ইনসুলিন সম্বন্ধে কিছু কথা জেনে নিন

ইনসুলিন সম্বন্ধে কিছু কথা জেনে নিন

অনেক ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয় । তাদের ঔষধের মাত্রা নির্ধারণ আদর্শগতভাবে একজন চিকিৎসকের পরামর্শেই হওয়া উচিত । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রতিদিনের প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের উপর ঔষধের মাত্রা নির্ধারণ করার জন্য চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না । তাই ইনসুলিনের মাত্রা কিভাবে সামান্য পরিবর্তন করতে হয় তা প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীর জানা দরকার ।

ইনসুলিন সম্বন্ধে কিছুকথা

আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়ঃ

(১) স্বচ্ছ (রেগুলার, একট্রাপিড ইত্যাদি) এবং

(২) ঘোলাটে (লেন্টি, এনপিএইচ, ইনসুলের্টাড ইত্যাদি) ।

প্রথমটি দেখতে পানির মতো স্বচ্ছ, এর কাজ আরম্ভ হয় ৩০ মিনিট পরে ২ থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশী কাজ করে এবং এর কাজের স্থিতিকাল ৬ থেকে ৮ ঘন্টা । দ্বিতীয়টি দেখতে ঘোলাটে, এর কাজ আরম্ভ হয় ১ ঘন্টা পরে, এটি ৬ থেকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী কাজ করে আর এর কাজের স্থিতিকাল ১৮ থেকে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে । ইনসুলিন ঠান্ডা জায়গায় রাখা প্রয়োজন । না হলে এর কর্মক্ষমতা কমে যায় । এক মাসের বেশী সময় রাখতে হলে ফ্রিজে ২থেকে ৮সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হবে । গ্রামাঞ্চলে যেখানে ফ্রিজ নেই বা যাদের বাসায় ফ্রিজ নেই তারা মাঝারী আকারের একটা মাটির হাড়িতে পরিস্কার কাপড়ে ইনসুলিনের বোতল পেঁচিয়ে হাড়িতে ঢাকনি বন্ধ করে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার ও ঠান্ডা জায়গায়, যেমন- চৌকি বা খাটের তলায় বা আলমারীতে ইনসুলিন রাখতে পারেন । ফ্রিজ  না থাকলে এক মাসের প্রয়োজনের বেশী ইনসুলিন না কেনাই বাঞ্ছনীয় ।

কোন রোগী যদি সকালে ইনসুলিন ব্যবহার করেন, তবে তার কার্যকারিতা সকালের নাস্তার পর থেকে দুপুরে খাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (কোন কোন ক্ষেত্রে এর পরও) অব্যাহত থাকে । কাজেই সকালের ইনসুলিন ইনজেকশনের মাত্রা বাড়ানো বা কমানো নির্ভর করবে আগের দিনের নাস্তার পর দুপুরের খাবারের আগে প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের পর যদি কারো দুপুরে খাওয়ার আগে ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তার ঔষধ-মাত্রা নির্ভর করবে আগের দিনের দুপুরে খাওয়ার পর বা রাতের খাবার আগের প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের উপর ।

তেমনিভাবে রাতের ঔষধ-মাত্র নির্ভর করবে আগের রাতের খাবারের দুই ঘন্টা পরে বা শোবার আগের প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের উপর । অন্যদিকে ঘোলাটে ইনসুলিন সাধারণত ২৪ ঘন্টায় দুইবার দেবার প্রয়োজন হয় সকালে ও রাত্রে । সকালের ঔষধ মাত্রা নির্ভর করবে আগের দিনের দুপুরের খাওয়ার পর ও রাত্রে খাওয়ার আগের প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের উপর আর রাত্রের ঔষধমাত্রা নির্ভর করবে সকালের নাস্তার আগের প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের উপর ।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক । ধরুন একজন রোগীর সকালে নাস্তার আগে ২০ ইউনিট সলিউবল ইনসুলিন নেওয়ার কথা । কিন্তু পর পর দুই দিন প্রস্রাব পরীক্ষা করে তিনি যদি দেখেন যে ঐ পরিমাণ ইনসুলিন নেওয়ার পরও দুপুরে খাওয়ার আগে তার প্রস্রাব শর্করামুক্ত হচ্ছে না, তাহলে তখন তিনি ইনসুলিনের পরিমাণ ২ ইউনিট বাড়িয়ে দেবেন । ঠিক একই ভাবে দুপুরে খাওয়ার পর বা রাত্রে খাওয়ার আগে যদি পর পর দুই দিন প্রস্রাব শর্করামুক্ত না হয় তাহলে দুপুরে খাওয়ার আগে তাকে স্বচ্ছ ইনসুলিন নিতে হবে অথবা সকালে ঘোলাটে ইনসুলিনের মাত্রা ২ ইউনিট বাড়াতে হবে ।

অনুরূপভাবে রাত্রে খাওয়ার পর বা শোয়ার আগে প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফল দেখে রাতে স্বচ্ছ ইনসুলিনের মাত্রা বাড়াতে হবে । আর যদি তিনি দেখেন যে প্রস্রাব শর্করামুক্ত রয়েছে তবে ধরে নিতে হবে যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তবে ধরে নিতে হবে যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে । এই বিষয়ে সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত হওয়ার জন্য রক্ত পরীক্ষা করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয় করে দেখা যুক্তিযুক্ত । হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজ স্বল্পতা লক্ষণ দেখা দিলে (যেমন – বুক ধড়ফড় করা, হাত-পা কাপা অত্যাধিক ঘাম হওয়া ইত্যাদি) পরের দিন (যে সময় হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল তার আগে) ইনসুলিনের মাত্রা ২ ইউনিট কমিয়ে দিতে হবে ।

যেহেতু রাত্রে আমরা সাধারণত একবারই খাই, সেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, রাত্রে কেবলমাত্র স্বচ্ছ ইনসুলিন নিলেই পরদিন সকালে প্রস্রাব শর্করামুক্ত থাকে । যদি তা না থাকে তাহলে রাত্রে স্বচ্ছ ইনসুলিনের সাথে ঘোলাটে ইনসুলিন মেশাতে হবে । রাতের এই ঘোলাটে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ানো বা কমানো নির্ভর করবে সকালের প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফলের উপর । কমপক্ষে দুই দিন প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফল দেখার পরই কেবল ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ানো কমানো উচিত হবে ।

 

ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়ার নিয়ম

১। প্রথমে দেখে নিন ইনসুলিনের বোতলের ক্যাপ ঠিক আছে কি না এবং বোতলের গায়ে এর কার্যক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার যে তারিখ লেখা আছে, তা অতিক্রম করেছে কি না । লক্ষ্য করুন প্রতি মিলি লিটারে কত ইউনিট ইনসুলিন আছে-৪০ ইউনিট না ১০০ ইউনিট । সেই হিসাবে ইনসুলিন সিরিঞ্জ ব্যবহার করুন ।

২। ইনজেকশন নেবার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (সিরিঞ্জ, তুলা ইত্যাদি) হাতের কাছে রাখুন ।

৩। সাবান ও পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে নিন ।

৪। দুই হাতের তালুর মধ্যে ইনসুলিনের বোতল ধরে ভালভাবে ঘুরিয়ে নিন । তবে জোরে ঝাঁকুনি নেবেন না ।

৫। বোতলের রবার ক্যাপ স্পিরিট দিয়ে মুছে নিন এবং বাতাসে তা আপনা আপনি শুকিয়ে নিন ।

৬। যতটুকু ইনসুলিন দরকার সেই পরিমাণ বাতাস সিরিঞ্জের মধ্যে টেনে নিন । মনে রাখবেন ৪০ ইউনিট সিরিঞ্জ এবং ১০০ ইউনিট ইনসুলিনের জন্য ১০০ ইউনিট সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে ।

৭। এবার সুঁচ বোতলের মুখের রাবারের মাঝখান দিয়ে ভিতরে ঢোকাতে হবে । আপনার হাত যেন সুঁচের কোন অংশে না লাগে ।

৮। সিরিঞ্জের বাতাস বোতলে ঢুকিয়ে দিন ।

৯। এখন সুঁচ সহ বোতলটি উল্টিয়ে ধরুন । দেখবেন এমনিতেই পরিমাণ মতো ইনসুলিন এসে গিয়েছে । প্রয়োজন হলে হালকা টান দিয়ে ইনসুলিন সিরিঞ্জ টেনে নিন ।

১০। সিরিঞ্জ যেন বাতাস বা বুদ্বুদ না থাকে সে বিষয়ে লক্ষ্য করুন । বাতাস বা বুদ্বুদ থাকলে তা বোতলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার ইনসুলিন সিরিঞ্জ টেনে নিন ।

১১। এবার ইনসুলিন সহ সিরিঞ্জ টেনে বের করুন এবং রোগীকে ইনজেকশন দিন ।

১২। যে স্থানে ইনজেকশন দেবেন সেই স্থান স্পিরিট মাখা তুলো দিয়ে ভালভাবে পরিস্কার করুন এবং স্থানটি বাতাসে শুকিয়ে নিন ।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *