কোথাও কেউ নেই পর্ব – ১৯ হুমায়ূন আহমেদ

কোথাও কেউ নেই পর্ব – ১৯

বাকের অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পৰ্যন্ত কয়েকবার হাটল। রাস্তার মোড়ে টর্চ হাতে দু’জন ট্রাফিক পুলিশ। এই রকম জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ? নিৰ্ঘাৎ মিনিস্টার সাহেব আসছেন সেই উপলক্ষে। একবার গিয়ে দেখে আসবে নাকি কেমন জমেছে সব কিছু? বাকের মনস্থির করতে পারল না। মুনাদের বাসায় গেলে কেমন হয়? না, তাদেরও পাওয়া যাবে না। সেজেগুজে দল বেঁধে হয়তো গিয়েছে থিয়েটার দেখতে। বাকের রওয়ানা হল কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িটির দিকে। এই বাড়ির কেউ থিয়েটারে যাবে না। এরা ঘরে থাকবে। সে যদি গিয়ে বলে, চলুন থিয়েটার দেখে আসি তাহলে কেমন হয়? চশমা পরা বুড়ি তার উত্তরে কি বলবে? মেয়ে তিনটিই বা কি করবো? এদের সঙ্গে এখনো কথাবার্তা হয়নি? নাম পৰ্যন্ত জানা নেই। এদের নিশ্চয়ই খুব বাহারি নাম। ফুলেশ্বরী, রত্নেশ্বরী এ রকম। এর নিশ্চয়ই কণা, বীণু এ রকম নাম রাখবে না; রাখলেও বদলে ফেলবে।

গেট তালাবন্ধ। গেটের ভেতরে একটি কালো রঙের গাড়ি। জোবেদ আলিকে দেখা গোল গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে হেসে হেসে কি বলছে। জোবেদ আলির হাতে সিগারেট। অথচ কয়েক’দিন আগেই সে বলেছে সিগারেট খায় না। বাকের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকল, এই যে জোবেদ আলি সাহেব। একটু শুনে যান।

জোবেদ আলি গম্ভীর মুখে এগিয়ে এল।

কেমন আছেন ভাই?

ভাল। কি চান?

কিছু চাই না। গল্পগুজব করতে আসলাম।

জোবেদ আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের হাসিমুখে বলল, থিয়েটারে যান নাই? রাতের পাখিরা হচ্ছে।

জি না। থিয়েটার দেখি না।

মেয়েরাও যায় নাই?

না।

যান নাই কেন? কাস্টমার এসেছে নাকি?

কি বললেন?

বললাম কাস্টমার এসেছে নাকি? মেয়ে তিনটা তো ব্যবসা করে তাই না?

জোবেদ আলি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, ভদ্রপাড়ায় বেশ্যাবাড়ি খুলে ফেললেন?

জোবেদ আলি থমথমে গলায় বলল, পাগলের মত কি বলছেন? বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, ঠিক বলছি। একটা কথাও ভুল বলি নাই। গেট খুলেন। বুড়ির সঙ্গে কথা বলব।

আপনি সকাল বেলায় আসেন। যা বলার সকালে বলবেন।

বাকের সিগারেট ধরিয়ে উদাস স্বরে বলল, বেশ্যার দালালি কতদিন ধরে করছেন?

আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ আপনাকেই। আপনি ছাড়া আর কে আছে। নেন সিগারেট নেন।

আমি সিগারেট খাই না।

একটু আগেই তো দেখলাম সিগারেট টানছেন।

জোবেদ আলি নিচু গলায় বলল–বাকের ভাই, আপনি সকালে আসেন। এখন হৈচৈ করবেন না।

হৈচৈ? হৈচৈ কোথায় করলাম?

ভাই আপনি এখন যান।

সাদা শাড়ি পরা ফর্সা মহিলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। সে রিনারিনে গলায় বলল, কে কথা বলে রে?

জোবেদ আলি বলল, কেউ না আম্মা।

জোবেদ আলি এই মহিলাকে আম্মা ডাকে নাকি? এটা জানা ছিল না। বাকের সিগারেট টানতে টানতে রাস্তার দিকে রওনা হল। এখন তার বেশ একটা ফুর্তির ভাব হচ্ছে। কালো গাড়িতে করে যে ভদ্রলোক তিন কন্যার কাছে এসেছেন তার শার্টের কলার চেপে ধরলে কেমন হয়? বাকের নিজের মনে খানিক্ষণ হাসল। দলবল জুটিয়ে বাড়ি ঘেরাও করলে হয়। কিন্তু সবাই গেছে রাতের পাখিরা দেখতে। সেখান থেকে হাতী নিয়ে টেনেও কাউকে আনা যাবে না। বাকের মুনাদের ঘরের দিকে রওনা হল। কাউকে ঘটনাটা বলতে না পারলে রাতে ঘুম হবে না।

অনেক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। বাকের হাসিমুখে বলল, খবর কি মুনা? মুনা বিরসমুখে বলল, কোনো কাজে এসেছেন?

না কোনো কাজ নেই। যাচ্ছিলাম এদিক গিয়ে ভাবলাম…।

আমার শরীরটা ভাল না। এখন চলে যান।

বাসায় কেউ নেই?

না। মামা কোথায় যেন গেছেন। বাবু গেছে বকুলের শ্বশুর বাড়ি।

ও আচ্ছা। একা এক ভয় লাগছে না?

আমার এত ভয়টয় নেই।

একটা মজার খবর আছে মুনা। রহস্যভেদ হয়েছে। ভূতের কাছে মামদোবাজি। ফটাস করে হাড়ি ভেঙে ফেলেছি। অপেন মার্কেট পট ব্ৰেকিং হয়ে গেছে।

কি বকবক করছেন?

শুনলে লাফ দিয়ে উঠবে।

লাফ দিয়ে উঠার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এখন যান তো।

বেশিক্ষণ না এক মিনিট বসব।

বাকের ঘরে ঢুকে পড়ল। সহজ গলায় বলল, চা কর এক কাপ। চা খেয়ে জুত হয়ে বসে গল্পটা করি।

আপনি বড্ড বিরক্ত করেন বাকের ভাই।

বিরক্ত করব না। এক মিনিটের মামলা। তুমি নাটক দেখতে যাওনি।

যাইনি। সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। শুধু শুধু কথা বলা আপনার একটা বদ অভ্যাস।

তা ঠিক। নাটকে মিনিসটার সাহেব আসছেন জানো নাকি?

না জানি না। আসুক যার ইচ্ছা।

সিদ্দিক সাহেবের চাল। ব্যাটা ইলেকশন করবে। ফিল্ড করছে। বুঝলে মুনা? লোকজনদের খেলাচ্ছে।

খেলাক। আপনি চুপ করে বসুন। চা এনে দিচ্ছি খেয়ে বিদেয় হোন।

নাটক যদি দেখতে চাও নিয়ে যেতে পারি। ঘরে তালা দিয়ে চলে যাব। নো প্রবলেম।

কিচ্ছু দেখতে চাই না।

মুনা ভেতরে চলে গেল। বাকের সিগারেট বের করল। পকেটে দেয়াশলাই আছে। তবু সে রান্নাঘরে উঁকি দিল ম্যাচ আছে? সিগারেট ধরাতে পারছি না। মুনা নির্বিকার ভঙ্গিতে দেয়াশলাই এগিয়ে দিল।

কাজের একটা মেয়ে ছিল না? সেও নেই?

না। দেশের বাড়ি গেছে। আপনি এখানে বসছেন কেন? বসার ঘরে গিয়ে বসুন।

তুমি একা একা আছ!

বাকের ভাই, বসার ঘরে গিয়ে বসুন তো।

বাকের উঠে গেল।

মিনিস্টার সাহেব চলে এসেছেন। অনেক মাইকিং-টাইক লাগানো হয়েছে। এখান থেকেও পরিষ্কার শুনা যাচ্ছে। সব মিনিস্টাররা এক ধরনের ভাষায় বক্তৃতা দেন। গলা উঠানামা করে এক ভঙ্গিতে। এক এক সরকারের মন্ত্রীদের এক এক ধরনের বক্তৃতা। শেখ মুজিবের মন্ত্রীরা আঙুল দেখিয়ে বক্তৃতা করতেন। রেসকোর্স ময়দানে মুজিবের ভাষণের নকল করতেন। এরশাদ সাহেবের মন্ত্রীরা সবাই খুব আল্লাহ ভক্ত। সবাই কোরান শরীফ থেকে উদ্ধৃতি দেন। তাদের বক্তৃতায় ইহকালের চেয়ে পরকালের কথা বেশি থাকে। বক্তৃতা শুনলে মনে হয় ওয়াজ করছেন।

বাকের শুনল মিনিস্টার সাহেব বলছেন–যুবকদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে। যুবকদের অনুসরণ করতে হবে রসুলুল্লাহর নির্দেশিত পথ। কারণ সেই পথেই ইহকাল ও পরকালের জন্যে

মুনা চা এনে সামনে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, বাকের ভাই, আমার শরীরটা ভাল না। চা খেয়ে আপনি চলে যান।

হয়েছে কি?

কি জানি কি! বমি বমি লাগছে।

নো প্রবলেম দু’টি এভোমিন ট্যাবলেট নিয়ে আসছি।

আপনাকে কিছু আনতে হবে না, প্লিজ।

বাকের চায়ে চুমুক দিল। মুনা তার সামনেই বসে আছে। চোখ ঈষৎ রক্তাভ। সন্ধ্যা বেলাতেই ঘন ঘন হাই তুলছে। কেমন কঠিন একটা ভঙ্গি তার চারদিকে। মেয়েরা এমন কঠিন হলে ভাল লাগে না।

রাত সাড়ে এগারটার দিকে শেষবারের মত চা খাবার জনো বাকের বের হল। ভাইয়ের বাসায় থাকার সময় তাকে এই কষ্টটা করতে হত না। শোবাব আগে এক কাপ চা খাওয়া যেত। এখন বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হয়। অস্বস্তিকর ব্যাপার। বিছানায় বসে চা খাওয়া আর দোকানের চেয়ারে বসে চা খাওয়া একটা বড় রকমের পার্থক্য আছে।

জলিল মিয়া তার সন্টল বন্ধ করে দিয়েছে। সাধারণত বারোটার দিকে বন্ধ হয়। আজ সকাল সকাল বন্ধ হল। বাকের এগিয়ে গেল মেইন রোডের দিকে। সেখানে হোটেল আকবরিয়া সারারাত খোলা থাকে।

বাকের ভাই। বাকের ভাই।

বাকের থমকে দাঁড়াল। জসীম লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে ব্যস্ত একটা ভঙ্গি। মনে হচ্ছে বেশ ফুর্তিতে আছে।

কি খবর জসীম?

জি খবর ভাল।

তোমাদের নাটক কেমন?

জসীম খানিকটা চুপসে গেল। নিচু গলায় বলল, ভাল হয়েছে।

ভাল হলেই ভাল। মিনিসটার এসেছিল নাকি?

হুঁ।

গুড, ভেরি গুড।

আমি আপনাকে খুঁজছিলাম বাকের ভাই। দু’বার আপনার ঘরে গিয়ে খুঁজে এসেছি

কি জন্যে?

জসীম ইতস্তত করতে লাগল। যেন কোন একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলতে চায়। কিন্তু সাহসে কুলুচ্ছে না। সে অকারণে কাশতে লাগল।

বলে ফেল কি ব্যাপার।

আপনি জোবেদ আলিকে কি বলেছেন?

বাকেরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আজ সন্ধ্যার কথা বলছ?

হুঁ।

তা দিয়ে তোমার কি? জোবেদ আলির সঙ্গে তোমার কি? জোবেদ আলি বেশ্যার দালাল। তুমি করা দোকানদারি। তাকে কি বললাম না বললাম তাতে তোমার গায়ে লাগছে কেন বুঝলাম না।

না। আমার কিছু না। সিদ্দিক সাহেবের কাছে ওরা গিয়েছিল। সিদ্দিক সাহেব আমাকে খবর দিয়ে আনলেন। আমাকে আর মাখনা ভাইকে। বললেন…

জসীম থেমে গেল। বাকের গভীর স্বরে বলল, কি বললেন?

বললেন আপনাকে সাবধান করে দিতে। ঝামেলা করলে অসুবিধা হবে।

কি অসুবিধা হবে?

জসীম চুপ করে রইল। বাকের কড়া গলায় বলল, তোমরা সিদিকের সঙ্গে গিয়ে জুটেছ?

তা না। উনি পাড়ার একটা মাথা।

কবে থেকে পাড়ার মাথা হল? কি, কথা বলছি না যে? গিয়ে বলবে তোমার পাড়ার মাথাকে, আমি তার মুখে পেচ্ছাব করে দেই।

জসীম রুমাল দিয়ে তার ঘাম মুছতে লাগল। বাকের বলল, কি বলতে পারবে না?

এটা কেমন করে বলি বাকের ভাই?

অসুবিধা কি? আমি যেমন বললাম। সে রকম বলবে। তোমাদের কাজই তো হচ্ছে একজনের কথা অন্যজনকে বলা।

আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

চা খেতে যাই। হোটেল আকবরিয়ায়। খাবে নাকি?

জি না।

না খেলে চলে যাও। সিদ্দিক সাহেবকে খবরটা দাও। মুখে পেচ্ছাবের কথাটা গুছিয়ে বলবে। ওটা বাদ দি ও না।

জসীম শুকনো মুখে চলে গেল। হোটেল আকবরিয়ার মালিক দিলদার মিয়া খুবই যত্ন করল। নিজে উঠে গিয়ে চা নিয়ে এল। বসল মুখোমুখি। দিলদার মিয়ার মুখে বসন্তের দাগ। চিবুকের কাছে এক গোছা কুৎসিত দাড়ি। তবু বাকেরের দিলদার মিয়ার সঙ্গে গল্প করতে বেশ লাগল। সে ঘরে ফিরল রাত একটায়। রাত দুটায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল। অভিযোগ গুরুতর। বেআইনি অস্ত্র রাখা। জনগণের ওপর জোর জবরদস্তি। সে ধরা পড়ল। গুণ্ডা আইনে। তার কাছে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই ছিল না। কিন্তু পরদিনের পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হল। তার সঙ্গে যে সব অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে তার ছবিও উঠল। একটি পিস্তল, দু’টি ন’ইঞ্চি ড্যাগার এবং তিনটি তাজা হাতবোমা।

বকুলের বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এক সপ্তাহ অনেক লম্বা সময় নয়। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে সে বৌ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘুমুতে যাচ্ছে একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে। মানুষটিও যেন তার সঙ্গে অনন্তকাল ধরেই ঘুমুচ্ছে! গায়ে ঘামের গন্ধ। সে বলে উঁচু গলায়। রেগে ওঠে অল্পতে। বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই সে বলল, পিঠটা একটু চুলকে দাও তো বকুল। কী অদ্ভুত কথা! ঘর ভর্তি মানুষজন। সে বসে আছে টানা বারান্দায়। লোকজন আসা-যাওয়া করছে এর মধ্যে পিঠ চুলকে দেবে কী? কিন্তু জহির শার্ট তুলে খালি গায়ে বসে আছে। অসহিষ্ণু গলায় বলল, আহ দেরি করছ কেন?

নতুন বৌকে কেউ এমন কড়া গলায় কিছু বলে। বকুলের চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে বহু কষ্টে পানি সামলাল এবং হাত রাখল জহিরের পিঠে। জহির বিরক্তমুখে বলল, এ রকম শান্তিনিকেতনি কায়দায় সুড়সুড়ি দিচ্ছ কেন? ভালমত চুলকাও।

কি বিশ্ৰী কথা বলার ভিঙ্গি। বিয়ের পর মানুষটিকে বকুলের মোটেও ভাল লাগছে না। দুপুরের পর থেকেই তার শুধু মনে হতে থাকে সন্ধ্যা এসে পড়ছে। এক সময় সন্ধ্যা মিলাবে এবং জহির সবার সামনেই দরজা বন্ধ করে ঝাপটা-ঝাপটি করতে করতে বলবে তুমি এমন মাছের মতো পড়ে থাক কেন? তোমার অসুবিধাটা কি? বকুল শুধু মনে মনে বলবে, আহ আজকের রাতটা পার হোক। এক সময় সেই রাত পার হয়। কিন্তু আবার নতুন একটি রাত আসতে শুরু করে। একটি বিবাহিত মেয়ের জীবন মানেই কী একের পর এক গ্লানিময় ক্লান্তির দীর্ঘ রজনী?

কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কাকে করবে? টিনা ভাবী নেই। তাকে চিঠি লেখা যায়। কিন্তু চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে না। ইদানীং তার বারবার মনে হয় সবাই ইচ্ছা করে তাকে জলে ফেলে দিয়েছে। সবাই জানত তার এই অবস্থা হবে কিন্তু কেউ তাকে বলেনি।

বিশাল এই বাড়িতে তার শুধু হাঁফ ধরে। প্রায়ই মনে হয় নিঃশ্বাস নেবার মতো বাতাস নেই কোথাও। অথচ কি খোলামেলা বাড়ি। তাদের শোবার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে দিলে বাতাসে বিছানার চাদর সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। টানা বারান্দা এত প্রশস্ত যে নেট টানিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা যায়।

একতলার বেশির ভাগ ঘরই তালাবদ্ধ। থাকার লোক নেই ব্যবহার হয় না। তার শাশুড়ি প্রথম দিনেই সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। সারাক্ষণই কথা বললেন–

এই যে দেখ মা। পাশাপাশি দুই ঘর। তোমার শ্বশুর বলতেন অতিথি ঘর। অতিথি এলে থাকবে। কত বড় ঘর দেখলে? ইচ্ছা করলে বাইজী নাচানো যায়। তোমার শ্বশুর সাহেবের মাথাটা ছিল খারাপ। টাকা-পয়সা যা ছিল সব ঢেলেছ এই বাড়িতে। তা না করে যদি জমিজমা করত তাহলে আজ তোমরা পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে পারত। বুঝলে মা এই বংশই হচ্ছে পাগলের। আমার ছেলেও পাগল। এখন বুঝতে পারছ না, কয়েক’দিন যাক বুঝবে। এই যে দেখ এটা দেখ। লাইব্রেরি ঘর। রাজ্যের বই আছে এখানে। পোকায় কেটে সব শেষ করেছে। একটা বই আস্ত নেই। বই পড়ার অভ্যাস আছে? থাকলে আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে যেও। তবে মা রাতের বেলা একা একা এ ঘরে আসবে না। সবাই বলে কী সব নাকি দেখে। আমি নিজে কোনোদিন দেখি নাই। তোমার শ্বশুর সাহেবকে নাকি দেখে ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়ছে। যত বানানো কথা। শুনলে রাগে গা জ্বলে যায়।

জহির নিজেও বাড়ি প্রসঙ্গে অনেক কথাটথা বলল। বকুলকে খানিক ঘুরিয়ে দেখাল, ছাদে নিয়ে গেল। হৃষ্টচিত্তে বলল, বাড়ি কেমন দেখলে?

ভাল।

একুশটা ঘর আছে। অথচ দু’টা মাত্র বাথরুম, তাও একতলায়। বাবার একটা নেশাই ছিল ঘর বানানো। কি করে রুমের সংখ্যা বাড়ানো যায়। অথচ মানুষ মাত্র তিনজন।

এ রকম অদ্ভুত সখা হল কেন? কে জানে কেন। গৌরীপুরের মহারাজার বাড়ি দেখে বোধ হয় এই নেশা চেপেছিল। লোকজনের বাড়ির সামনে পেছনে খোলা জায়গা-টায়গা থাকে, বাগান-টাগান করে। এইসব কিছু নেই। সবটা জায়গা জুড়ে বাড়ি। কিছুদিন পর এটা হবে ভূতের বাড়ি। কেউ থাকবে না।

বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, মা আমাকে লাইব্রেরি ঘরে একা একা যেতে নিষেধ করেছেন। জহির বিরক্তমুখ বলল, যত ফালতু ব্যাপার। যেখানে যেতে ইচ্ছা হয় যাবে। ভূত-প্রেতি গল্পের বই ছাড়া অন্য কোথাও নেই। তুমি আবার ভূত বিশ্বাস কর না তো?

অল্প অল্প করি।

এখন থেকে আর করবে না। তবে শোন, রাতের বেলা বাথরুমে যেতে হলে আমাকে ডেকে তুলবে। একা একা যাবার দরকার নেই। আমি দোতলায় বাথরুমের ব্যবস্থা করছি। কালই রাজমিস্ত্রী লাগাব!

সত্যি সত্যি ভোর হতেই রাজমিস্ত্রী চলে এল। বকুলের শাশুড়ি মুখ কালো করে ফেললেন। এত টাকা খরচ করে বাথরুম বানানোর তার কোনো ইচ্ছা নেই। দিন তো চলে যাচ্ছে। ওদের দোতলায় অসুবিধা হলে একতলায় চলে এলেই পারে। ঘর তো সব খালিই পড়ে থাকে।

মা এবং পুত্রের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই হয়ে গেল। এ জাতীয় লড়াই বকুল আগে দেখেনি। সে কী করবে। বুঝতে পারল না। শাশুড়ি তার ঘরে শুয়ে কাঁদছেন। জহির চায়ের কাপ হাতে রাজমিস্ত্রীদের কাজের তদারক করছে হাসিমুখে। বকুল শুকনো মুখে একবার যাচ্ছে শাশুড়ির কাছে একবার আসছে জহিরের কাছে।

বাড়িতে আর লোকজন বলতে দু’টি কাজের মেয়ে এবং শমসের নামের একজন গোমস্তা ধরনের মানুষ। যার একমাত্র কাজ হচ্ছে বাজার করে এনে রোদে পিঠ মেলে বসে থাকা। বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন যা এসেছিল তারা এক’দিন পরই বিদেয় হয়েছে। বকুলের শাশুড়ির তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার কারণ হচ্ছে বিয়েতে দেয়া উপহার।

তিনি বকুলের চাচি শাশুড়িকে সবার সামনেই বললেন, দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ছেলে আমার। তার বৌয়ের জন্যে যে শাড়ি আনলেন সেই শাড়ি তো আমার কাজের মেয়েও পরে না। আমার একটা ইজ্জত নেই। ছেলের বৌয়ের কাছে আমার মুখ ছোট হল না? আপনি দুমেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এদের প্রত্যেকের বিয়েতে আমি সোনা দিয়েছি। দেইনি? আমার ছেলে কী নদীর পানিতে ভেসে এসেছে?

কঠিন কঠিন কথা খুব সহজ মুখে বলে যাচ্ছেন। রোগা ফর্সা ও সুন্দর মহিলাটি কাঁদতে লাগলেন। কী অস্বস্তিকর অবস্থা।

পাঁচ দিনের মাথায় বাবু এসে উপস্থিত। একা একা চলে এসেছে। হাতে নতুন কেনা সুটকেস। বকুলের বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিস্ময় এবং আনন্দ। তার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে বাবুকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ খুব কাঁদে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। শাশুড়ি বাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। জহির দোতলা থেকে নেমে এসেছে।

বাবুর শোবার জায়গা হল একতলায়। বকুল অবাক হয়ে লক্ষ্য করল বাবুর ঘর গোছগাছ করে দেবার জন্যে জহির নিজেই উদ্যোগী হয়েছে। বকুল এটা ঠিক আশা করেনি। তার কেন জানি মনে হচ্ছিল জহিরের এখন আর তার বা তার পরিবারের কারোর প্রতি কোন আগ্রহ নেই। রাতের বেলা বকুলকে খানিকক্ষণ কাছে পেলেই তার হবে। সমস্ত ভালবাসাবাসি রাতের খানিকক্ষণ সময়ের জন্যে। সে ভেবে পাচ্ছে না। এই ব্যাপারটি শুধু কী তার ক্ষেত্রেই সত্যি না পৃথিবীর সব মেয়েদের বেলাতেও সত্যি।

বকুলের আনন্দের সীমা রইল না। যখন জহির বলল, তুমি বরং আজ তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমাও। বকুল তাকিয়ে রইল। জহির বলল, বেচারা একা একা ভয়টয় পেতে পারে। তাছাড়া তোমার নিজেরও ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে নিশ্চয়ই। রাত জেগে গল্প কর।

আনন্দে বকুলের চোখে পানি এসে গেল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে এমন কিছু বলতে যাতে জহির খুব খুশি হয়। কিন্তু তেমন কোনো কথা তার মনে আসছে না। সে শুধু বলল, তোমার অসুবিধা হবে না তো?

অসুবিধা? অসুবিধা হবে কেন?

ঠিকই তো তার অসুবিধা হবে কেন। বকুল কথাটা বলেছে খুব বোকার মতো। জহির বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়? বাবুকে এখানে রেখে দেয়া যায় না?

এখানে রেখে দেব?

হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে থাকবে। পড়াশোনা করবে। বিরাট বাড়ি খালি পড়ে আছে। তাছাড়া ও থাকলে তোমার একজন সঙ্গী হবে।

সত্যি বলছ?

সত্যি বলছ মানে?

না মানে তুমি চাও ও এখানে থাকুক?

না চাইলে শুধু শুধু বলব কেন? চাই বলেই তো বলছি। তাছাড়া আমি যখন এখানে থাকব না তুমি তখন খুবই লোনলি হয়ে পড়বে।

বকুল অবাক হয়ে বলল, তুমি এখানে থাকবে না। মানে? মা যে বলল, তুমি এখানেই থাকবে।

আমি কি এই মফস্বলে পড়ে থাকব নাকি? কি যে তুমি বল। ঢাকা ছাড়া আমি থাকতে পারি না।

তুমি ঢাকা থাকলে আমিও ঢাকা থাকব।

জহির নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, পাগল হয়েছ। মা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তোমার এখানেই থাকতে হবে।

কেন?

এই শর্তেই মা তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে মত দিয়েছেন।

বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জহির হাসতে হাসতে বলল, মা বড় কঠিন জিনিস। যত দিন যাবে ততই বুঝবে। তুমি শোবার আগে এক জগ পানি এবং একটা গ্লাস দিয়ে যাবে। জহির ঘুমুবার আয়োজন করল।

রাতে বাবুর সঙ্গে তেমন কোন কথাবার্তা হল না। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তাছাড়া এমনিতেও তার বোধ হয় কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে ঘাড় বাকিয়ে বলল, এই ঘরে ঘুমাতে হবে না।

বকুল বলল, ঘুমালে কি অসুবিধা?

বাবু তার জবাবে মুখ অন্ধকার করে বসে রইল।

বাসার খবর কি?

একবার তো বললাম। বাসার খবর।

মুনা আপা কোন চিঠি দেয়নি?

না দেয়নি। দিলে তো তোমার কাছেই দিতাম। লুকিয়ে রাখতাম নাকি?

চিঠি দিল না কেন?

আমি কী জানি কেন দেয়নি।

বকুল ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কথা বোধ হয় সবাই ভুলেটুলে গেছে। বাবু চুপ করে রইল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে বকুলের এই কথা সমর্থন করছে। বকুল বলল, তোর মাথাব্যথা এখনো হয়?

হয়।

এখন হচ্ছে?

না।

হলে বলিস। তোর দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ওষুধ এনে দেব।

আমার কোন অষুধ-টষুদ লাগবে না।

বাবু চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলল। বকুল নরম গলায় বলল, তুই আমার সঙ্গে কথা বল বাবু। এর রকম করছিস কেন? তুই এসেছিস আমার এত ভাল লাগছে।

বাবু মুখের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেলল। বকুল হঠাৎ বলে ফেলল, আমি এখানে খুব কষ্টে আছি রে বাবু। আমার কিছু ভাল লাগে না; মরে যেতে ইচ্ছা করে।

কেন?

তাও জানি না।

বিয়ে করার জন্যে তুমি তো পাগল হয়েছিলে।

বকুল চুপ করে রইল। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম এল না। একবার ইচ্ছে করল জহিরের কাছে ফিরে যেতে। এই ইচেছটা কেন হল তাও সে ঠিক ধরতে পারল না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন সব চিন্তা-ভাবনা আসছে মাথায়। বাইরে কাক ডাকছে। কাকের ডাকের সঙ্গে নানান রকম পাখ-পাখালির ডাকও কানে আসছে। ভোর হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। ঘুমহীন রাত একটি কেটে গেল। তার কেন যেন মনে হল এ রকম নিদ্রাহীন রজনী আরো অনেক আসবে তার জীবনে। সে খানিকক্ষণ কাঁদল। এই কান্নাও কেমন অন্য রকম। আগে কাঁদলে মন হালকা হয়ে যেত। ভাল লাগত। এখন লাগছে না। মন ভারী হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে কি মানুষকে এমন ভাবে বদলে দেয়?

টিনা ভাবী বিয়ে নিয়ে কত গল্প করেছে। এ রকমও যে হয় তা তো কখনো বলেনি। এটি সে লুকিয়ে রাখল কেন? নাকি সবার জীবনে এ রকম হয় না? বেছে বেছে বকুলদের মতো মেয়েদের বেলাতেই এ রকম হয়? বকুলের ধারণা হল সে নিশ্চয়ই খুব খারাপ মেয়ে। খারাপ মেয়েদের এ রকম শাস্তি হয়। হওয়াই উচিত।

ভোরবেলা এক কাণ্ড হল। জহির এসে বলল, এই বাবু ঘোড়ায় চড়বে?

বাবু অবাক হয়ে বলল, ঘোড়া পাবেন কোথায়?

কোথায় পাব সেটা আমি দেখব। তুমি চড়বে কি না বল?

না নড়ব না।

দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমরা ছোটবেলায় চড়তাম। একটা বেতো ঘোড়া আছে। নড়েচড়ে না।

বাবু হাসিমুখে বলল, আপনার ছোটবেলার ঘোড়া সেটা কি আর এখনো আছে? মরে ভূত হয়ে গেছে।

তাও তো কথা। দাঁড়াও খোঁজ নিয়ে দেখি। এসব জায়গায় ঘোড়া পাওয়া যায়। শীতের সময় ঘোড়ার পিঠে করে ভাটী অঞ্চলে মাল যায়। আধমরা ঘোড়া। চড়তে খুব আরাম। লাফ-বাপ নেই।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *