আমি উঠে বসলাম। নানিজান আমার পেছনে বালিশ দিয়ে দিলেন। তারপর শুরু করলেন হাসির এক গল্প। গল্প বলবেন কী, নিজেই হাসতে হাসতে বাঁচেন না। এক লাইন বলেন, বলেই হাসেন। আরো এক লাইন বলেন, আবারো হাসি। এমন হাসাহাসি শুরু হলো যে, কে বলবে এ বাড়িতে কোনো অসুখ-বিসুখ আছে! আমি অনেকদিন পর মাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলাম। আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম, একটু পর পর মা এসে নিজানকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন। কখনো হাত ধরে বসে থাকেন, কখনো গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসেন।
একসময় নানিজান ধমকের মতো করে বললেন, তুই তো বড় যন্ত্রণা করছিস! শুধু গায়ের সঙ্গে গা ঘসাচ্ছিস। এমনিতেই গরমে মরে যাচ্ছি।সামান্য কথা। এতেও আবার সবাই হাসতে শুরু করল। নিজান একটা হাসির বড় ঝাড়বাতি জ্বেলে চলে গেলেন। তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকতেন, কিন্তু তাকে যেতেই হবে, কারণ নানাভাই বাসায়। তিনি না গেলে নানাভাই ভাত খাবেন না। রাগ করে বসে থাকবেন। নানাভাই আবার নানিজান পাশে না থাকলে ভাত খেতে পারেন না।
বিকেলে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ক্লাসের মেয়েরা এলো। তাদের নিয়ে এলেন আমাদের অঙ্ক-মিস-শাহেদা আপা। স্কুলে আমাদের এই অঙ্ক-মিসের নাম হলো শুকনা বাঘিনী’। আমাদের স্কুলে দুজন বাঘিনী আছেন। একজন হলেন থলথলা বাঘিনী, অন্যজন শুকনা বাঘিনী। আমরা সবচে’ বেশি ভয় পাই শুকনা বাঘিনীকে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে দেখলে আমাদের পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তিনি যে আমার জন্মদিনে চলে আসবেন আমি চিন্তাও করি নি। তাকে দেখে আগের অভ্যাস মতো ভয়ে আমার পানির পিপাসা পেয়ে গেল। তিনি আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বললেন, মা রে, তোর এই অবস্থা কেন হলো?
বলেই কাঁদতে শুরু করলেন। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যেরকম শব্দ করে কাঁদে সেরকম শব্দ করে কান্না। তারপর তিনি ছুটে বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দা থেকে তার কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল।বাইরে থেকে দেখে একটা মানুষ কেমন তা বোঝা আসলে খুব কঠিন। আমাদের শুকনা বাঘিনী আপা আসলেই বাঘিনী। দয়া-মায়ার ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই। আদর করে কাউকে তিনি কোনো কথা বলেছেন বলে কেউ শুনে নি। পরীক্ষার হলে নকল করে কোনো মেয়ে ধরা পড়লে অবশ্যই তিনি তাকে এক্সপেল করে দেবেন। কেঁদে চোখ গালিয়ে ফেললেও কোনো লাভ হবে না। তবে কারো অসুখ-বিসুখ হলে অন্যকথা। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন মনিকা একদিন ক্লাসে এলো জ্বর নিয়ে। বাঘিনী আপা অঙ্ক পড়াতে এসে টের পেলেন। কঠিন গলায় বললেন, কী রে, তোর চোখ লাল কেন? জ্বর-জারি নাকি?
মনিকা ভয়ে নীল হয়ে বলল, জি-না আপা।দেখি কাছে আয়।মনিকা কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল। আপা কপালে হাত দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে। উঠলেন, গায়ে তো ভালো জ্বর। জ্বর নিয়ে এসেছিস কেন? বিদ্যা ধুয়ে খাবি? যা, টিচার্স কমনরুমে বেঞ্চ আছে, ওখানে গিয়ে শুয়ে থাক। আমি ক্লাস শেষ করে আসছি।টিফিন পিরিয়ডে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম মনিকা বেঞ্চে শুয়ে আছে আর বাঘিনী আপা তার মাথা টিপে দিচ্ছেন। কত বিচিত্র ধরনের মানুষ যে পৃথিবীতে আছে! আশ্চর্য! একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের চেয়ে এত আলাদ সব মানুষ একরকম হলে কেমন হতো কে জানে। যখন কারো জ্বর হবে, সবার একসঙ্গে হবে। কারো আনন্দের কিছু ঘটলে সবারই ঘটবে।
এইসব বিচিত্র কথা আজকাল আমার প্রায়ই মনে হয়। আমি বাবাকে দেখাবার জন্যে মোটা একটা খাতায় লিখে রাখি। আমি জানি বাবা সেই খাতা দেখে খুব হাসাহাসি করবে। তবে হাসাহাসি করলেও বাবার কাছে খুব ভালো লাগবে। তবে মা ভুরু কুঁচকে বলবে– পাগলের মতো এইসব কী লিখেছিস? খাতাটা আমি কাউকে দেখাব কি-না তা এখনো ঠিক করি নি। মনে হয় শেষপর্যন্ত দেখাব না। খাতাটাতে এমন অনেক কিছু লেখা আছে যা পড়লে মা মন খারাপ করবে। আমি বেঁচে থাকলে অবশ্যি মন খারাপ করবে না। আমি বেচে থাকব না এইজন্যেই মন খারাপ করবে। যেমন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। সে যদি বেঁচে থাকত তাহলে কি তার ডায়েরির এত নাম-ধাম হতো?
আমার মনে হয় না। বেচারি নাজিদের হাতে শেষপর্যন্ত মারা গেছে বলেই তার ডায়েরি পড়ার সময় আমাদের এত খারাপ লাগে।ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর উপহার হিসেবে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিটা আমি পেয়েছিলাম। মেজোখালা দিয়েছিলেন। আমার বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে আমাদের বাসায় ছোটখাটো একটা পার্টির মতো হলো। সবাই আমার জন্যে নানান উপহার-টুপহার নিয়ে এলেন। ছোটখালা আনলেন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। র্যাপিং পেপারে খুব সুন্দর করে মুড়ে, মোড়কের উপর কাগজের ফুল লাগিয়ে উপহারটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি আর তোর মেজোখালু তোর উপহার কেনার জন্যে নিউমার্কেট চষে ফেলেছি।
কিছুই পছন্দ হয় না। শেষে এই বইটা পেলাম। মনে হচ্ছে তোর ভালো লাগবে। অসাধারণ একটা মেয়ের অসাধারণ কাহিনী।আমার মেজোখালা এবং খালু দুজনই খুব কৃপণ ধরনের মানুষ। নিজেদের জন্যে তারা প্রচুর খরচ করবেন। ঐ তো কিছুদিন আগে আরেকটা গাড়ি কিনলেন। কিন্তু অন্যের জন্যে একটা পয়সাও তাঁরা খরচ করবেন না। সেই মেজোখালা উপহার এনেছেন? আমার খুব ভালো লাগল।মোড়ক খুলে বই বের করে আমি খুব খুশি। হঠাৎ দেখি বইয়ের ভেতরের পাতার এক কোনায় লেখা- পাপিয়া রহমান, ক্লাস নাইন, সেকশান বি। পাপিয়া মেজোখালার মেয়ে। এখন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছে। আমি তখন বোকার মতো একটা কাজ করে ফেললাম।
আমি বললাম, খালা, এটা তো পাপিয়া আপার বই। তার নাম লেখা। তখন একটা বিশ্রী অবস্থা হলো। মেজোখালা চোখ-মুখ লাল করে বলতে লাগলেন, বইটা তিনি আমার জন্যেই কিনেছেন। পাপিয়া এক ফাঁকে নিজের নাম লিখে ফেলেছে।আমার বড়খালু মানুষকে লজ্জা দিয়ে খুব আনন্দ পান। তিনি আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, পাপিয়া আম্মুর তো খুব বুদ্ধি। শুধু যে নিজের নামই লিখেছে তা না, আবার ব্যাক ডেট দিয়েছে। তিন মাস আগের তারিখ লেখা। হা হা হা।মেজোখালা বললেন, দুলাভাই, আপনার কি ধারণা নাতাশার জন্যে নতুন একটা বই কেনার সামর্থ্যও আমার নেই?
বড়খালু বললেন, আমি কি বলেছি বই কেনার সামর্থ্য তোমার নেই? অবশ্যই আছে। আমি শুধু ব্যাকডেটের কথা বললাম। তোমার মেয়ের বুদ্ধির তারিফ করলাম। আমার ধারণা, পাপিয়া বড় হলে তোমার চেয়েও ইন্টেলিজেন্ট হবে। অবশ্যই সে তোমাকে ছাড়িয়ে যাবে।মেজোখালা কাঁদতে শুরু করলেন। কিছু না খেয়েই আমাদের বাসা থেকে চলে গেলেন। আমার কী যে খারাপ লাগল। আমি নিজেও বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমি কেন বোকার মতো এই কাজটা করলাম? কেন খালাকে এমন লজ্জা দিলাম? আমাদের বাংলা মিস, মিস রোকেয়া একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, গুরু নানকের একটা কথা আছে— তোমরা সবাই কথাটা খাতায় লিখে ফেল।
কথাটা হচ্ছে– ‘দু গুণা দত্তার চৌগুণা জুজার।’ কথাটার মানে হচ্ছে দু গুণ দিলে চার গুণ ফেরত পাওয়া যায়। তুমি যদি কাউকে দু গুণ আনন্দ দাও তাহলে চার গুণ আনন্দ ফেরত পাবে। আবার কাউকে দু গুণ কষ্ট দিলে চার গুণ কষ্ট ফেরত পাবে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি কথাটা সত্যি। তোমরাও পরীক্ষা করে দেখো।আমাদের ক্লাসের মলিনা গোমেজ খুব বোকা। আমার ধারণা, খৃস্টানরা বুদ্ধিমান হয়। মলিনা খৃস্টান হলেও দারুণ বোকা। সব ক্লাসেই সে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করবে। মলিনা রোকেয়া আপাকে বলল, মিস, আপনি যদি আমাকে মারেন তাহলে কেউ কি আপনাকে ডাবল করে মারবে?
রোকেয়া আপা কখনো কারো কথায় রাগ করেন না। মলিনার কথা শুনে তার ভুরু কুঁচকে গেল, তবে তিনি রাগ করলেন না। শুধু বললেন, হ্যাঁ।মলিনা বলল, এইজন্যেই কি আপনি আমাদের মারেন না? ক্লাসের সবাই হাসতে লাগল। মিস রোকেয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি স্পষ্ট বুঝলাম আপার মন খারাপ হয়েছে। গুরু নানকের চমৎকার একটা কথা তিনি বলেছেন। অথচ কথাটার গুরুত্ব কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই হাসাহাসি করছে।সেই দিনই গুরু নানকের কথাগুলি আমি আমার ডায়েরিতে লিখে ফেললাম এবং ঠিক করলাম কথাগুলি সত্যি কি-না আমি পরীক্ষা করে দেখব।
কারো মনে কষ্ট দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডায়েরিতে দিন-তারিখ দিয়ে লিখে ফেলব। তারপর মিলিয়ে দেখব আমি ডাবল কষ্ট পাই কি-না।মেজোখালাকে লজ্জা দেয়ার ব্যাপারটা আমি খুব গুছিয়ে লিখলাম। কতদিন পরে আমি ডাবল লজ্জা পাই সেটা দেখার জন্যে। লেখার ছদিনের দিন আমি লজ্জা পেলাম। সে যে কী ভয়ঙ্কর লজ্জা! কাউকে সে লজ্জার কথা কোনোদিন বলা যাবে না। ডায়েরিতেও লিখে রাখা যাবে না। গুরু নানকের কথা এত সত্যি! আমি এখন থেকে ঠিক করেছি কাউকে কখনো কষ্ট দেব না, লজ্জা দেব না। এমন কিছু করব যাতে মানুষ খুশি হয়। তারা খুশি হলে কোনো না কোনো ভাবে আমি ডবল খুশি হব।
আমার জন্যে মানুষকে খুশি করা বেশ কঠিন। কারো সঙ্গে আমার দেখাই হয় না। আমার বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন আমি ঘরেই বসে থাকি। বই পড়ি কিংবা ডায়েরি লিখি। গল্পগুজব যা করার ফুলির মা’র সঙ্গে করি। সে কিছুতেই খুশি হয় না। তাকে খুশি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার গল্প শোনা। ফুলির মা সাধারণ কোনো গল্প জানে না। তার সব গল্পই ভয়ঙ্কর। শুনলে হাত-পা কাঁপে। অথচ সে এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে যেন ঠাকুমার ঝুলি থেকে লালকমল নীলকমলের গল্প বলছে।বুঝছেন আফা, আমি তখন নয়া বাসার কামে ঢুকছি। আমার গেরাম সম্পর্কে চাচা আমারে নারায়ণগঞ্জের এক ফেলেটে কামে ভর্তি করছে। বাসার সাব ব্যাংকের অবিছার।
পাঁচটা ডাংগর পুলাপান। পরথম দিন কাম করতে করতে জেবন শেষ। তিন বালতি কাপড় ধুইছি। ঘর মুছছি, দুনিয়ার বেবাক পাতিল মাজছি। রাইত একটার সময় চুলা বন কইরা ঘুমাইতে গেছি। ঘুমানির জইন্যে একটা পাতলা চাঁদর দিছে, আর দিছে একটা বালিশ। কী যে গরম ছিল আফা! গরমে শইল সিদ্ধ হইতাছে। গরমের সাথে সামিল হইছে মশা। হায় রে আষা কী কমু, ভোমরার লাহান বড় বড় মশা। আমার চউক্ষে নাই নিদ্রা। এই গোন দেই, হেই গড়ান দেই– মশা খেদাই। শেষ রাইতে চউখ একটু বন হইছে, হঠাৎ মনে হইল শাড়ি ধইরা কে জানি টানে। ইয়া মাবুদ! ধড়ফর কইরা উইঠা দেখি বাড়ির সাব। চিক্কর দিতে গেছি, ধরছে মুখ চাইপ্যা। এর মইধ্যে শাড়ি খুইল্যা লেংটা বানাইয়া ফেলছে…।
চুপ কর ফুলির মা। আমি আর শুনব না।না শুননই ভালো। তুমি পুলাপান মানুষ। এই গুলান পুলাপানের গফ না।পুলাপানের গল্প না হলেও ফুলির মা’র সব গল্পই আমাকে শুনতে হয়েছে। হয়তো গল্পের বই পড়ছি মা অফিসে, বাবা গেছেন কাজে। ফুলির মা তার কাজ শেষ করে এসে বসবে আমার কাছে। তার হাতের মুঠোয় লুকানো জ্বলন্ত সিগারেট। ফুলির মা আমার সামনে সিগারেট খেলেও খুব সমীহ করে খায়। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে টান দেয়।কী করেন গো আফা?
কিছু করি না।মজার একটা ইতিহাস স্মরণে পাইছি। বড়ই ইন্টারেস্টের ইতিহাস। ভাত রানতে রানতে স্মরণ হইছে। একলা একলা হাসছি। ভাবলাম আফারে বলি। হইছে কী আফা– এক বড়লোকের বাড়িত কাম পাইছি। বাড়ির বেগম সাব পরীর লাহান সুন্দর। বেগম সাবের কাছে গাইয়ের দুধ আনলে দুধরে কালা লাগে। এমন শইলের রঙ। আর আমারে দেহেন আফা গাছের পেত্নি। তয় শইলটা ভালো। তা আফা খাটাখাটনির শইল ভালো তো হইবই! আমরার সম্বল হইল শইল,..।
এই গল্প শুনব না।আচ্ছা থাউক, শুননের দরকার নাই। এইটা পুলাপানের গফ না।তারপরেও ফুলির মা বুয়ার অনেক গল্প আমি শুনেছি। তার কয়েকটা আমি ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। মা পড়লে ফুলির মা’র উপর রাগ করবে। খুব রাগ করবে। তবে আমি নিজে থেকে পড়তে না দিলে মা আমার ডায়েরি পড়বে না। এইসব ব্যাপারে মা খুব সাবধান। অবশ্যি আমার মৃত্যুর পর মা সব পড়বে। পড়বে আর কাদবে। সবচে বেশি কাঁদবেন বাবা। কারণ মেয়েরা অনেক শক্ত ধরনের হয়। ছেলেরা তা হয় না। বাইরে থেকে তাদের শক্ত মনে হলেও আসলে তারা তা না। ছোট মামার মৃত্যুর শোক নানিজান সামলে উঠেছেন। নানাভাই সামলাতে পারেন নি।
বাবার বেলাতেও তাই হবে। কাজেই আমাকে এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যেন আমার মৃত্যুর পর কেউ আমার ডায়েরি পড়তে না পারে। ঘরে যেন আমার কোনো ছবিও না থাকে। ছবি থাকলেই আমার কথা সবার মনে পড়বে। ছবি দেখে দেখে কাদবে। হয়তো আমার আরেকটা ভাই হবে। কিংবা বোন হবে। ঈদের দিন ওরা কত আনন্দ করতে চাইবে। তখন মার মনে পড়ে যাবে আমার কথা। মা সব ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে বসবে। আমার বেচারা ভাইবোনরা মন খারাপ করে ঘুরবে।
বোনটা হয়তো দুই ধরনের হবে। পড়াশোনা করতে চাইবে না, শুধু খেলতে। চাইবে। তখন মা বলবেন, তুমি এত দুষ্ট হয়েছ কেন? তোমার যে আপা ছিল নাতাশা, সে তত দুষ্ট ছিল না। সে তো দিন-রাত পড়াশোনা করত। অসম্ভব লক্ষ্মী ছিল সে। আমার বোনটা তখন কত মন খারাপ করবে! হয়তো মনে মনে রাগ করবে আমার উপর। আমি চাই না সে আমার উপর রাগ করুক। আমি চাই না কেউ আমার উপর রাগ করুক। কেউ আমার কথা মনে করে কাঁদুক।
আমি চাই আমার মৃত্যুর পর বাবা-মা একসঙ্গে থাকবে। তারা কোনোদিন কোনো ঝগড়া-টগড়া করবে না। বাবা রাত-বিরেতে নেশা করে বাসায় ফিরবে না। বাবা আবার আগের মতো লাল টুকটুক একটা গাড়ি কিনবে। মাকে পাশে বসিয়ে শাঁ শাঁ করে সেই গাড়ি নিয়ে চলে যাবে চিটাগাং, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার। পেছনের সিটে আমার ছোট দুই ভাইবোন বসবে, তারা খুব হৈচৈ করবে। চিষ্কার করবে। গান করবে। তারা যতই হৈচৈ করবে বাবা ততই হাসবেন। মা বিরক্ত হয়ে বলবেন, আহ্, চুপ কর তো। তখন বাবা মাকে খ্যাপাবার জন্যে তার বিখ্যাত চাইনিজ গান ধরবেন।
টিং টিং টিটিং টিং
রেবা রেবা লিং লিং
আমার এইসব গোপন ইচ্ছার কথাও আমি আমার ডায়েরিতে লিখি। আগে খুব হেলাফেলা করে ডায়েরি লিখতাম। আসলে জানতাম না তো কী করে ডায়েরি লিখতে হয়। একদিন লিখলাম–
আজ লবণের বাটিতে একটা মরা তেলাপোকা পাওয়া গেল। মা ফুলির মাকে খুব বকা দিলেন। ফুলির মা বলল, আমি কি তেল্যাচুরারে কইছিলাম লবণের বাটিত গিয়া মরতে? আমারে বকেন ক্যান? ফুলির মা’র কথা শুনে মা খুব রেগে গেল। মা বললেন, তোমাকে দিয়ে আমার পুষাবে না। তুমি অন্য কোথাও কাজ দেখ। ফুলির মা বলল, জে আইচ্ছা। যে কাম জানে তার কামের অভাব হয় না। ফুলির মাকে চলে যেতে বললে সে সবসময় বলবে– জে আচ্ছা। কিন্তু কখনো যাবে না।
আরেকদিন লিখলাম–
আজ পটল দিয়ে মাছ রান্না করা হয়েছে। বোয়াল মাছ আর পটল। বাবা বললেন, বোয়াল নিম্নশ্রেণীর মাছ। পটল উচ্চ শ্রেণীর তরকারি। পটল দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। এতে তরকারি হিসেবে পটলকে অপমান করা হয়েছে। এই নিয়ে মা এবং বাবার মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া বেঁধে গেল।