে ঘুম তাড়াতে হবে নয়ত ক্লাস করা যাবে না।
কফি হাউস ছাত্রছাত্রীতে ঠাসা। এখন লাঞ্চ আওয়ার। কফি শপে এত ভিড় থাকার কথা নয়। আজ এত ভিড় কেন ? আজ কি সস্তায় কফি দিচ্ছে? না ফ্রী কফি দিচ্ছে।

 

Read more

আয়নাঘর-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *