কোথাও কেউ নেই পর্ব – ১০ হুমায়ূন আহমেদ

কোথাও কেউ নেই পর্ব – ১০

অ্যাম্বুলেন্স আনতে গেছে মানে? আনতে গেলেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে নাকি? চলে এলে তো কাজই হত। হাসপাতালে সত্যি সত্যি নিতে হলে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাতে করেই নিতে হবে।

বাকের ছুটিল বেবিটেক্সি ধরে আনতে। এই বেবিটেক্সিতেই টিনার যমজ ছেলে হল।

বাকের দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, বেকুব মেয়েছেলেদের নিয়ে মুসিবত।

বাচ্চা কার মত হয়েছে বকুল? আমার মত না তোর ভাইয়ের মত?

কারো মতই না।

বকুল উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল টিনার দিকে। টিনা ভাবী কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। কী চমৎকার মায়া মায়া চেহারা হয়েছে টিনা ভাবীর।

দু’জনকে সামলাবে কী ভাবে?

টিনা হাসতে হাসতে বলল, একটাকে তুই নিয়ে যা। অরুণকে নিয়ে যা। অরুণ বড্ড জ্বালায়।

অরুণ কোনটি?

বাঁ পাশেরটি।

দু’জনই তো এক রকম।

দূর-দূর এক রকম হবে কেন? চেহারা দুরকম, কাঁদে দুরকম করে। ওদের গায়ের গন্ধও দুরকম।

কী যে তুমি বল ভাবী।

ঠিকই বলি। নে তুই অরুণকে নিয়ে যা।

সত্যি সত্যি কিন্তু নিয়ে যাব।

নিয়ে যাবার জন্যেই তো বললাম। তুই কী ভাবছিস ঠাট্টা করছি?

বকুল খুব সাবধানে একজনকে কোলে তুলল! কী চমৎকার একটা ঘ্রাণ আসছে গা থেকে। বাসি শিউলী ফুলের ঘ্রাণ এত মায়া লাগে কেন? বকুলের চোখে পানি আসার উপক্রম হল।

তোর ভাই যমজ বাচ্চা হওয়া উপলক্ষে আমাকে যমজ শাড়ি দিয়েছে। বাচ্চা-কাচ্চা হলে বউকে শাড়ি দিতে হয় জানিস তো?

না। জানি না।

দিতে হয়। কষ্ট করে বাচ্চা আনে। সেই জন্যে দেয়া। দেখ তো শাড়ি দুটো কেমন।

দু’টি একই রকম শাড়ি। নীল জমিনের ওপর সাদা ফুল।

খুব সুন্দর ভাবী, তোমাকে দারুণ মানাবে।

একটা শাড়ি তুই নিবি?

বকুল বিব্রত স্বরে বলল, আমি নেব কেন? কষ্ট করবে তুমি, শাড়ি নেব আমি?

দুটাই তো আর নিচ্ছিস না। একটা নিচ্ছিস।

না ভাবী প্লিজ।

না নিলে আমি খুব রাগ করব, ক’দিন কথা বলব না তোর সাথে। তোকে দেবার জন্যেই তোর ভাইকে বলে আমি দু’টি শাড়ি আনিয়েছি। শুধু শাড়ি না, ব্লাউজ-পেটিকোট সবই আছে। যা, কাপড় বদলে আয়।

বকুলকে শাড়ি পরে আসতে হল। টিনা দীর্ঘ সময় তার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন যা ঐ ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে পেপসি খেয়ে আয়।

বকুলের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। টিনা বিরক্ত স্বরে বলল তুই কী ভাবছিস কেউ কিছু টের পায় না। সবাই সব কিছু টের পায়। তোর ভাইয়ের কাছে শুনলাম। সে দেখেছে তুই ঐ ডাক্তার ছোকরার সঙ্গে বসে কোক না পেপসি কি যেন খাচ্ছিস, আর খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছিস।

বকুলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। এসব কি বলছে ভাবী। কিন্তু টিনা খুব স্বাভাবিক। বাচ্চার নাভিতে বরিক পাউডার দিতে দিতে বলল, কিছু মানুষই আছে যারা শুধু অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গে ছোক ছোক করতে চায়। প্রথমে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তারপর গায়ে-টায়ে হাত দেয়।

কি যে তুমি বল ভাবী।

ঠিকই বলি। ঘাস খেয়ে তো বড় হইনি।

তুমি যা ভাবিছ সে সব কিছু না।

প্রথম প্রথম এ রকম মনে হবে। তারপর দেখবি এক’দিন হঠাৎ হাতের সঙ্গে হাত লেগে যাবে। যেন একটা অ্যাকসিডেন্ট। তারপর এক’দিন আশপাশে লোকজন না থাকলে জড়িয়ে ধরবে। চুমু খাবে।

কি যা তা বলছ?

ঠিকই বলছি। না জেনে বলছি?

ওনার সম্পকে এরকম বলাটা ঠিক না। সব মানুষ তো এক রকম নয়।

সব মানুষই এক রকম। সবারই দুটো করে চোখ, দুটো কান, একটা নাক। খবরদার আর কখনো। এখানে যাবি না। দরকার হয় সে আসবে, তুই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরারি।

ছিঃ।

এত ছিঃ করতে হবে না। যা বলছি মনে রাখিস।

খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল বকুল। নতুন শাড়ি পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে কেন জানি তার লজ্জা করছিল। ফার্মেসির পাশ দিয়ে আসবার সময় খুব ইচ্ছা হল একবার তাকিয়ে দেখে ডাক্তার আছেন কি না। কিন্তু কিছুতেই তাকাতে পারল না। তার কেন জানি মনে হল ডাক্তার সাহেব আছেন এবং তিনি তাকে দেখছেন অবাক হয়ে। এক্ষুণি বেরিয়ে এসে ডাকবেন–এই বকুল, এইভাবে পালিয়ে যাচ্ছ কেন?

কিন্তু কেউ ডাকল না। কেউ ডাকেনি শুধুমাত্র এই কষ্টেই তার চোখ ভিজে উঠছিল। কেন তার এ রকম হচ্ছে? এটা কি কোন অসুখী? না অন্য কিছু?

শওকত সাহেব সুন্দর শাড়ি পরা এই মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি তারই মেয়ে এটা বুঝতে সময় লাগল।

বকুল মা, কাঁদছিস কেন?

কাঁদছি না। কাঁদবো কেন শুধু শুধু।

বকুল তাকে পেছনে ফেলে তর তর করে এগিয়ে গেল। শওকত সাহেব অনেকক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলেন একই জায়গায়। তার মেয়েটি এত বড় হয়ে গেছে। এটি কেন এতদিনেও তার চোখে পড়েনি?

কাঁদছিস কেন? পাড়ার ছেলেরা কিছু বলেছে? মেয়েটির জন্যে তার নিজের মন কেমন করতে লাগল। এদেরকে অসহায় ফেলে রেখে দীর্ঘ দিনের জন্যে তাকে জেলে ঢুকে পড়তে হবে। উকিল সাহেব যদিও বলছেন কিছুই হবে না, কিন্তু তিনি জানেন ব্যাটা মিথ্যা কথা বলছে। উকিলরা সত্যি কথা বলতে পারে না।

শওকত সাহেব মাথা নিচু করে বুড়ো মানুষের মত হাঁটতে লাগলেন।

মামলার আবার একটি ডেট পড়েছে। এ রকম কি অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকবে? উকিল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, একেকটা মামলা চার-পাঁচ বছর ধরে ঝোলে। ঝোলাটাই ভাল। যত ঝোলে, মামলা তত দুর্বল হতে থাকে। সামনের মাসে আসেন দেখা যাবে।

শওকত সাহেবকে বেশ খুশি খুশি মনে হয়। তিনি যেন সমস্ত ব্যাপারটাকেই এড়াতে চাইছেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। তিনি উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, চল রে মুনা বাড়ি যাই।

আমি যাব না, তুমি যাও। বাকের ভাইকে নিয়ে যাও।

তুই এখন কি করবি?

অফিসে যাব।

তিনটার সময় অফিসে গিয়ে কি কারবি?

আমার কাজ আছে।

কি কাজ?

আছে একটা কাজ। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে পারব না।

মুনা রিকশায় উঠে বসল। অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল। লোকজন বেশির ভাগই বাড়ি চলে গেছে। যারা যায়নি তারা টেবিলপত্র গুছিয়ে ফেলছে। পাল বাবু ছিলেন। তিনি হাসি মুখে বললেন, আপনার কাজ হয়েছে। লোন স্যাংশন হয়েছে। ঘণ্টাখানেক আগে এলে চেক পেয়ে যেতেন। অবশ্য আজ পাওয়া আর কাল পাওয়া সেম। এখন তো আর ভাঙাতে পারছেন না।

এটা একটা ভাল খবর। টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মুনা খুশি হতে পারছে না। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। সামলানো যাচ্ছে না। রিকশা ভাড়াতেই অনেকগুলি টাকা চলে যাচ্ছে। সামনে কি অবস্থা হবে কে জানে। পাল বাবু বললেন, বিয়ে উপলক্ষে লোন নিলেন নাকি?

না।

না কেন? ঐ ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলুন।

দেখি।

উঠছেন নাকি? কোন দিকে যাবেন? আসুন। এগিয়ে দেই! এই টাইমে রিকশা পাওয়া মুশকিল।

কোথায় যাবে মুনা মনস্থির করতে পারল না। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মামুনের খোঁজে যাওয়াও অর্থহীন। সে নিশ্চয়ই ফেরেনি। আর ফিরলেই কি। যে লোক দীর্ঘ দেড় মাস কোনো রকম খবর না দিয়ে ডুব দিয়ে থাকতে পারে তার কাছে বার বার যাওয়ার কোনো কারণ আছে কি? তারেকের বাসার ঠিকানা জানলে সেখানে যাওয়া যেত। দেখা যেত কেমন মেয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু ওর ঠিকানা জানা নেই। কাঁচা বাজারের দিকে গেলে কেমন হয়, বেশ কিছুদিন ধরে বাজার হচ্ছে না। ডাল ভাত আর ডিম খেতে খেমে অরুচি ধরে গেছে। মুনা ব্যাগ খুলে টাকা গুনল। বাজার করার মত টাকা নেই। তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে তার কোথাও যাবার জায়গা নেই। মুনা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।

দরজায় খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। মামুন অবেলায় ঘুমিয়ে ছিল। শীতর শুরুতে বিকেল বেলার ঘুম অন্য রকম একটা আলস্য এনে দেয় শরীরে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না।

কে?

আমি–আমি মুনা।

মামুন দরজা খুলে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাল। মুনার চোখ-মুখ কঠিন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রোগে আছে।

এস, ভেতরে এস। কেমন আছ বল?

মুনা শুকনো গলায় বলল, এসেছ কবে?

গতকাল। আজ ঠিক করে রেখেছিলাম যাব তোমার ওখানে। ভালই হয়েছে। দেখা হল। রোগা হয়ে গেছ মুনা।

মুনা চুপ করে রইল। মামুন বলল, বুঝতে পারছি খুব রেগে আছ।

রাগব কেন?

এই যে ডুব দিলাম দেড় মাস। এদিকে তোমার এমন দুঃসময়।

আমার দুঃসময়ের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? আমি কি তোমাকে বলেছি আমার দুঃসময়ে আমার হাত ধরে বসে থাকতে?

জাস্ট এ মিনিট। আমি মুখ ধুয়ে চায়ের কথাটা বলে আসি। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

মুনা লক্ষ্য করল মামুন বেশ সহজ স্বাভাবিক। দীর্ঘ দিন যে ডুব মেরে ছিল তার জন্যে তার বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তার স্বাস্থ্যও ভাল হয়েছে। দেখেই মনে হয় সে সুখেই ছিল। সুখী সুখী চেহারা।

শুধু চা নয়। চায়ের সঙ্গে পিয়াজু এবং বেগুনী। মামুন খুব উৎসাহের সঙ্গে খেতে শুরু করল। মুনা বলল, এত দিন যে ডুব দিয়েছিলে চাকরির অসুবিধা হয়নি?

লতিফা ছটফট করছিলেন সন্ধ্যা থেকেই–মুনা এসেছে? মুনা এসেছে? বকুল বিরক্ত হয়ে বলেছে এলে তো তোমাকে বলতাম মা। একশো বার এক কথা বলছ কেন?

আজ সমস্ত দিন লতিফার শরীর খারাপ গেছে। দুপুরে একবার বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল। শরীরটা একেবারেই গেছে। দুপুরে কিছুই খেতে পারেননি। বমি করে উগড়ে ফেলেছেন। সন্ধ্যাবেলা তার বুক কাঁপতে লাগল। পুরনো শ্বাস কষ্ট নয়, অন্য এক ধরনের কষ্ট। তাঁর ভয় করতে লাগল। তিনি চাপা স্বরে কয়েকবার বাবুকে ডাকলেন। কেউ এল না। হয়ত শুনতে পায়নি। কিংবা শুনেও আসছে না। আজকাল সহজে তার কাছে কেউ আসে না।

এক সময় সখিনা এসে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করল। কি অলক্ষুণে ব্যাপার। সন্ধ্যাবেলা কেউ গৃহস্থ বাড়িতে বাট দেয়? তিনি অনেকক্ষণ উঁচু গলায় বকাঝকা করলেন। তার বুকের ধরফরানি আরো বেড়ে গেল। এক সময় মনে হল ঘরের আলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। চোখে বিধছে। অনেক রাতের দিকে মাঝে মাঝে এ রকম হয়। আলো হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য বেড়ে যায়। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুনার জন্যে। মিনিটে একবার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দেখ তো মুনা এসেছে নাকি?

মুনা এসে তার অবস্থা দেখে বড়ই অবাক হল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ব্যাপার কী? মুনা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, মামা ফেরেননি?

বাবু বলল–ফিরেছিলেন, আবার কোথায় যেন গেছেন।

মামি কি রকম করছে তোরা দেখছিস না? যা দৌড়ে ডাক্তার নিয়ে আয়।

লতিফা হাঁপাতে শুরু করলেন। ঘরের আলো এত উজ্জ্বল যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না।

মামি খুব খারাপ লাগছে?

হুঁ। তুই আমার হাত ধরে বসে থাক।

মুনা হাত ধরে পাশে বসল। বকুল অবাক হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে, লতিফা তাকালেন বকুলের দিকে। কি সুন্দর একটি মেয়ে, কে বলবে তার মত অতি সাধারণ একটি মায়ের কোলে এত সুন্দর একটি শিশু আসবে।

মুনা বলল, দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? একটা ন্যাকড়া ভিজিয়ে এনে কপাল মুছিয়ে দে। বকুল ছুটে গেল রান্নাঘরে। লতিফা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারিস বকুলের বিয়ে দিয়ে দিবি। এত সুন্দর মেয়ে ঘরে বেশিদিন রাখবি না। অনেক সমস্যা হবে।

ঠিক আছে দেব।

পড়াশোনা কপালে থাকলে হবে, না থাকলে হবে না। তুই ওর বিয়ে দিয়ে দিবি। যত তাড়াতাড়ি পারিস।

বিয়ে দিলেই সব সমস্যা সমাধান হয় নাকি মামি?

লতিফা কিছু বললেন না। বকুল মাথায় ভেজা ন্যাকড়া বুলোতে লাগল। তিনি কাঁপা গলায় বললেন–আহ ঠাণ্ডা লাগে।

ডাক্তার এল সাড়ে সাতটায়। তারও ঘণ্টা তিনেক পরে দীর্ঘ ছ-বছরের রোগ যন্ত্রণার অবসান হল। ডাক্তার ছেলেটি বড় অবাক হল। সে এমন ভাবে সবার দিকে তাকাতে লাগল যেন ঘটনাটি সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার হাতে এটিই কি প্রথম মৃত্যু?

কিছু কিছু ঘটনা মানুষ দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করে। সেই চেষ্টা সচেতন ভাবেই করা হয় এবং সে কারণেই সে লজ্জিতও বোধ করে। মৃত্যু এমন একটি ঘটনা। অতি প্রিয়জনের মনে হয় না সেই প্রিয়জন কোনো কালে আমাদের মধ্যে ছিল। কেন এ রকম করা হয়? আমাদের নিজেদের ব্যবহারে নিজেরাই অবশ্য লজ্জিত হই, যার জন্যে প্ৰিয়জনটির একটি বড় ছবি যত্ন করে দেয়ালে টাঙানো হয়। এবং এক’দিন কেউ খুব রাগারগি করে ফ্রেমে মাকড়শার জাল, কেউ দেখছে না, ধ্যাপারটা কি?

লতিফার মৃত্যুর পর তার কোনো ছবি দেয়ালে টাঙানো হল না। তবে তার বিয়ের একটি ছবি মুনা বের করে খুব কাদাল। সেই ছবিতে তাকে দেখাচ্ছিল একটি দুষ্ট বালিকার মত। শওকত সাহেবের চোখে চশমা। কেমন ভয় পাওয়া চেহারা। ছবিটি স্টুডিওতে তোলা। সন্ট্রডিওতে তোলা সব ছবিই কেমন মূর্তি মূর্তি হয়। এই ছবিটি সে রকম নয়। প্রাণের একটা ব্যাপার আছে কোথাও। কিংবা এও হতে পারে মানুষের মৃত্যুর পর তাদের সব ছবিতে কিছু প্ৰাণ সঞ্চার হয়।

লতিফার ঘর আগের মতই আছে। মৃত মানুষদের ঘর দীর্ঘদিন একই রকম থাকে। সহজে সে ঘরের কোনো কিছুতে কেউ হাত দিতে চায় না। তবু ঘরটা কেমন যেন আগের মত থাকে না! সূক্ষ্ম। একটা পরিবর্তন হয় কোথাও। সে পরিবর্তন সূক্ষ্মণ হলেও যে-কেউ ধরতে পারে।

প্রথম রাত এই ঘরে ঘুমুতে এসে শওকত সাহেবের ভয় ভাগ করতে লাগল। লতিফার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যেই তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন পুবনো দিনের কথা মনে করতে। সমস্তই মনে আছে কিন্তু সে সব নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছে না; বরং শওকত সাহেবের মনে হতে লাগল। এই ঘবে কে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব সাবধানে পা ফেলছে। নিঃশব্দ পদচারণা! এইবার যেন বসল পাশের চেয়ারটায়। ভয় কাটাবার জন্যে তিনি শব্দ করে কাশলেন। সেই কাশির শব্দে তার নিজেরই ভয় বেড়ে গেল। তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা করলেন।

তখনি মনে হল মাথার উপরের ফ্যান ঘুরতে শুরু করেছে। লতিফা শীতের মধ্যেও ফ্যান না ছেড়ে ঘুমুতে পারত না। সেই জন্যেই কি? ঘর অন্ধকার, তবুও সব কিছু আবছা আবছা দেখা যায়। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফানটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হা ফ্যান ঘুরছে। শওকত সাহেবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। তিনি চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন এবং স্পষ্ট শুনলেন মশারিব ওপাশে কেউ যেন মিষ্টি করে হাসল; প্রথম যৌবনে লতিফা যেমন হাসত। শওকত সাহেব ভাঙা গলায় ডাকলেন, মুনা মুনা।

মুনা সম্ভবত বারান্দায় বসে ছিল সে এসে দরজায ধাক্কা দিল, কি হয়েছে মামা? শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, কিছু না তুই যা।

মামা দরজা খোলো।

শওকত সাহেব দরজা খুলে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন।

কি হয়েছে?

তিনি জবাব দিলেন না। মুনা বলল, ভয় পাচ্ছ?

হুঁ।

কেন, ভয় পাঁচ্ছ কেন?

ফ্যানটা ঘুরছে শুধু শুধু।

কোথায় ঘুরছে?

না এখন আর ঘুরছে না। শওকত সাহেব ক্লান্ত স্বরে বললেন, যা খুমুতে যা। মুনা বলল, তুমি বরং আমাদের ঘরে ঘুমাও। বাবুর সঙ্গে শুয়ে পড়ে। আমি এখানে ঘুমাব।

শওকত সাহেব কোনো কথা বললেন না। মুনা বলল যাও মামা আমার কথা শোন। তাছাড়া আজ রাতটা এমনিতেই তোমার উচিত ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমানো।

শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, তোর মামির ওপর বড় অবিচার কবেছি রে মুনা।

তা করেছ।

বড় খারাপ লাগছে।

অল্প কয়েক দিন লাগবে, তারপর আর লাপবে না। মানুষ বড় অদ্ভুত প্ৰাণী মামা।

শওকত সাহেব কোনো কথা বললেন না। মুনা চাপা স্বরে বলল, ধর কিছু দিন পর আবার যদি তুমি বিয়ে কর তাহলে প্রথম কিছু দিন ঐ মেয়েটিকে খুব ভালবাসবে, তারপর আবার আগের মত নানান অবিচার শুরু করবে এবং এক সময় বিছানা-বালিশ নিয়ে আলাদা ঘুমুতে চাইবে। চাইবে না?

শওকত সাহেব একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, যাও ওদের ঘরে গিয়ে শোও। ওরা জেগেই আছে, ওদের সঙ্গে দু’একটা কথা-টথা বল।

কি কথা বলব?

যা মনে আসে বল। ওদের সাহস দাও।

বাবু তার বাবাকে পাশে শুতে দেখে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল। বকুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মশারির ভেতর থেকে। শওকত সাহেব ডাকলেন, বাবু। বাবু জবাব দিল না।

ঘুমাচ্ছিস নাকি বাবু?

না!

বকুল ঘুমাচ্ছিস?

না।

শওকত সাহেব তাদের কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ নেই। চিরদিন দূরে দূরে থেকেছেন। একটা আড়াল তৈরি হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ করে ওদের কাছে আসা যায় না। ওরা কাঁদছেও না। কাঁদলে বলা যেত কাঁদিস না রে। শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন গরম লাগছে, তাই না? বকুল বা বাবু কেউই কিছু বলল না।

মুনার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এল না। পায়ের কাছে জানালাটা খোলা। খোলা জানালায় শীতল হাওয়া আসছে। সেই হাওয়ায় সিলিং ফ্যানটি অল্প অল্প ঘুরছে। ঘরে অন্য রকম একটা গন্ধ। রোগের গন্ধ, শোকের গন্ধ, মৃত্যুর গন্ধ। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে ডাকল, মামি। কেউ জবাব দিল না। মৃত্যুর ওপারে অন্য কোনো ভুবন আছে কী? না থাকাটা খুব কষ্টের হবে।

মুনার পানির তৃষ্ণা হচ্ছিল কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনার ইচ্ছা হচ্ছিল না। সে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। কত অসংলগ্ন কথাই না তার মনে এল। যার সঙ্গে মামির কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। খুব ছোটবেলায় নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে লাল রঙের একটা প্রকাণ্ড কাকড়া তার দিকে হঠাৎ ছুটে আসতে শুরু করল। অনেক দিন পর সেই দৃশ্যটি পরিষ্কার মনে এল। কেন এল?

শীত করছে। এবার কি আগে ভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? কাঁথায শীত মানবে না। লেপ বের করতে হবে শিগগির। লেপগুলির কি অবস্থা কে জানে। তেলাপোকায় কেটেকুটে সর্বনাশ করে। রেখেছে হয়ত। অনেক দিন রোদে দেয়া হয় না।

মুনা বিছানা ছেড়ে উঠল। পানির পিপাসা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। দরজা খুলে বের হয়ে সে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মামা তাঁর ছেলেমেয়ে দু’টিকে নিয়ে ক্যাম্পখাটে বসে আছেন। দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছেন দু’জনকে। মামা ধরা গলায় ডাকলেন মুনা, আয় মা এদিকে।

মুনা গেল না। নিশিরাত্রির এই মুহূর্তটি ওদের। সেখানে তার স্থান কোথায়? সে রান্নাঘর থেকে পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। আজ সারাদিন বড় পরিশ্রম গিয়েছে। বড় ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। মুনা চেষ্টা করল তার বাবার ছবিটি মনে আনতে। কিছুতেই মনে এল না। শুধু মনে পড়ল প্রচণ্ড একটা শীতের রাতে ছোট খালা তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বাবার ঘরে। চারদিকে অনেক লোকজন, অনেক আলো। ছোট খালা বলছেন চল মা, বাবাকে একটা চুমু দিয়ে আসবে। লক্ষ্মী মেয়ের মত বাবাকে একটা চুমু দেবে।

বাবার ঘর ভর্তি মানুষ। সবাই কেমন অন্য রকম। বাবা তাকে দেখে কাঠির মত রোগা একটি হাত উঁচু করলেন। মুনা তার খালার গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল। সে কিছুতেই যাবে না। বাবার কাছে। বাবা দুর্বল স্বরে বললেন, ও ভয় পেয়েছে, ওকে নিয়ে যাও। ছোট খালা ঘর থেকে বের করে এনে প্রচণ্ড একটা চড় দিয়ে বলেছিলেন, বোকা মেয়ে।

মুনা কথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল বাবা ঐ ভয়ংকর রাতে তোমাকে চুমু খেতে পারিনি। কিন্তু তোমাকে আমি লক্ষ লক্ষ চুমু খেয়েছি। কোনোদিন তুমি তা জানতে পারবে না। এই দুঃখ আমি সারা জীবন বুকের মধ্যে পুষে হাসি মুখে ঘুরে বেড়াব। কত রকম সুখের ঘটনা ঘটবে আমার জীবনে। ঘর-সংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে। ওরা বড় হবে ওদের বিয়ে হবে, কিন্তু সেই দুঃখ থাকবেই।

মৃত্যুর পর কি কোনো জগৎ সত্যিই নেই? এই একটিই জীবন আমাদের? কোনোদিন বাবার কাছে দু’হাত বাড়িয়ে যাওয়া যাবে না? শৈশবের দিনগুলি কি ভয়াবহই না ছিল। কিছু দিন এর বাড়ি, কিছু দিন ওর বাড়ি। সাত বছর বয়সেই বুঝতে পারল সে একটা উপদ্রবের মত। কেউ তাকে দীর্ঘদিন রাখতে চায় না। তার যখন নবছর বয়স তখন এক’দিন মামা এসে বললেন মুনা, তুই চলে আয় আমার সাথে। আমার সাথে থাকবি। ছোট খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর সাথে থাকবে মানে! তুই একা মানুষ মেসে পড়ে আছিস।

একটা ঘর ভাড়া নেব। এখানে ওর কষ্ট হচ্ছে।

মামা সত্যি সত্যি ঘর ভাড়া করে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। দু’জন মাত্র মানুষ তারা, কত রকম সমস্যা। রাত নটা-দশটা পর্যন্ত মুনাকে মাঝে মাঝে একা থাকতে হত। কি যে ভয় লগত একেক দিন। কিন্তু সে সুখে ছিল। মামা তাকে ভালবাসায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন। যার যতটুকু ভালবাসার প্রয়োজন সে বোধহয় তা কোনো না কোনো ভাবে পেয়েই যায়। মুনার অস্পষ্ট ভাবে মনে হল সে সুখী হবে। ভালবাসার অভাব তার জীবনে হবে না।

শেষ রাতের দিকে মুনা সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল। রিকশা করে সে আর মামুন যাচ্ছে। রিকশা যাচ্ছে কোনো একটা পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে। অপূর্ব সব দৃশ্য চারদিকে। খুব বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাস অগ্রাহ্য করে মামুন সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছে। একটার পর একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি নষ্ট হচ্ছে। মামুন বড় বিরক্ত হচ্ছে। সে যতই বিরক্ত হচ্ছে মুনার ততই মজা লাগছে।

কত রকম অদ্ভুত স্বপ্নই না মানুষ দেখে।

মামুন ভেবেছিল ঢাকায় খুব বেশি হলে সাতদিন থাকবে।

বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। রাজমিস্ত্রী ঠিক করা আছে, ওরা বসে থাকবে। মেশিন রাখার বেস পাকা হবে। একটা হাফ বিল্ডিং হবে, প্রচুর কাজ। কিন্তু ঢাকা থেকে বের হবার সে পথ পাচ্ছে না। মুনার সঙ্গে সরাসরি কথা হওয়া দরকার। সমস্ত পরিকল্পনাটি তাকে ভালমত বোঝানো দরকার। তাও সম্ভব হচ্ছে না, একটির পর একটি ঝামেলা লাগছে। ছোটখাটো ঝামেলাও নয়, বিরাট সব ঝামেলা। এর মধ্যে ইন্ডাসট্ৰি-ফিন্ডাসটির কথা বলা যায় না।

তাছাড়া ঢাকায় এসে কেন জানি মনে হচ্ছে মুনা ঠিক আগের মত নেই। তাকে তেমন পছন্দ করছে না, এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। সেদিন ওর অফিসে গিয়েছিল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কোনো কাজে এসেছ না। এমনি?

জরুরি কথা ছিল কিছু।

এখন তো খুব ব্যস্ত। তুমি চলে যাও, আমি যাব তোমার কাছে।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *