কালো পাথর – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কালো পাথর – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

প্রেতাত্মা নিয়ে আসর বসানো অরুণেন্দুর হবি। এই আসরে মৃত মানুষের আত্মার আবির্ভাব হয় কোনো জীবিত মানুষের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় মিডিয়াম। অরুণেন্দু নিজে কিন্তু মিডিয়াম নয়, নিছক উদ্যোক্তা। মিডিয়াম সবাই হতে পারে না। অরুণেন্দুর মতে সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ের অধিকারী এবং খুব অনুভূতিপ্রবণ মানুষই মিডিয়াম হবার যোগ্য। পুরুষের তুলনায় এ ক্ষমতাটি মেয়েদের বেশি।তাই মেয়েদের মধ্যেই সে মিডিয়াম খোঁজে। পেয়েও যায়। অশরীরী আত্মা আনতে দেরি করে না। অরুণেন্দু দাবি করে, শতকরা নব্বইটি আসরে তার সাফল্যের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই আসরকে ইংরেজীতে বলা হয় Seance-এর আসর। ..

আসর যখন তখন যেখানে বসানো যায় না। পরিবেশ নির্জন এবং স্তব্ধ হওয়া চাই। আসরের লোকগুলোরও বিশ্বাস থাকা চাই দেহাতীত সত্তায়। তবে আত্মার আবির্ভাবের গ্যারান্টি দিতে অরুণেন্দু রাজি, যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাতে কোনো নিরিবিলি বাড়িতে আসর বসানো যায়।

সেদিন এই রকম একটা অবস্থা দেখা দিয়েছিল চব্বিশে অক্টোবর রাত দশটায়, বঙ্গ-বিহার সীমান্তে খনি এলাকায় বারাহিয়া টাউনশিপে, ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের বাড়িতে। ডঃ রায় খনি ও ধাতুবিশেষজ্ঞ সরকারি অফিসার। অরুণেন্দু সম্পর্কে তার ভাগ্নে। যখনই বেড়াতে আসে, প্রেততত্ব নিয়ে বকবক করে সারাক্ষণ।

রাতের খাওয়ার পর বাইরের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন ডঃ রায়, তার স্ত্রী মীনাক্ষী, একমাত্র সন্তান মঞ্জুশ্রী, তার হবু বর সুমন আর অরুণেন্দু। সেই সময় হঠাৎ বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তার মধ্যে লনের ওধারে গেট খুলে দৌড়ে এল দুটি মেয়ে, অনুরাধা আর ভাবনা দুই বন্ধু। মঞ্জুশ্রীরও বন্ধু। বেড়াতে বেরিয়ে আচমকা প্রকৃতির তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিতে এল।

ভাবনা গুজরাটি মেয়ে। তার বাবা কেশবলাল শান্তপ্রসাদ স্থানীয় ব্যবসায়ী। ভাবনার জন্ম বারাহিয়ায়। তাই সে বাংলাও বলে মাতৃভাষার মতো।বৃষ্টির ছাঁট এসে সবাইকে বিব্রত করছিল। তাই ডাইনিং-কাম-ড্রয়িংরুমে যাওয়া হল। অনুরাধা ও ভাবনা যে-যার বাড়িতে ফোনে জানিয়ে দিল মঞ্জুশ্রীদের বাড়িতে আটকে পড়েছে। চিন্তার কারণ নেই। ডঃ রায় গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন তাদের।

কফির আসর বসল এবার। অরুণেন্দু কিছুক্ষণ আগে সিয়াস (Seance) নিয়ে আলোচনা করছিল। ডঃ রায় ওসব বিশ্বাস করেন না। কিন্তু মা ও মেয়ে করে। তারা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। সুমন হা বা না কিছুই বলছিল না। সে বরাবর মধ্যপন্থী সব ব্যাপারে। কফির আসরে আরও দুজনকে পেয়ে অরুণেন্দু আগের কথাটার জের টেনে আনল। অনুরাধা ও ভাবনার চোখে ফুটে উঠল চাপা ভয় ও বিস্ময়। বাইরে ঝড় বৃষ্টি, মেঘের গর্জন যেন অশরীরী আত্মারা আত্মপ্রকাশের জন্য অস্থির হয়ে, জীবিত মানুষের আনাচেকানাচে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মঞ্জুশ্রী বলল, তাহলে অরুদা, এই তো তোমার মতে উপযুক্ত সময়।তার মা মীনাক্ষী হাসতে হাসতে বললেন, খুব হয়েছে, আত্মাটাত্মা ডেকে, এখন কাজ নেই। মুখেই বলল অরু, শুনতে বেশ লাগছে।ভাবনা একটু হাসল হঠাৎ। না মাসিমা। আমরা পরীক্ষা করে দেখি না, যদি সত্যি আত্মা আসে।ডঃ রায় হাই তুলে বললেন, ও কে! তোমরা আজ্ঞা দাও। আমি একটু পড়াশোনায় বসি এবার। অনু, ভাবনা-চিন্তা কোরো না। পৌঁছে দেবখন, যত রাতই হোক।

তার পেছন-পেছন মীনাক্ষীও চলে গেলেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর আড্ডা দেওয়া শোভন নয়। ওরা হয়তো মন খুলে কথা বলতে পারছে না। বিশেষ করে। সুমন ও মঞ্জুশ্রীর কথা ভেবেই উঠে গেলেন মীনাক্ষী।সুমন চোখ নাচিয়ে বলল, কী অরুদা, হবে নাকি? অরুণেন্দু পা বাড়িয়েই ছিল। অনুরাধার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার আপত্তি নেই তো?

অনুরাধা আস্তে মাথাটা দোলাল।অরুণেন্দু তার দিকে তাকিয়েই রইল মিনিট-খানেক। তারপর রহস্যময় হেসে বলল, আমার বিশ্বাস, মিডিয়াম, হবার যোগ্যতা এখানে একমাত্র আপনারই আছে।ভাবনা বলল, কি করে বুঝলেন বলুন তো? অরুণেন্দু বলল, ওটা আমার ইনটুইশান বলতে পারেন। দশবছর ধরে এসব নিয়ে আছি। দেখামাত্র বুঝতে পারি কে ভাল মিডিয়াম হতে পারে। অনুরাধা প্লিজ আপত্তি করবেন না কিন্তু।

অনুরাধা মৃদুস্বরে বলল, আমাকে কী করতে হবে? অরুণেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বল্ল, ডাইনিং টেবিলে চলুন সবাই বলছি। আর মঞ্জু একটা হাল্কা পেন্সিল আর একটা কাগজ চাই। ঝটপট! সময় চলে যাচ্ছে। আর একটা মোম চাই।সঙ্গে সঙ্গে জোগাড় হয়ে গেল। কিচেন বন্ধ করে ফেলু ঠাকুর আর পরিচারিকা সুশীলাকে নিজেদের ঘরে পাঠানো হল। দরজা ও জানালাগুলো বন্ধ করে, অরুণেন্দু মোমবাতি জ্বেলে টেবিলে রাখল।

বাইরের প্রাকৃতিক আলোড়ন খুব চাপা শোনাচ্ছিল এবার।ফ্যান বন্ধ করলে ঘরের ভেতরটা গুমোট হয়ে উঠল। কিন্তু উপায় নেই।সে অনুরাধাকে টেবিলের একদিকে একা বসাল। অন্যদিকে পাশাপাশি বসল সুমন, ভাবনা, মঞ্জুশ্রী আর সে। অনুরাধার হাতে পেন্সিল ও কাগজটা দিয়ে সে বলল, পেন্সিলটা কাগজের ওপর আলতো ভাবে রাখুন। তারপর কী করতে হবে বলছি।

অরুণেন্দু খুব চাপা গলায় বলতে থাকল, এবার আমরা সবাই মিলে এমন একজন মৃত মানুষের কথা, চিন্তা করব, যাকে আমরা প্রত্যেকে চিনি। চিনি মানে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও পরোক্ষ ভাবে চিনি। অর্থাৎ জানি। যেমন রবীন্দ্রনাথ। আমি টেবিলে সংকেত করব। সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনোযোগে রবীন্দ্রনাথের কথা চিন্তা করতে হবে। অনুরাধা আমাদের আসরের মিডিয়াম। রবীন্দ্রনাথের আত্মা তার মধ্যে আসবেন। অনুরাধা, প্লিজ বি ভেরি কেয়ারফুল।

তিনি এলে আপনার পেন্সিল কেঁপে উঠবে কিংবা অন্য কোনো ভবে টের প্রানে সেটা। আপনার আঙুল যদি লিখতে চায় জোর করে বাধা দেবেন না কিন্তু। এটা একটা সিরিয়াস এবং কঠিন ব্যাপার-মানে, আপনার সচেতন মন অন্যের অনুভূতি-চিন্তা কাজকে বাধা দিতে চাইবে। আপনি নিষ্ক্রিয় থাকার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন, আপনার এই মানসিক অবস্থার ওপর আসরের সাফল্য নির্ভর করছে। কেমন? অনুরাধা তাকিয়ে রইল নিষ্পলক চোখে।

মোমের আলোয় তাকে যেন দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল অন্যদের। সুমনের ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসি ছিল এতক্ষণ। সেটা মিলিয়ে গেল। ভাবনাও গম্ভীর হয়ে পড়ল। মঞ্জুশ্রীর মুখে ভয় ও বিস্ময় ছিল। তাকেও এবার শান্ত দেখাল।— অরুণেন্দু বলল, রেডি। আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতীক্ষা করছি। বলে সে টেবিলে আঙুলের শব্দ করল।

বাইরে মেঘ ডাকল সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা কেঁপে উঠল। মোমের শিখা স্থির জ্বলছে। ঘরে স্তব্ধতা ও ভ্যাপসা গরম। আবছা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ক্রমশ শোনা যেতে থাকল। দুমিনিট পরে দেখা গেল অনুরাধার হাতের পেন্সিল কঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে কাগজের ওপর কিছু লেখা হল।পেন্সিল থামলে অরুণেন্দু আস্তে কাগজ আর পেন্সিলটা অনুরাধাকে না ছুঁয়ে তুলে নিল। কিছু লেখা নেই। আঁকাবাঁকা একটা রেখা মাত্র।

অরুণেন্দু লিখল : আপনি কে? তারপর কাগজটা আস্তে এগিয়ে পেন্সিলটা অনুরাধার হাতে গুঁজে দিল। অনুরাধার হাত তেমনি পেন্সিল ধরার ভঙ্গিতে টেবিলে রাখা আছে।আবার পেন্সিলটা কাঁপল। তারপর লেখা হতে থাকল। পেন্সিল থামলে অরুণেন্দু কাগজ ও পেন্সিলটা তেমনি আস্তে তুলে নিল। লেখা হয়েছে : আমি সুদীপ্ত।

অরুণেন্দু লেখাটা নিঃশব্দে দেখাল অন্যদের। অনুরাধা ছাড়া সবারই মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের কথা ভেবেছিল সবাই। সুদীপ্ত এসে গেল! এর পর অরুণেন্দুর প্রশ্ন এবং অনুরাধার জবাব লেখা হতে থাকল পালাক্রমে।

তা হল এই : …… আপনাকে আমরা ডাকিনি।……… আমার কথা আছে।……. বলুন।……. থাক। আমি যাই।……. কেন?…….. পিট নং ৩৪৭ ……. তার মানে?……… কালো পাথর।………. কিছু বুঝলাম না।…….. মোহান্তজী।…….. এসব কী বলছেন?…….. যাচ্ছি।

অনুরাধার আঙুল থেকে কাগজ-কলম টেনে নিতে হাত বাড়াল অরুণেন্দু, সেই সময় হঠাৎ টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অনুরাধা। ভাবনা আতঙ্কে অস্ফুট চীৎকার করে উঠল। অরুণেন্দু ডাকল, অনুরাধা! অনুরাধা! অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে গেছে। সবাই উঠে দাঁড়াল। সুমন ঝটপট সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। মঞ্জুশ্রী কিচেন থেকে জল নিয়ে এল গ্লাসে।

অরুণেন্দু অনুরাধার মুখে জল ছিটিয়ে দিল। ভাবনা তাকে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে।তারপর অনুরাধা চোখ খুলল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।গণ্ডগোল শুনে ডঃ রায় এবং মীনাক্ষীদেবী পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন। অরুণেন্দুকে একটু বকাবকি করলেন। ভাবনা বলল, অনু, তোমরা কি হয়েছিল? অনুরাধা আস্তে বলল, জানি না। হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল।

সুমন জানালাগুলো খুলে দিলে ঘরের ভেতরকার গুমোটভাবটা চলে গেল। বাইরে ঝড়ের প্রকোপ লেগেছে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সমানে। অরুণেন্দু কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে অদ্ভুত হাসি। সে বলল, সিয়াসের আসরে অনেক সময় এমন হয়েই থাকে অবশ্য। মিডিয়াম নিজেও ভয় পেয়ে যায়। তার একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও আমি দিতে পারি।

তবে ডঃ রায় কপট ধমক দিয়ে বললেন, থাক। তারপর হো হো করে হাসলেন। কবে অশরীরী এসে তোমারই ঘাড় মটকাবে দেখবে।মীনাক্ষী বললেন, মনু, সুস্থবোধ করছ তো? অনুরাধা একটু হাসল। আমি ঠিক আছি, মাসিমা।বাইরের বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখে এসে ডঃ রায় বললেন, এখন বেরুনো যায়। অনু ভাবনা, এস–গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করি।

ভাবনা বলল, এক মিনিট। মেসোমশাই, সিয়াসের আসরে কে এসেছিল জানেন? সুদীপ্ত।ডঃ রায় চমকে উঠলেন। সুদীপ্ত! ধাতু গবেষণা কেন্দ্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ অফিসার ছিল সুদীপ্ত। কিছুদিন আগে সে খুন হয়ে গেছে। তাই সকলের অবাক হবারই কথা।ডঃ রায় অরুণেন্দুর হাত থেকে কাগজটা নিলেন। অরুণেন্দু কাগজটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কাগজটা নিয়ে চোখ বুলোতে ডঃ রায়ের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল।

পড়া শেষ হলে গম্ভীর মুখে বললেন, এটা আমার কাছে থাক, অরু! ভাবনা এস। অনু তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।সুমন বলল, আমি ওদের পৌঁছে দিতে পারতাম। বৃষ্টির মধ্যে আপনি কষ্ট করে– ডঃ রায় বললেন, তুমি তো উল্টোদিকে যাবে। তাছাড়া রাত হয়ে গেছে। অতখানি পথ তোমাকে ফিরতে হবে।ডঃ রায় বেরিয়ে গেলেন। তাদের বিদায় দিতে গেল মঞ্জুশ্রী আর তার মা। মা ও মেয়ের মুখে আতঙ্ক ও উদ্বেগের ছাপ লেগে রয়েছে।

অরুণেন্দু গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমন একটু হেসে বলল, কী অরুদা? কী ভাবছ? অরুণেন্দু হাসল। চাপা গলায় বলল, ব্যাপারটা আমার নিজেরই খটকা লাগছে।কেন বলো তো? আমার অভিজ্ঞতায় কখনও সিয়াসের আসরে সদ্যমৃত কেউ আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা অপঘাতে মৃত কোনো মানুষের আত্মা আসে বলেও জানি না। প্রেততত্ত্বের বহু বই পড়েছি। কোথাও পড়িনি, অপঘাতে মৃতরা আসে। কারণ কী জানো? অরুণেন্দু চাপা গলায় বলতে লাগল।

তার মুখে উত্তেজনা থমথম করছে।..কারণ যারা অপঘাতে মারা পড়ে, তারা ভীষণ যন্ত্রণায় ভোগে অনন্ত কাল। মৃতদের জগতে কয়েকটা স্তর আছে। অপঘাতে মৃতরা সেই সব স্তরের বাইরে কোথাও স্থান পায়। সেখান থেকে যদি বা কেউ বস্তুজগতে এসে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। তাই ভগবান বা প্রকৃতি, যিনিই হোন, তাদের স্বাভাবিক পারলৌকিক স্তরগুলোতে রাখার ব্যবস্থা করেননি। ..

সুমন বলল, বাপস্। মাথাটা আর বিগড়ে দিও না অরুদা! তাছাড়া এসব শুনলে এ রাতে আর বাড়ি ফেরা কঠিন হবে। মাইণ্ড দ্যাট, পাঁচ কিলোমিটার দূরে থাকি।অরুণেন্দু বলল, সুদীপ্তকে তুমি চিনতে, সুমন? সুমন উঠে দাঁড়াল। অল্পস্বল্প। তবে ওর কথা আর নয়। দেখি বৃষ্টি কমল নাকি।…

০২.

বারাহিয়া টাউনশিপে জল সরবরাহ করা হয় ফুলঝরিয়া লেক থেকে। লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। চারিদিকে টিলাপাহাড় আর জঙ্গল। এক দিকটায় সুন্দর পার্ক করা হয়েছে সমতল জমির ওপর। পার্কে বিকালের দিকে অনেকে বেড়াতে আসে। ছাব্বিশে অক্টোবর বিকেলে পার্কের দক্ষিণপূর্ব কোণে বিশাল ম্যাকটামের মেঝের পাশে একটা বেঞ্চে বসে কথা বলছিল সুমন আর মঞ্জুশ্রী। সুমনের গাড়ি পার্কের উত্তরে ওয়াটার পাম্পিং সেন্টারের পেছনে রাখা ছিল।

পার্কটা লেকের দক্ষিণে। ওরা সেখানে বসে ছিল, সেখান থেকে বাঁদিকে একটা ন্যাড়া টিলা লেকের কিনারা থেকে উঠে গেছে। টিলাটার গায়ে বড় বড় পাথর। কথা বলতে বলতে মঞ্জুশ্রী হঠাৎ সেদিকে তাকাল। তারপর বলল, আরে! অনু ওখানে কী করছে?সুমন ঘুরে দেখে বলল, বেড়াতে এসেছে কারুর সঙ্গে! ছেড়ে দাও।না, না একা।সুমন হাসল। একা নয়। বাজি রাখছি, ওর প্রেমিক আড়ালে বসে আছে।

অনু ওদিকে কোথায় যাচ্ছে? প্রেমিকের কাছে।মঞ্জুশ্রী বলল, ভ্যাট! খালি প্রেমিক আর প্রেমিক!তাছাড়া আর কে থাকবে মঞ্জু, এই সুন্দর দিন শেষে নিরিবিলি ফুলঝরিয়া লেকের ধারে- সুমন খুব আবেগে হবু স্ত্রীকে চুম খাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।মঞ্জুশ্রী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি বড়বেশি সাহসী হয়ে উঠেছ অশকারা পেয়ে।

সুমন মুখ এগিয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ মঞ্জু! ফুলঝরিয়া একটা চুমুর প্রত্যাশা করে! তার খাতিরে।মঞ্জুশ্রী হেসে ফেলল তার কথাবলার ভঙ্গি দেখে। দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে সুমন অথবা এই সুন্দর লেকের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে গিয়ে হঠাৎ চমক খাওয়া গলায় সে বলল, এই, এই, অনু দৌড়ে যাচ্ছে কে-দেখ, দেখ! আঃ! বলে সুমন ঘুরল ওদিকে। তারপর সেও অবাক হল।

অনুরাধাকে খুব স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। টিলাটার ওপর শেষ বেলার রোদ ঝকমক করছে। সে টিলার ওদিকে নেমে গেল। মিনিট দুয়ের মধ্যে তার দৌড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে অস্বাভারিকতা ছিল।সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু বসবে তুমি? আমি দেখে আসি কী ব্যাপার।চলো আমিও যাই।পারবে না। দেখছ না ভীষণ চড়াই, আর পাথরে ভর্তি? শীগগির ফিরে আসবে কিন্তু। আমার একা থাকতে ভয় করবে।তুমি বরং গাড়িতে গিয়ে বসো, এই নাও চাবি।

গাড়ির চাবি দিয়ে সুমন হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। মঞ্জুশ্রী পার্কের গেটের দিকে হাঁটতে থাকল। পার্কে আজ তত লোক নেই তাদের মতো জোড়ায়-জোড়ায় কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রবীণ দম্পতি, আর কিছু নিঃসঙ্গ লোক চুপচাপ বসে আছে। ছড়িয়ে-ছাটিয়ে।সুমন টিলার পাথর বেয়ে সোজা উঠে যাচ্ছিল। তার মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং নেওয়া আছে। আগের অক্টোবরে সে কামেট শৃঙ্গ অভিযানে গিয়েছিল। দুর্যোগের জন্য দলটাকে ফিরে আসতে হয়। এবার আবার গেছে।

কিন্তু সুমনকে যেতে দেননি ওর মা। মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু প্রচুর পয়সা রেখে গেছেন ছেলের জন্য। গোটা তিনেক অভ্র খনির মালিক ছিলেন সুমনের বাবা। এখন খনিগুলো পরিত্যক্ত। তবে সুমন নিষ্কর্মা নয়। সে চাটার্ড অ্যাকাউন্টাষ্ট। বারাহিয়ার্স ইস্পাত কারখানার ম্যানেজমেন্ট দপ্তরের অ্যাকাউন্টস অফিসার।

সুমন অনুরাধাকে ডেকে সাড়া পাচ্ছিল না। টিলার দক্ষিণপূর্বে দিকে নেমে যেতে দেখেছে তাকে। নিচে ওদিকেও প্রকাণ্ড সব পাথর পড়ে রয়েছে। তার ফাঁকে ঝোপ ঝাড় সাজিয়েছে। একটা জলের ধারা মোটামুটি সমতল উপত্যকার মতো মাঠ ঘিরে ঝর্ণার আকারে লেকের পূর্ব দিকে মিশেছে। তার বুক জুড়ে পাথর। সড় সড় শব্দে জল ঝরে পড়ছে নিচের ডোবামতো একটা জায়গায় এবং ডোবাটা লেকেরই একটা অংশ হয়েছে।

একজন অচেনা লোক ডোবাটায় ছিপ ফেলে বসে আছে। মাথায় টুপি। পরনে। ধূসর জ্যাকেট, আর প্যান্ট। সুমন আবার অনুরাধা বলে ডাকতেই সে মুখ ফেরাল। মাথার টুপিটা পড়ে গিয়ে টাক চকচক করে উঠল। টুপিটা কুড়িয়ে নিল সে।এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। মুখে সাদা ঋষিসুলভ দাড়ি। টকটকে ফর্সা রঙ। যেন আশু সান্তাক্লজ। গলায় একটা বাইনোকুলার ঝুলছে। পাশে পাথরের ওপর পড়ে আছে।

একটা ক্যামেরা কিটব্যাগ, আর ছড়ির মতো দেখতে একটা সবুজ রঙের মাথায় পরানো ছোট্ট জাল।সুমন বলল, এদিকে একটা মেয়েকে আসতে দেখেছে।শান্তা ক্লজ বললেন, কৈ, না তো!সুমন এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনুরাধাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তার চোখ গেল খানিকটা দূরে পাথরের আড়ালে কী একটা রঙীন জিনিস যেন। সে সেদিকে দৌড়ে গেল।

ঝর্ণার ডোবা থেকে আন্দাজ একশো মিটার দুরে কয়েকটা পাথর আর ঝোপের ভিত্র একটা বড় গর্ত। গর্তে জল জমে আছে। আগের রাতের বৃষ্টিটাই এই জল জমার কারণ। সুমন যে রঙিন জিনিসটা দেখতে পেয়েছিল, সেটা অনুরাধার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ। গর্তে জলের ভেতর মুখ গুঁজে পড়ে আছে অনুরাধা। তার পিঠের ডানদিকে চাপচাপ টাটকা রক্ত। রক্তে গর্তের জল লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

সুমন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বোধ বুদ্ধি ফিরে আসতে লাগল। তারপর সে পিছিয়ে এল কয়েক পা। তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল–সে আর ওদিকে তাকাতে পারছিল না।মৎস্যশিকারী বৃদ্ধ এদিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। তার পা ফেলার ভঙ্গিতে সুমন বুঝতে পারছিল ভদ্রলোককে যতটা বৃদ্ধ মনে করেছিল, ততটা হয়তো নন। যুবকের মতো শক্তসমর্থ যেন।

কাছে এসে বললেন, সামথিং হ্যাড ইয়ং ম্যান? সুমন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অনুরাধাকে।বৃদ্ধ ভদ্রলোক চমকে উঠে দ্রুত এগিয়ে গেলেন গর্তটার দিকে। তারপরে অস্ফুটস্বরে বললেন, মাই গুডনেস! আমার মাত্র একশো মিটার পেছনে। তারপর ঘুরে সুমনকে বললেন, এরই খোঁজেই আসছিলেন কি? আজ্ঞে হ্যাঁ। সুমন আড়ষ্টভাবে জবাব দিল। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল।

আপনার কি নাম! কোথায় থাকেন? এই মেয়েটি কে? সুমন ব্যানার্জি। থাকি বারাহিয়ার নিউ কলোনিতে। সুমন ঢোক গিলে বলল, এ অনুরাধা।কুইক। এখনই বারাহিয়া থানায় গিয়ে খবর দিন। আমি থাকছি এখানে। ইন্সপেক্টর মিঃ মোহন শর্মা থাকলে তাকে বলবেন, কর্নেল আছে ডেডবডির কাছে।

সুমন একটু অবাক হল। কর্নেল? কর্নেল কী…মানে আপনার পুরো নামটা… বৃদ্ধ একটু হাসলেন। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।সুমন হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। এবার টিলার দিকে নয়, উত্তরদিকটা ঘুরে সহজ পথে।…

০৩.

এই শরৎকালে বারাহিয়া এলাকায় বেড়াতে এসে হত্যারহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের এতটুকু ছিল না। কিন্তু চেঁকি স্বর্গে গেলেও তাকে ধান ভানতে হয় এটাই চেঁকির নিয়তি। ফুলঝরিয়া লেকের আশেপাশে সকালে একজাতের প্রজাপতি দেখেছিলেন। তাছাড়া লেকের পূর্বপ্রান্তে ঝর্ণার মোহানায় ছোট্ট জলাশয়ে ছিপ ফেলে বিকেলটা কাটানো লোভনীয় মনে হয়েছিল। কল্পনাও করেননি, তাঁর মাত্র একশো মিটার পেছনে এইভাবে একটা সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবে–নিয়তি যেন তার সঙ্গে একটা কদর্য পরিহাস করে বসল।

নিহত মেয়েটির নাম অনুরাধা সান্যাল। তার বাবা পরিতোষ সান্যাল স্থানীয় সরকারি শিল্পসংস্থার কর্মিদফতরের অফিস সুপারিন্টেন্টে। আর এক বছর পরে রিটায়ার করবেন। তার কাছে পুলিশ এমন কোনও সূত্র পায়নি, যাতে অনুরাধার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রণয়-প্রতিহিংসা বা এধরনের কোনও ব্যাপার আছে বলে মনে হবে। অনুরাধা নাকি সাদাসিধে আর মুখচোরা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের মেয়ে মঞ্জুশ্রী আর শান্তপ্রসাদজীর মেয়ে ভাবনা।

তারাও পুলিশকে কোনও সূত্র দিতে পারেনি। মঞ্জুশ্রী যা বলেছে, তাতে সুমন ব্যানার্জীর অ্যালিবাই সঠিক সাব্যস্ত হয়েছে। তারা দুজনেই দেখেছিল, অনুরাধা দৌড়ে টিলা বেয়ে ওপাশে নেমে যাচ্ছে। শুধু এটুকু বোঝা যায়, কেউ তাকে তাড়া করে গিয়ে ছুরি মেরেছে। সুমনের বক্তব্য হল অনুরাধার ওভাবে দৌড়ানোটা তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তাই সে খোঁজ নিতে গিয়েছিল হন্তদন্ত হয়ে।

যে গর্তে অনুরাধার বডি পড়ে ছিল, তার চারপাশে মাটিতে ঘন ঘাস। তাই তাদের ছাপ পাওয়া অসম্ভব। টিলাটার ঢালু অংশে মাটি পাথুরে। আগের রাতে বৃষ্টি হলেও পায়ের বা জুতোর ছাপ পড়ার মতো নরম হয়নি মাটিটা। অন্তত পুলিসের চোখে পড়েনি কোনো ছাপ।

ইন্সপেক্টর শর্মাজী সকালে সেচ দপ্তরের বাংলোয় এসে কর্নেলকে এইসব কথা জানিয়ে গেছেন। তার সিদ্ধান্ত হল ফুলঝরিয়া লেকের ওদিকে খুনোখুনি না হলেও মেয়েদের প্রতি মস্তানদের দৌরাত্মের অভিযোগ ইতিপূর্বে পাওয়া গেছে। অনুরাধাকে সম্ভবত কোনো মস্তানই রেপ করার জন্য তাড়া করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে রাগের চোটে ছুরি মেরে পালিয়ে গেছে। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার দুবৃত্তরা খুব সহজেই ছুরি চালাতে ওস্তাদ।

সিদ্ধান্তটা তত টেকসই অবশ্য নয়। তবু পুলিশের নিজস্ব কিছু প্রবণতা ও পদ্ধতি আছে এসব কেসে। তাছাড়া আজকাল যথেষ্ট খুনোখুনির দরুন পুলিশ আগের মতো মাথা ঘামাতে চায় না। রুটিন ডিউটি সেরে নেয় মাত্র।

 

Read more

কালো পাথর (২য় পর্ব) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *