এই শুভ্র এই পর্ব:২ হুমায়ূন আহমেদ

এই শুভ্র এই পর্ব:২

একদিন কী হয়েছে শোন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসে আছেন। তার সামনে দিয়ে কিছু সাঁওতাল মেয়ে যাচ্ছে, তাদের খোঁপায় টগর ফুল গোজা। রবীন্দ্রনাথ বললেন, বাহ কী সুন্দর ফুল! ফুলটার নাম কী? তারা বলল, টগর। তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, এত সুন্দর ফুলের এমন বাজে নাম? আমি ফুলটার নাম পাল্টে দিলাম। এখন থেকে ফুলের নাম মহাশ্বেতা। ঘটনাটা ইন্টারেস্টিং না? একজন মানুষের কত ক্ষমতা। ইচ্ছা হলো তো ফুলের নাম পাল্টে দিল। টগর হয়ে গেল মহাশ্বেতা।মোতাহার হোসেন বললেন, ঘটনাটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।বিশ্বাস হচ্ছে না কেন? রবীন্দ্রনাথ টগর ফুল চিনবেন না এটা হতে পারে না। তাছাড়া টগর নামটা মহাশ্বেতার চেয়েও সুন্দর।শুভ্র বলল, বাবা, আমি কিন্তু এই ঘটনা বইয়ে পড়েছি। এমন একজন মানুষের লেখা বই যিনি রবীন্দ্রনাথের খুব ঘনিষ্ঠ।ছাপার অক্ষরে লেখা সব কথাই যে সত্যি তোকে কে বলল?

যে মানুষ মুখে মিথ্যা বলে, সে হাতেও মিথ্যা লিখতে পারে। পারে না? মুখে মিথ্যা বলার চেয়ে বইয়ে মিথ্যা লেখা বরং সহজ।শুভ্র কিছু বলল না। মোতাহার হোসেনের মনে হলো শুভ্ৰ সামান্য মন খারাপ করছে। মন খারাপ করার মতো কোনো কথা তিনি বলেন নি। তার যদি মন খারাপ হয়েও থাকে সে তা প্রকাশ করবে কেন? মানুষের মধ্যে শম্বুক প্রকৃতি আছে। শামুক যেমন কোনো ঝামেলা দেখলে খোলসের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়, মানুষও সে-রকম নিজের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করতে পারে। শুধু শুভ্ৰ পারে না। তার কোনো খোলস নেই। এই সমস্যা সে নিশ্চয়ই জন্মসূত্রে নিয়ে আসে নি। তারা ছেলেকে ঠিকমতো বড় করতে পারেন নি।

মোতাহার হোসেন তার চা খাবার জায়গায় এসে বসলেন। তার হাতে টগর লেখা চিরকুট। চট করে তার মাথায় ম্যাজিকের রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। শুভ্র দশটা ফুলের নাম লিখে এই ধরনের চিরকুট দশটা জায়গায় সাজিয়ে রেখেছে। যদি টগর না বলে গোলাপ বলতেন তাহলে হয়তো গোলাপ লেখা চিরকুটটা একটা বইয়ের নিচ থেকে বের হতো। মূল ব্যাপার হলো কোন ফুলের চিরকুট কোথায় লুকানো সেটা মনে রাখা।এই তুমি এতক্ষণ কী করলে? জাহানারা খুবই বিরক্ত হয়ে মোতাহার হোসেনের দিকে এগুলেন। ঝাঁঝালো গলায় বললেন, তিনটা প্রশ্ন করতে গিয়ে দিন পার করে দিলে? শুভ্র কী বলেছে? সে মাথা দুলিয়ে বই পড়ছিল কেন?

মোতাহার হোসেন বললেন, তার মাথার ভেতর গান বাজছিল। গানের তালে তালে সে মাথা নাড়ছিল।জাহানারা আতঙ্কিত গলায় বললেন, মাথার ভেতর গান বাজছিল মানে কী? এটা আবার কোন ধরনের অসুখ? মোতাহার হোসেন বললেন, এটা কোনো অসুখ না। সবার মাথার ভেতরই গান বাজে। তোমারও বাজে।না, আমার মাথার ভেতর কোনো গান ফান বাজে না; আর বাজলেও আমি এইভাবে মাথা ঝাকাই না। শুভ্র কী বই পড়ছিল?ম্যাজিকের বই।এই বয়সে সে ম্যাজিকের বই পড়বে কেন? এইসব বই সিক্স সেভেনে পড়বে। এতক্ষণ তোমরা কী করলে? শুভ্র আমাকে একটা ম্যাজিক দেখাল। এই জন্যেই দেরি হলো। ফুলের একটা ম্যাজিক।

কী ম্যাজিক? সে দশটা ফুলের একটা লিষ্ট করে আমাকে বলল, যে কোনো একটা ফুলের কথা মনে মনে ভাবতে। আমি টগর ফুলের কথা ভাবলাম। সে তার ট্যালিপ্যাথিক ক্ষমতা দিয়ে বলে দিল। ইন্টারেস্টিং ম্যাজিক।জাহানারার খুবই খারাপ লাগছে। ছেলে তার বাবাকে ম্যাজিক পর্যন্ত দেখিয়ে ফেলেছে। অথচ তার সঙ্গে যে কথা বন্ধ এটা পর্যন্ত তার মনে নেই। যেন এই বাড়িতে জাহানারা নামের কোনো মহিলা বাস করেন না। শেভ করা বন্ধ করেছে কেন- এটা জিজ্ঞেস করেছ? জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর দেয় নি।

তবে আমি যা ধারণা করেছি তাই।তোমার ধারণার কথা তো আমি শুনতে চাচ্ছি না। ওর ধারণাটা জানতে চাচ্ছি। তুমি আবার শুভ্রর কাছে যাও। ভালোমতো জেনে আস।মোতাহার হোসেন বললেন, তুমি তোমার ঘরে যাও। দুটা দশ মিলিগ্রামের রিলক্সিন ট্যাবলেট খেয়ে, দরজা-জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাক। আমি নিশ্চিত তোমার প্রেসার বেড়েছে। নাক ঘামছে। গাল লাল। তোমার কথাবার্তাও জড়িয়ে যাচ্ছে।তুমি শুভ্রর কাছে যাবে না? না। তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমি মাতামাতি করি না।তুমি কী নিয়ে মাতামাতি কর?

মোতাহার হোসেন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। চোখ নামালেন না। তার এই দৃষ্টির সঙ্গে জাহানারা পরিচিত। তিনি শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। এই সময় শুভ্র তার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তার মুখ হাসি হাসি। ভারী চশমার ভেতর দিয়েও তার সুন্দর চোখ দেখা যাচ্ছে। শুভ্র এগিয়ে আসছে তার দিকেই। জাহানারা থমকে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে ছেলের মনে পড়েছে মার সঙ্গে কথা হচ্ছে না। তাও ভালো। জাহানারা ঠিক করে ফেললেন, ছেলের সঙ্গে প্রথম বাক্যটা কী বলবেন। ঠিন গলায় বলবেন, শুভ্র বাবা, বাথরুমে যাও। ক্লিন শেভ হয়ে বের হয়ে আস। সন্ন্যাসী সাজ আমার পছন্দ না।কী আশ্চর্য, শুভ্র তাকে কিছু না বলে তার বাবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।মোতাহার হোসেন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, Hello young man! শুভ্র বলল, Hello old man and the sea! তুই আমার সামনে বসে। দশটা ফলের নাম বল। তোকে আমি মজার একটা ট্যালিপ্যাথিক খেলা দেখাব।

জাহানারা নিজের ঘরে ঢুকলেন। দুটা রিল্যাক্সিনের জায়গায় চারটা রিল্যাক্সিন খেলেন। সকিনাকে ডেকে বললেন, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিতে। সকিনা তার কাজের মেয়ে। সকিনার একমাত্র ডিউটি হচ্ছে তার সেবাযত্ন করা। সকিনার বয়স অল্প। চেহারা সুন্দর। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় বলেই বোধহয় ভাষা সুন্দর। অন্য বুয়াদের মতো আইছি খাইছি বলে না, এসেছি খেয়েছি বলে।

সকিনা বলল, মা, আপনের শরীর খারাপ? তিনি বললে, শরীর ঠিক আছে।সকিনা বলল, মাথায় তেল দিয়ে দেব? দাও। তার আগে এসি ছাড়। ম্যাক্সিমাম কুলে দাও। হাতের কাছে একটা চাদর রাখ। ঘর ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আমার গায়ে চাঁদর দেবে। আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে কেউ যেন আমার ঘুম না ভাঙায়। শুধু শুভ্র এসে ডাকলে ঘুম ভাঙাবে।ঠিক আছে মা।আমি দুপুরে খাব না। খাবারের সময় ডাকবে না। শুভ্ৰ যদি খেতে বসে আমাকে ডাকে তাহলে ঘুম থেকে তুলবে।ঠিক আছে মা।সকিনা চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। জাহানারা আরাম পাচ্ছেন। এই মেয়েটা চুলে বিলি করার ব্যাপারটা জানে। সে গুছিয়ে কথা বলতে ও জানে। আম্মা না বলে সে বলে মা। মা শুনতে ভালো লাগে।

সকিনা! জি মা! শুভ্রর মতো সুন্দর ছেলে কি তুমি তোমার জীবনে দেখেছ? জি-না।আমাকে খুশি করার জন্যে কোনো কথা বলবে না। খুশি করানো কথা আমার পছন্দ না। সত্যিটা বলে।ভাইজানের মতো সুন্দর ছেলে আমি দেখি নি মা।জাহানারা ঘুম ঘুম চোখে বললেন, স্কুলে ছেলেরা শুভ্রকে ডাকত লালটু। স্কুলের ছেলেরা পাজি হয় তো, এই জন্যে পাজি পাজি নাম দেয়। কলেজে তাকে সবাই ডাকত প্রিন্স। ইউনিভার্সিটিতে তার কী নাম হয়েছে জানো? জানি মা। আপনি একবার বলেছেন- রাজকুমার।কী সুন্দর নাম তাই না? মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে তাকে শুভ্ৰ না ডেকে রাজকুমার ডাকি।ডাকলেই পারেন।রাজকুমার অনেক বড় নাম। ডাকনাম হতে হয় তিন অক্ষরের মধ্যে।এইসব নিয়মকানুন তো মা আমি জানি না।

জাহানারা পাশ ফিরলেন। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুম এখনো আসে নি, এর মধ্যেই তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। স্বপ্নে শুভ্র এসে ঢুকেছে। তার ঘরে। তার মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ। মাথার চুলও বাউলদের মতো লম্বা। চুল দাড়ির রঙ কালো না, খয়েরি। শুভ্র বলল, মা, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বলো তো। তিনি বললেন, তোকে হনুমানের মতো দেখাচ্ছে। শুভ্র বলল, হনুমানের কি দাড়ি আছে? তিনি বললেন, আছে কি-না তা জানি না। তোকে যে হনুমানের মতো দেখাচ্ছে এটা জানি। শুভ্র বলল, মা, আমি যদি তোমার পাশে শুয়ে থাকি তাহলে কি কোনো সমস্যা আছে? তিনি বললেন, অবশ্যই সমস্যা আছে। মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে আমি কোনো হনুমানকে আমার পাশে শুতে দেব না। তুই দাড়ি গোঁফ কামিয়ে আয়, তারপর বিবেচনা করব।

শুভ্র নিষেধ সত্ত্বেও মার পাশে শুয়ে পড়ল। তিনি বললেন, বাবা, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো।শুভ্ৰ মার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার আঙুলগুলি বরফের মতো ঠাণ্ড। কী যে আরাম লাগছে। জাহানারা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।জাহানারার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার বিছানার পাশে শুভ্র বসে আছে। তার চোখ ঘুম ঘুম। যেন সে এতক্ষণ সত্যি সত্যি তার পাশেই শুয়েছিল। শুভ্র বলল, মা, তোমার কি শরীরটা খারাপ? তিনি বললেন, না।দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছ, মাইগ্রেনের ব্যথা না তো? জাহানারা পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন, মাইগ্রেনের ব্যথা হলে তুই কী করবি? শুভ্র বলল, মন্ত্র পড়ে ব্যথা কমাব। উইচক্রাফটের বই থেকে মন্ত্র শিখেছি। পড়ব মন্ত্রটা? জাহানারা মুগ্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। দিনের শেযবেলায় সব মানুষকেই সুন্দর লাগে, সেখানে শুভ্ৰকে দেবদূতের মতো লাগবে সেটাই তো স্বাভাবিক। শুধু সে যদি কালো রঙের একটা হাফ শার্ট পরত! কালো রঙে শুভ্রর গায়ের আসল রঙ ফুটে বের হতো।

শুভ্র বলল, চুপ করে আছ কেন মা? মন্ত্র পড়ব?

জাহানারা ছেলের কোলে হাত রাখতে রাখতে আদুরে গলায় বললেন, পড় দেখি তোর মন্ত্র।

শুভ্র বলল, এই মন্ত্রের জন্যে আগরবাতি জ্বালাতে হবে।

জাহানারা বললেন, আগরবাতি এখন কোথায় পাবি?

শুভ্ৰ হাসিমুখে বলল, আগরবাতি আমি সঙ্গে করে এনেছি।

জাহানারা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তার মন বলছে এই ছেলেকে তিনি পুঝতে পারেন না। এতক্ষণ ভাবছিলেন শুভ্ৰ মাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে মান খারাপ করেছে। মন্ত্র পড়ে মার মাথার ব্যথা সারাতে চাচ্ছে। এখন তার কাছে মনে হচ্ছে শুভ্রর কাছে পুরো ব্যাপারটাই খেলা। সে এক ধরনের মজা করবে বলে কাউকে দিয়ে আগরবাতি আনিয়েছে। আগরবাতি জ্বালাবার জন্যে পকেটে করে নিশ্চয়ই দিয়াশলাইও এনেছে।শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। দুটা আগরবাতির স্টিক জ্বালাল। মায়ের কপালে হাত রেখে ভারী গম্ভীর গলায় বলল,

Change this incense strong and fast

To send out the magic I shall cast.

Burn so quickly and burn so bright,

This magic incense I will light.

জাহানারার কেমন যেন লাগছে। সারা শরীরে শান্তি শান্তি ভাব। শুভ্র মন্ত্রটা সুন্দর করে পড়েছে তো।শুভ্র বলল, মা, মাথাব্যথা চলে গেছে না? জাহানারা বললেন, চলে গেছে।শুভ্র বলল, এরপর যদি কখনো মাথাব্যথা হয় দরজা-জানালা বন্ধ করবে না। আমাকে ডাকবে, মন্ত্র পড়ে মাথাব্যথা সারিয়ে দেব।জাহানারা বললেন, আচ্ছা। খবর দেব।শুভ্ৰ উঠে যাবার ভঙ্গি করতেই জাহানারা ছেলের হাত ধরে ফেললেন। আদুরে গলায় বললেন, সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত তুই এখানে বসে থাকিবি। নড়তে পারবি না।শুভ্র বলল, আচ্ছা।জাহানারা বললেন, তুই তো প্রায়ই তোর বাবার সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করিস। আমার সঙ্গে কর।শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, কোন বিষয়ে গল্প শুনতে চাও মা? জাহানার বললেন, যে-কোনো। বিষয়ে। শুধু তোর বাবার সঙ্গে যে-সব গল্প করিস সে-সব না। ফিজিক্সের কচকচানি না।স্বপ্নের গল্প বলব? স্বপ্নের আবার কী গল্প?

শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে আমি যে-সব স্বপ্ন দেখি।জাহানারা আগ্রহ নিয়ে বললেন, নিজেকে নিয়ে তুই কী স্বপ্ন দেখিস? শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে মানুষ একেক বয়সে একেক রকম স্বপ্ন দেখে— এখন আমি যে স্বপ্ন দেখি তা হলো সমুদ্রে একটা ছোট্ট দ্বীপ। গাছপালায় ঢাকা। একদিকে ঘন জঙ্গল। সমুদ্রে যে দিকে সূর্য ড়ুবে দ্বীপের সেই দিকটায় বেলাভূমি। রবিনসন ক্রুশোর মতো আমি সেই দ্বীপে একা থাকি।একা থাকিস?

হ্যাঁ একা। আমার একটা ছোট্ট ঘর আছে। ঘর ভর্তি শুধু বই। যখন ইচ্ছা হয় বই পড়ি। যখন ইচ্ছা হয় সমুদ্রে পা ড়ুবিয়ে পাথরের উপর বসে থাকি। যখন ইচ্ছা হয় জঙ্গলে হাঁটতে যাই।জাহানারা বললেন, রান্নাবান্না কে করে? রান্নাবান্নার কথাটা ভাবি নি মা। স্বপ্নের মধ্যে রান্নাবান্না, বাথরুম জাতীয় ব্যাপার আনতে নেই। এইসব হচ্ছে রিয়েলিটি। ড্রিমের সঙ্গে রিয়েলিটি মেশাতে নেই।একা একা তোর সেই দ্বীপে কতক্ষণ ভালো লাগবে?

শুভ্র বলল, বাস্তবে হয়তো ভালো লাগবে না, কিন্তু স্বপ্নে ভালো লাগবে।জাহানারা বললেন, তুই যেমন অদ্ভুত, তোর স্বপ্নগুলিও অদ্ভুত।শুভ্র বলল, প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তাদের স্বপ্নও আলাদা। আমার স্বপ্নের সঙ্গে তোমার স্বপ্ন কখনো মিলবে না। তোমার স্বপ্ন কী মা বলো তো।জাহানারা বললেন, আমার কোনো স্বপ্ন নেই।শুভ্র বলল, অবশ্যই তোমার স্বপ্ন আছে। মনে করে কোনো একদিন আমাকে বলবে।আমার স্বপ্ন জেনে তুই কী করবি? জাহানারা সঙ্গে সঙ্গেই তার নিজের স্বপ্ন কী ভাবার চেষ্টা করলেন। কোনো কিছুই মাথায় আসছে না। তাহলে কি তার কোনো স্বপ্ন নেই? তিনি একজন স্বপ্নহীন মানুষ?

মোতাহার হোসেন রাতে একবাটি সুপ এবং একটা কলা খান। থাই ক্লিয়ার সুপ চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে আসে। তাদের সঙ্গে মাসকাবারি ব্যবস্থা আছে। ডিনার তিনি শেষ করেন। ঠিক সাড়ে নটায়। ডিনারের পর আধা ঘণ্টা ছাদে হাঁটেন। দশটায় এসে বসেন ধোয়াঘরে। চিনি দুধ বিহীন এক কাপ লিকার চা এবং দিনের শেষ সিগারেটটা খান। এই সময়টা তিনি একা থাকতে ভালোবাসেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই দেখা যায় জাহানারা এসে পাশে বসেন। সাংসারিক কথাবার্তা শুরু করেন। মোতাহার হোসেন খুবই বিরক্ত হন, কিন্তু কিছু বলেন না। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন মোতাহার হোসেন ভাবেন— থাক, আজ বাদ থাক। আবার যখন এরকম ঘটনা ঘটবে তিনি বলবেন। আবারো ঘটে, কিন্তু বলা হয় না।

মোতাহার হোসেন সিগারেট ধরিয়ে প্রথম টান দেবার সঙ্গে সঙ্গেই জাহানারা এসে সামনে বসলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।কথাটা দিনে বললে কেমন হয়? কথাটা আমাকে এখনি বলতে হবে।মোতাহার হোসেন চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, বলো কী কথা? জাহানারা বললেন, তুমি আমাকে একটা দ্বীপ কিনে দেবে? মোতাহার হোসেন চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, কী কিনে দেব?

জাহানারা বললেন, দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরে ইনি মিনি অনেক দ্বীপ আছে। এরকম একটা কিনে দেবে।মোতাহার হোসেন বললেন, দ্বীপ দিয়ে কী করবে? জাহানারা বললেন, আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে কিনে দিতে বলেছি তুমি দেবে।মোতাহার হোসেন বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি এমনভাবে কথা বলছি যেন দ্বীপ কেনা শাড়ি-গয়না কেনার মতো ব্যাপার।তোমার কাছে তাই।মোতাহার হোসেন হাতের সিগারেট ফেলে দিলেন। দিনের শেষ সিগারেট আরাম করে টানতে হয়। তিনি ঠিক করলেন জাহানারা চলে যাবার প আরেকটা সিগারেট ধরাবেন।জাহানারা বললেন, হ্যাঁ না তুমি তো কিছুই বলছ না?

মোতাহার হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ আমার শরীরটা ভালো না। অফিসে প্রেসার মাপিয়েছি। ডাক্তার বলেছে প্রেসার হাই। এখন আবার মাথা ধরেছে। দ্বীপ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পরে কথা বলি? দ্বীপ নিয়ে কথা বলতে না চাইলে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে বলি? আচ্ছা বলো।শুভ্ৰকে বিয়ে দিলে কেমন হয় বলো তো। সুন্দর একটা মেয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘুরঘুর করবে। শুভ্রর বয়স চব্বিশ হয়েছে, বিয়ে তো এখন দেয়া যায়। যায় না? হ্যাঁ যায়।জাহানারা আগ্রহ নিয়ে বললেন, মনে কর ওরা দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে গল্প করছে, আমি হঠাৎ উপস্থিত হলাম। লজা পেয়ে ওরা দুজন দুদিকে সরে গেল। ইন্টারেস্টিং না?

মোতাহার হোসেন বললেন, তুমি যখন বলছি তখন নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং। আমার কাছে অবশ্যি মনে হচ্ছে না।দ্বীপে ওদের দুজনকে রেখে আমরা জাহাজ নিয়ে চলে এলাম। দ্বীপে কোনো জনমানব নেই, শুধু ওরা দুজন।মোতাহার হোসেন বললেন, আবার দ্বীপ? তোমার অন্য প্রসঙ্গে কথা বলার কথা।জাহানারা উঠে দাঁড়ালেন। তার এখন স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। শুভ্ৰর ঘরে বাতি জ্বলছে। জাহানারার মনে হলো ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলে কেমন হয়? বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হলো। বিগ ব্যাঙ্গ, স্পেস-টাইম, ব্লাক হোল সংক্রান্ত হাবিজাবি। শুভ্র এমনভাবে গল্প করে যেন সে চোখের সামনে ব্লাক হোল দেখতে পাচ্ছে। সায়েন্সের হাবিজাবি গল্পের মাঝখানে বিয়ের প্রসঙ্গ তোলা যেতে পারে। কী ধরনের মেয়ে শুভ্রর পছন্দ সেটা জানা দরকার।

শুভ্র কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। জাহানারা যে ঘরে ঢুকেছেন, শুভ্র বুঝতে পারছে না। তার সমস্ত মনোযোগ কম্পিউটারের পর্দার দিকে। হালকা সবুজ রঙের আলো শুভ্রর মুখে পড়েছে। তাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। জাহানারা ছেলের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন।এই শুভ্ৰ!শুভ্ৰ মার দিকে তাকিয়ে হাসল। জাহানারা সবসময় লক্ষ করেছেন— শুভ্ৰকে ডাকলে সে প্রথম যে কাজটা করে তা হলো ঠোঁট টিপে হাসে। শুধু তার সঙ্গেই হাসে, না। সবার সঙ্গে হাসে— এটা তিনি জানেন না।কম্পিউটারটা বন্ধ করবি?

শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে অফ বাটন টিপে দিল। শুভ্রর মুখের উপর থেকে হালকা সবুজ আলোটা চলে গেছে। এখন জাহানারার মনে হলো কম্পিউটারটা অন থাকলেই ভালো হতো।শুভ্র বলল, মা বোস।জাহানারা বসতে বসতে বললেন, শুভ্ৰ, তুই বিয়ে করবি? শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ করব।জাহানারার মনে হলো অন্য যে-কোনো ছেলে হলে এই প্রশ্নের উত্তরে লজ্জা পেত। জবাব দিত না। শুভ্ৰ অন্যদের মতো না।জাহানারা আদুরে গলায় বললেন, তোর কীরকম মেয়ে পছন্দ?

শুভ্র বলল, লিসনার-টাইপ মেয়ে।জাহানারা বললেন, লিসনার-টাইপ মানে কী? শুভ্র বলল, কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা খুব মন দিয়ে কথা শুনে। এদের বলে লিসনার। ওদের সঙ্গে গল্প করে খুব আরাম।জাহানারা বললেন, আমি কি লিসনার? শুভ্র বলল, না, তুমি লিসনার না।আমার সঙ্গে গল্প করে আরাম নেই? না।তোর বাবা কি লিসনার?

উঁহু। বাবা খুব মন দিয়ে কথা শুনেন। এরকম ভাবি করেন। কিন্তু আসলে শুনেন না। তিনি তখন অন্য কিছু ভাবেন।জাহানারা বললেন, এই বাড়িতে লিসনার-টাইপ কেউ আছে? শুভ্র বলল, সকিনা মেয়েটা লিসনার।জাহানারা হতভম্ব হয়ে বললেন, একটা কাজের মেয়ে হয়ে গেল লিসনার? তাকে তো কথা শুনতেই হবে। সে তো মুখের উপর হড়বড় করে কথা বলবে না।শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন মা?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *