গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)-আহমদ ছফা

গাভী বিত্তান্ত

মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করার লােকের অভাব নেই। সম্প্রতি তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ পেয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভায় একজন প্রবীণ শিক্ষক রসিকতা করে তাঁকে ওরাং ওটাঙের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

দিলরুবা খানম তাকে হরদম দরজির দোকানের ডামি বলে সকলের কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। বুড়াে বুড়াে শিক্ষকেরা তাঁর নামে ওটা কেন বলে বেড়ান, বিলকুল তিনি বুঝতে পারেন।

তার মতাে শিক্ষক সমাজের একজন অপাংক্তেয় মানুষ ভাগ্যের কৃপায় তাদের নাকের ডগার ওপর দিয়ে উপাচার্যের আসন দখল করে বসলেন, তাঁদের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ। এই কারণেই তাদের সকলের নখ দাঁত গজিয়েছে।

মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ যতই বােকা হয়ে থাকুক না ওই ব্যাপারটা বুঝার মতাে বুদ্ধি তাঁর আছে। কিন্তু দিলরুবা খানম কেন সর্বক্ষণ তার নামে নিন্দের গীত গেয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি তার কোনাে কারণ খুঁজে পান না। বলতে গেলে দিলরুবা খানমই তাে তাকে হাত ধরে উপাচার্যের আসনটিতে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। 

মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ ভাবতে চেষ্টা করেন, এর হেতুটা কী হতে পারে? নারীর মনের গহন রহস্য আবু জুনায়েদের মত ভোঁতা মানুষের বুঝার কথা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নুরুন্নাহার বানুর পৌনঃপুনিক খোচা খেয়ে একটা বিষয় তার মনে আনাগােনা করে। দিলরুবা খানম কি তার প্রেমে পড়েছিলেন? প্রেমে না পড়লে, বলতে গেলে এটা একটি জেহাদ পরিচালনা করে তাঁকে উপাচার্যের চেয়ারে বসালেন কেন? যতই বিষয়টা গভীরভাবে চিন্তা করেন, তিনি একটা ধাধায় পড়ে যান।

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

দিলরুবা খানম তাকে এই যে এতদূর টেনে নিয়ে এলেন, তার পেছনে বিশুদ্ধ অনুরাগ ছাড়া আর কী স্বার্থ থাকতে পারে? মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ ভাবতে চেষ্টা করেন কোনাে কারণে দিলরুবা খানমের কোনাে দুর্বল জায়গায় তিনি আঘাত করে বসেছেন। তাই তিনি সকাল বিকেল তাঁর বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই বলে বেড়াচ্ছেন । মানুষের মনের ভেতর কত রকম অলিগলি থাকতে পারে চিন্তা করে আবু জুনায়েদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। নুরুন্নাহার বানু যদি ক্রমাগতভাবে দিলরুবা খানমের নাম 

করে তাকে খোঁচা না দিতেন এদিকটা চিন্তা করে দেখার ফুরসতও তার হত না ।। 

আবু জুনায়েদ টাইয়ের নট বাধা শেষ করেন। জুতাে পরতে গিয়ে দেখা গেল মােজা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করলেন, পাওয়া গেল না। ছােকরা চাকরটিকে ডেকে আচ্ছা করে ধমকে দিলেন। নুরুন্নাহার বানুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখাে না মােজা জোড়া কোথায়? এদিকে আমার মিটিং শুরু হয়ে গেছে। নুরুন্নাহার বানু আঙুলে শাড়ির কোণা জড়াতে জড়াতে বললেন, 

-তুমি আমার বাবার চাকর। তােমার আমার কাজ করে নেয়ার কথা, আমি কেন তােমার কাজ করব? 

-কী বললে, আবু জুনায়েদ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। 

-তােমার বাবার কাছে চলে যাও। যে টাকার খোটা প্রতিদিন দিয়ে যাচ্ছাে আমি সুদে আসলে শােধ করে দেব। তারপর মােজা না পরেই আবু জুনায়েদ জুবােয় খালি পা গলিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন । 

আবু জুনায়েদ চলে যাওয়ার পর নুরুন্নাহার বানু জগটা টেনে নিয়ে সবটা পানি ঢক ঢক করে পান করে ফেললেন। মিনমিনে স্বভাবের আবু জুনায়েদ কখনাে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানতেন না। সেই মানুষটি কত প্রচণ্ড হতে পারেন তার প্রমাণ নুরুন্নাহার বানু হাতেনাতে পেয়ে গেলেন। তার সারা শরীর জ্বালা করছিল।

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

তিনি চিৎকার করে উঠতে চাইলেন। পারলেন না, কে যেন কণ্ঠস্বর চেপে ধরল। পরম বেদনায় তিনি অনুভব করলেন, তার প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে আসছে। উপাচার্যের চাকরি, এই সুদৃশ্য অট্টালিকা, গণ্ডায় গণ্ডায় লােকজন সাজসজ্জা সবকিছুকে তার অভিশাপ দিতে ইচ্ছে হল । 

উপাচার্যের চাকরি করতে গিয়ে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ প্রতিদিন টের পাচ্ছিলেন তাঁর ভেতরে অবিরাম ভাঙচুর চলছে। আগামী দিনে কী ঘটবে সে কথা বাদ দিন, একঘণ্টা পরে কী ঘটবে, সেটাও অনুমান করার উপায় নেই। আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার পরে অর্থনীতি বিভাগের একজন ছাত্র খুন হয়েছে ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুটি ছাত্রদলই দাবি করেছে নিহত ছাত্রটি তাদের দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন । দু দলই উপাচার্য ভবনের সামনে এসে মিছিল করেছে, শ্লোগান দিয়েছে । দু দলই উচ্চ চিৎকারে দাবি করেছে জহিরুল হক কেন খুন হল, সে জবাব আবু জুনায়েদকেই দিতে হবে। দু দলই চরম উত্তেজনার সঙ্গে জহিরুল হকের খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। নিহত ছাত্রের লাশটিও কারা দখল করবে তাই নিয়ে দু দলের মধ্যে যে তােড়জোড় চলছিল, অনায়াসে আরাে এক ডজন ছাত্র খুন হতে পারত।

সময়মতাে পুলিশ এসে হস্তক্ষেপ করেছিল, তাই রক্ষে । নিহত ছাত্রটির গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়া । সংবাদ পেয়ে মা-বাবা দুজনেই ছুটে এসেছিলেন। গ্রামের কৃষক আবু জুনায়েদকে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুত্র শােকাতুর মা বাবার বুকফাটা ক্রন্দন শুনতে হয়েছে। একেবারে দাঁড়িয়ে থেকে ছাত্রটির লাশ বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অনবধানতাবশত কোনাে একদল যদি লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যেত তাহলে সেই লাশ কাঁধে নিয়ে শহরে মিছিল করার সুযােগ পেলে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল না ; যার ফলে গােটা দেশে খুন এবং পাল্টা খুনের একটা উৎসব লেগে যেত।

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

ব্যাপারটি যদি এতটুকুতে চুকেবুকে যেত তাহলেও কথা ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং ডেকে নিয়ে ধমক দিয়েছেন, সরকারি ছাত্রদলটির সমর্থক শহীদ ছাত্রটির খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিনি কেন তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিচ্ছেন না। আবার বিরােধী দলের একজন নেতা টেলিফোন করে শাসিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সমর্থক সুবােধ ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদে লেখাপড়া করতে পারছে না।

সরকার তাদের অহ হয়রানি করার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে এবং আৰু জুনায়েদ সরকারকে সাহায্য করে যাচ্ছেন, একথাটি যেন মনে থাকে। সব সময় দিন একরকম থাকবে না । কেন্টিনে চালের সঙ্গে বেশি কাকড় পাওয়া গেছে। ছাত্রেরা ভাতের থালাসহ দল বেঁধে মিছিল করে উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করে একেবারে ডাইনিং রুমে চলে এসেছে।

তখন আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু এবং একজন মেহমান দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন। দারােয়ান, কেয়ারটেকার কারাে বাধা ছাত্রদের ঠেকাতে পারেনি। 

একজন ছাত্র ভাতের থালাটি ডাইনিং টেবিলে উপুর করে দিয়ে শ্লোগান দিয়ে উঠল, ‘ভাতের সঙ্গে কাঁকড় কেন আৰু জুনায়েদ জবাব চাই’। যে সকল ছাত্র ভেতরে প্রবেশ না করে বাইরে ভিড় করেছিল তারাও সকলে মিলে শ্লোগান দিতে থাকল ‘আবু জুনায়েদের চামড়া, তুলে নেব আমরা’।

ছাত্রদের হাতে আবু জুনায়েদের লাঞ্ছনা এবং ভােগান্তি দেখে নুরুন্নাহার বানুর হাততালি দিয়ে খলখল করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে। কোন্ বাপের মেয়েকে অপমান করেছে, আবু জুনায়েদ! আল্লাহ কি নেই? 

একদিন মহিলা হােস্টেলের পাশের ট্রান্সফরমারটি বিকট একটা শব্দ করে জানিয়ে দিল যে বেটা আত্মহত্যা করেছে। এই অকালপ্রয়াত ট্রান্সফর্মার মহিলা হােস্টেলের ছাত্রীদের একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে ছুড়ে দিল। দুদিন ধরে হােস্টেলে কোনাে পানি নেই।

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

মেয়েদের গােসল, টয়লেট সব একরকম বন্ধ । বাইরে থেকে বালতি বালতি পানি আনিয়ে এক বেলার নাস্তা এবং রান্না কোনাে রকমে সারা হয়েছে। মেয়েরা প্রথমে হাউজ টিউটর, তারপর প্রভােস্টের কাছে নালিশ করল। কোনাে ফল হল না দেখে সকলে তােয়ালে কাধে জড়িয়ে সাত পাঁচশাে মেয়ে একযােগে উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও করে বসল। প্রমিলা বাহিনীকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা দারােয়ানের কী করে হবে। তাদের একদল উপাচার্য ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে বাথরুমের বেসিন কমােড় এগুলাে ভাঙচুর করতে থাকল । আবু জুনায়েদের কিছুই করার ছিল না।

তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রলয়কাণ্ড দেখলেন। নুরুন্নাহার বানু ফস করে একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। এই মন্তব্য শুনে একটি মােটা উচু ষণ্ডামার্কা মেয়ে তার পরনের শাড়ির অর্ধেক টেনে ছিড়ে ফেলেছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই মেয়েরা যেমন পঙ্গপালের মতাে ঝাঁক বেঁধে এসেছিল, তেমনি আঁক বেঁধে চলে গেল । চলে যাবার সময়ে একটি বব কাটিং চুলের মেয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে আবু জুনায়েদের মস্তক তাক করে উঁচিয়ে ধরে বলল 

-চাদু যেন মনে থাকে, কত ধানে কত চাল। গাঁইগুই করলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব । 

হােস্টেলের মেয়েরা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর নুরুন্নাহার বানু সিঁড়ির ওপর বসে সমস্ত জীবন ধরে যে সমস্ত গালাগাল মুখস্থ করে রেখেছিলেন, একে একে মেয়েদের উদ্দেশ্যে ঝাড়তে লাগলেন-খানকি মাগি, বেশ্যা, ছেনাল-হায়েজ নেফাসের পয়দায়েস আরাে কতাে কী মনে মনে সন্ধান করতে লাগলেন আরাে শক্তিশালী গালাগাল আছে কি না। সে রকম কোনাে কিছু না পেয়ে আবু জুনায়েদকে নিয়ে লাগলেন। তাঁর দিকে রােষ কষায়িত মেনে তাকিয়ে বলতে লাগলেন। 

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

-তােমার মতাে একটা ছাগলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বলে এই ছেনাল মাগীদের হাতে আমাকে নাকাল হতে হল সমপ্রতি পত্রপত্রিকায় নতত্ত্ব বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে জোর লেখালেখি চলছে। ভদ্রলােক ছাত্রছাত্রীদের কাছে টাকা নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রয়ের ব্যবসাটি নিরাপদে এতদিন চালিয়ে আসছিলেন। অল্প কদিন আগে সেটি ধরা পড়েছে। বিভাগের সমস্ত শিক্ষক এবং ছাত্রেরা অকাট্য প্রমাণসহ উপাচার্যের কাছে দাবি জানিয়েছেন, এই ভদ্রলােক যদি এই বিভাগে বহাল থাকেন শিক্ষকেরা ক্লাশ নেবেন না এবং ছাত্রেরাও শিক্ষকদের সঙ্গে সহযােগিতা করবেন।

মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ ও মনে মনে স্বীকার করেন, আবদুর রহমানের চাকরিটি থাকা উচিত নয় । কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার হল আবদুর হলেন উপাচার্যের নিজের দলের লােক। দলের কেউ চাইবেন না, আবদুর রহমানের চাকরিটি চলে যাক। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে আবদুর রহমানকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু উপাচার্যের ইচ্ছেই তাে সব না, সিনেট আছে, সিন্ডিকেট আছে। সেখানে ব্যাপারটা ফয়সালা করতে হবে ।

সিনেট সিন্ডিকেটে আবদুর রহমান দলে ভারি। সুতরাং, আবদুর রহমানের অপরাধ কবুল করেও তিনি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন না। আবদুর রহমানকে বরখাস্ত করলে তার দলটি কানা হয়ে যাবে । দল না থাকলে আবু জুনায়েদাকেও কানা হয়ে যেতে হবে। 

সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের ছেলেমেয়েরা সদলবলে মিছিল করে এসে উপাচার্যের • দপ্তরের দরজা জানালা ভাঙচুর করেছে। তাদের দাবি ছিল একটিই কেন তাদের পরীক্ষার তারিখ বারবার পিছানাে হচ্ছে। ভাঙা দরজা জানালা নতুন করে মেরামত করার পর সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা তাদের পরীক্ষা পেছানাের দাবিতে মেরামত করা দরজা জানালা আবার নতুন করে ভেঙে দিয়ে গেছে। 

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের বেতন এবং ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে একটানা সাত দিন কর্মবিরতি পালন করেছেন। তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সপ্তাহব্যাপী কর্ম বিরতির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসারেরা পাঁচ দিনের কর্ম বিরতির ঘােষণা করেছেন।

তাদেরও বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা প্রয়ােজন। অফিসারদের কর্মবিরতির পর শিক্ষকেরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকে বসলেন। তাদের দাবি বেতন ভাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক দূর প্রসারিত। বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সের সমস্ত দাবি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।

এ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসরদের এসােসিয়েট প্রফেসর করতে হবে এবং এসােসিয়েট প্রফেসরদের প্রফেসর। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদও স্বীকার করেন এগুলাে শিক্ষকদের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি । কিন্তু দুঃখের কথা হল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে কোনাে বাড়তি টাকা নেই। বাজেটের বরাদ্দ সমস্ত অর্থ ব্যয় করা হয়ে গেছে। শিক্ষকেরা আড়াই মাস গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালেন। আর তাঁদের মধ্যে যারা সত্যিকার করিল্কর্মা চুটিয়ে কনসালটেন্সি ব্যবসা চালালেন। 

অবশেষে একদিন শিক্ষকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ক্লাশে যােগ দিলেন। ঠিক সেই সময়ে দুই প্রধান ছাত্র সংগঠনের মধ্যে একটা সম্মুখ সমর বেঁধে গেল। মারা গেছে আটজন এবং আহত হয়েছে একশাে জনেরও বেশি।

যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সকলেই নির্দলীয় ছাত্র। প্রাণ দেয়া প্রাণ নেয়ার নেশা দু দলের বীর পুরুষদের এমনভাবে পেয়ে বসল তিনদিন ধরে গােটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কুরুক্ষেত্রের আকার ধারণ করল । কাটা রাইফেল ও মেশিনগান অবাধে ব্যবহার হতে লাগল।

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

বােমাবাজির শব্দে কানপাতা দায় হয়ে দাঁড়াল। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে সিন্ডিকেট ডেকে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হল । 

বিশ্ববিদ্যালয় যখন একেবারে বন্ধ হয়ে যায় তখন আবু জুনায়েদের খুব খালি খালি লাগে। নানা উত্তেজনার মধ্যে সময় কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন । চাপের মধ্যে থাকার একটা মজা হল, নিজেকে কিছুই করতে হয় না, ঘটনা জন্ম দিয়ে চলে এবং ঘটনা স্রোতই সবকিছুকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এ রকম সময় এলে মনটা কাঁচা বাজারে যাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করতে থাকে। হায়রে সেদিন কি আর আছে? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে কত কবি বাস করেন সঠিক সংখ্যাটি নিরূপণ করা হয়নি। দুশােও হতে পারে আবার তিনশােও হতে পারে। ফুল টাইম পার্ট টাইম মিলিয়ে যত লােক লেখেন, প্রথম প্রেমে পড়ার উত্তাপ ছন্দোবদ্ধ অথবা গদ্য কবিতায় প্রকাশ করেন, সব মিলিয়ে হিসেব করলে হাজারখানেক দাড়িয়ে যেতে পারে। তিরিশ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র এক হাজার কবি, সংখ্যাটা কিছুতেই অধিক বলা যাবে না। বাঙালি মাত্রেই তাে কবি ।

এমনকি বাংলার দোয়েল, শ্যামা, কোকিল ইত্যাকার বিহঙ্গ কুলের মধ্যে কবিত্বের লক্ষণ অত্যধিক মাত্রায় পরিস্ফুট। বিহঙ্গ সমাজের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ কোনাে বর্ণমালার চল নেই বলেই ওদের কবিত্ব শক্তির প্রতি আমরা উদাসীন। | বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে স্থায়ীভাবে যারা কবিতা রচনার কাজে নিবেদিত রয়েছেন তরুণে প্রবীণে মিলিয়ে তাদের সংখ্যা গােটা তিরিশেক দাঁড়াতে পারে।

মােটে তিরিশ জন, ফুলটাইম কবি তাদের মধ্যে মত ও পথের এত ফারাক যে খুব সূক্ষ্মভাবে হিসেব করলে একত্রিশটি উপদলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করা অসম্ভব হবে না। কবিদের কেউ কেউ বলেন কবিতাকে হতে হবে সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার। আরেক দল বলেন কবিতায় বিপ্লব টিপ্লবের কথা বলা এক ধরনের অশ্লীলতা।

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৫)

কবিতাকে পরিশুদ্ধ কবিতা হতে হলে অবশ্যই প্রেম থাকতে হবে। আরেকটি উপদল মনে করে প্রেম আবার কী? প্রেম কাকে বলে? মেনি বিড়লের সঙ্গীনি খোঁজার চিৎকার যাকে ভদ্র ভাষায় প্রেম বলা হয়, ওই জিনিস কি তাের বিষয়বস্তু হতে পারে? এই রকম কত আছে।

কেউ বলে ছন্দ দিয়ে কবিতা লেখা হয়, কেউ বলে ভাবই কবিতার আসল প্রাণবস্তু । আরেক দল বুকে তাল ঠুকে প্রকাশ করতে কসুর করে না ভাষাই কবিতার সবকিছু। এই ধরনের যত প্রকারের মতভেদ আছে সেগুলাের কোনদিন নিরসন হবে, কবিরাও তা আশা করেন না। ডিম্ব আগে না বাচ্চা আগে এই বিতর্ক চলতে থাকবে। 

সূক্ষ্ম ভেদ, উপভেদ এগুলাে আপনিই লুপ্ত হয়ে যায়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বি কবি গােষ্ঠী সুযােগ-সুবিধের প্রশ্নে একে অপরের প্রতিস্পর্ধী হয়ে দাঁড়ায়। একদল বাংলা একাডেমীর মাঠে কবিতা পড়লে, আরেক দল শিল্পকলা একাডেমীর মিলনায়তনে এসে জড়াে হন।

যেহেতু রাজনীতি সমাজের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তাই কবিদেরও রাজনৈতিক ছাতার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। বিরােধী দলীয় কবিদের সুবিধে একটু বেশি। কারণ দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারকে আক্রমণ করা সহজ এবং তা করে অনায়াসে পাঠক বাহবা লাভ করা যায় । বিরােধী দলের কবিরা যদি শ্লোগান উচ্চারণ করেন, প্রকৃত কবিতা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকিয়ে দিতে পারে । 

মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ কবিতার কিছুই বােঝেন না । তথাপি তাঁকে সরকার ঘেঁষা কবিদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হওয়ার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলার প্রবীণ অধ্যাপক সরকার ঘেঁষা কবিদের সংগঠনটির সভাপতি।

তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে আবু জুনায়েদের দল করে থাকেন। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদকসহ এসে ড. (কবি) মনিরুল আলম যখন ধরে বসলেন আবু জুনায়েদ না করতে পারলেন না। সভা-সমিতিতে কথা বলতে বলতে এককালীন মুখচোরা লাজুক মানুষ আবু জুনায়েদের জিটি ওই সময়ের মধ্যে অসম্ভব রকমের ধারালাে হয়ে উঠেছে।

 

Read more

গাভী বিত্তান্ত -পর্ব-(৬)-আহমদ ছফা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *