ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

ছায়াসঙ্গী-

এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। বাকি যে-কদিন গ্রামে ছিলাম সে কোনােদিন আমার কাছে আসেনি। লােক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি তবু আসেনি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না । 

কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলাগন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।শবযাত্রা পুরােপুরি নাস্তিক মানুষের সংখ্যা এই পৃথিবীতে খুবই কম। ঘাের নাস্তিক যে-মানুষ তাকেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খুব দুর্বল দেখা যায়। আমি একজন ঘাের নাস্তিককে চিনতাম, তার ঠোটে একবার একটা গ্রোথের মতাে হলাে। ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন ক্যানসার। সঙ্গে সঙ্গে সেই নাস্তিক পুরােপুরি আস্তিক হয়ে গেলেন। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্যে মসজিদে যান। মালিবাগের পীর সাহেবের মুরিদও হলেন। 

বায়ােপসির পর ধরা পড়ল যে গ্রোথের ধরন খারাপ নয়। লােকালাইজড গ্রোথ । ভয়ের কিছু নেই। অপারেশন করে ফেলে দিলেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলােক আবার নাস্তিক হয়ে পড়লেন। ভয়াবহ ধরনের নাস্তিক। অঙ্ক করে প্রমাণ করে দিলেন যে ঈশ্বর = 0° এবং আত্মা = 02 । 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

যাই হােক, মানুষের চরিত্রের এই দ্বৈত ভাব আমাকে বিস্মিত করে না। প্রচণ্ডরকম ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের মধ্যেও আমি অবিশ্বাসের বীজ দেখেছি। আমার কাছে এটাই স্বাভাবিক মনে হয়। এর বাইরে কিছু দেখা মানে অস্বাভাবিক কিছু দেখা। 

আমি এরকম একজন অস্বাভাবিক চরিত্রের কথা এই গল্পে বলব। চরিত্রের নাম মােতালেব (কাল্পনিক নাম)। বয়স পঞ্চাশ থেকে পাঁচপঞ্চাশ। ভীষণ রােগা এবং প্রায় তালগাছের মতাে লম্বা একজন মানুষ। চেইন স্মােকার। মাথায় কিছু অসুবিধা আছে বলেও মনে হয়। নিতান্ত অপরিচিত লােককেও এই দ্রলােক শীতল গলায় বলে ফেলতে পারেন— ভাই কিছু মনে করবেন না । আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি একজন মহামূখ। 

মােতালেব সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় এক বিয়েবাড়িতে। সেদিন ঐ বিয়েবাড়িতে কী-একটা সমস্যা হয়েছে— কাজি পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা এইজাতীয় কিছু। 

 বরপক্ষীয় এবং কনেপক্ষীয় লােকজন বিমর্ষ মুখে ছােট ছােট গ্রুপে ভাগ হয়ে গল্প করছে। আমি একটা দলের সঙ্গে জুটে গেলাম। সেখানে জনৈক অধ্যাপক বিগ ব্যাং এবং এক্সপানডিং ইউনিভার্স সম্পর্কে কথা বলছেন। শ্রোতারা চোখ বড় বড় করে শুনছে। ভদ্রলােক ব্ল্যাক হােল সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছেন, তখন একটা নাটকীয় ব্যাপার ঘটল। রােগা এবং লম্বা একজন শুকনাে মানুষ বললেন, ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনি একজন মহামূখ। 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

অধ্যাপক দ্রলােক নিজেকে সামলাতে কিছু সময় নিলেন। পুরােপুরি সামলাতে পারলেন না— কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কী আমাকে মহামূর্খ বললেন ? 

জী।। ‘কেন বললেন জানতে পারি ? 

‘অবশ্যই জানতে পারেন। আপনি আপনার বক্তৃতা শুরুই করেছেন ভুল তথ্য দিয়ে বলছেন ব্যাকগ্রাউণ্ড রেডিয়েশন ধরা পড়েছে ইনফ্রারেডে । তা পড়েনি। ধরা পড়েছে মাইক্রোওয়েভে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির একটি স্বীকার্যই হচ্ছে স্পেস এবং টাইমের জন্ম বিগ ব্যাং সিংগুলারিটিতে। আপনি বললেন ভিন্ন কথা। কোনােকিছুই না জেনে 

একটার সঙ্গে একটা মিলিয়ে কী সব উলটাপালটা কথা বলছেন। 

অধ্যাপক ভদ্রলােক রাগে তােতলাতে তােতলাতে বললেন, আমি তাে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিচ্ছি না— একটু এদিক-ওদিক হতেই পারে। ‘বিজ্ঞান ঠাকুরমার ঝুলি না যে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বলবেন।’ 

ভদ্রলােক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অন্যদিকে সরে গেলেন। আমি গেলাম তার পেছনে পেছনে। মজার চরিত্র । কথা বলা দরকার । 

যতটুকু মজার চরিত্র ভেবে দ্রলােকের কাছে গেলাম দেখা গেল চরিত্র তারচেয়েও মজার। ভদ্রলােকের বিষয় পদার্থবিদ্যা নয়– সাইকোলজি। পদার্থবিদ্যা হচ্ছে তার শখ। এই শখ মেটানাের জন্যে রীতিমতাে শিক্ষক রেখে অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা শিখেছেন। 

এইজাতীয় লােকদের সঙ্গে সহজে বন্ধুত্ব হয় না। আমি লক্ষ করেছি এরা সচরাচর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে থাকে। এই লোেকও দেখা গেল সেইরকম। একদিন বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, আপনি দেখি মাঝে-মাঝেই আমার কাছে আসেন। বিষয়টা কী বলেন তাে ? 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

বিষয় কিছু না। 

‘বিষয় কিছু না বললে তাে হবে না। এ পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না। 

আমি হাসিমুখে বললাম, ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, তাই বলে কিন্তু ভাই মােতালেব সাহেব, হাইজেনবার্গের আনসারটিনিটি প্রিন্সিপ্যাল আপনি ভুলে যাচ্ছেন। একটি বস্তুকে পুরােপুরি আপনি কিন্তু জানেন না। যখন অবস্থান জানেন তখন সঠিক গতি কী তা জানেন না…।। 

‘আপনার সঙ্গে কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না আপনি স্পষ্ট করে বলুন কীজন্যে আমার কাছে আসেন মদ্যপানের লােভে ? 

আমি ঝামেলা এড়াবার জন্যে বললাম, হ্যা। 

‘ভালাে কথা। আমার পেছনে অনেকেই ঘােরে এবং তাদের উদ্দেশ্য একটাই– বিনা পয়সায় মদ্যপান । তৃষ্ণার্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি মদ্যপান করতে চায় তবে তা নিজের বাসায় নয় অন্যের বাসায় যাতে স্ত্রী জানতে না পারে। নিজের পয়সায় না, অন্যের পয়সায়, যাতে টাকা-পয়সা খরচ না হয়— অদ্ভুত মধ্যবিত্ত।’ 

আমি বললাম, আপনি মনে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের ওপর খুব বিরক্ত। 

‘অফকোর্স বিরক্ত। মধ্যবিত্ত হচ্ছে সমাজের একটা ফাজিল অংশ। আনকন ট্রোলড গ্রোথ । এই মধ্যবিত্তের প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা হয় কাজিনের সঙ্গে, প্রথম যৌনতার অভিজ্ঞতা হয় বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে। প্রথম মদ্যপানের অভিজ্ঞতা হয় অন্যের পয়সায়। এখন বলুন আপনাকে কী দেব ? স্কচ ক্লাব আছে, জিন আছে, ভদকা আছে, কয়েক পদের হুইসকি আছে। আর আপনার যদি মিক্সড ড্রিংক পছন্দ হয় তা হলে তাও বানিয়ে দেব । You name it, I will make it—হা হা হা। 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম- বিনা পয়সায় মদের লােভে না, আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার লােভেই আমি আসি। 

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে কি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বলে মনে হয় ? | ‘হ্যা। 

‘আমি এই নিয়ে তিনবার বিয়ে করেছি কোনাে স্ত্রী আমাকে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বলে মনে করেনি। প্রথমজন অনেক কষ্টে দু’বছরের মতাে টিকে ছিল, বাকি দুজন এক বছরও টেকেনি। হা হা হা। 

“না টেকায় আপনি মনে হচ্ছে খুশিই হয়েছেন। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *