রাতের খাওয়া শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন বলল, আমরা তাহলে উঠি মা । রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, কোথায় যাবি ? আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় যাবি বলছ কেন মা ? আগেভাগে তাে বলেই রেখেছি একটা ভালাে হােটেলে উঠতে হবে। ক্লারা গতরাতে এক ফোটাও ঘুমায়নি। বেচারি গরমে সেদ্ধ হয়ে গেছে। বাতাস নেই এক ফোটা। ‘ফ্যান তাে আছে।’
বাতাস গরম হয়ে গেলে ফ্যানে লাভ কী ? তােমরা গরম দেশের মানুষ ওর কষ্টটা কী বুঝবে ? আমি নিজেই সহ্য করতে পারছিলাম না, আর ও…’
‘বউকে নিয়ে হােটেলে গিয়ে উঠলে লােকে নানান কথা বলবে।
আলাউদ্দিন এই কথায় রাগে জ্বলতে লাগল । হড়বড় করে এমন কথা বলতে লাগল যার তেমন কোনাে অর্থ নেই।
তার বাবা মনসুর সাহেব যিনি কখনােই কিছু বলেন না তিনি শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেন– তুই খামাকা চিকার করছিস কেন ?
‘আমি খামাখা চিল্কার করছি ? আমি খামাখা চিষ্কার করছি ? আমি শুধু বলছি লােকজনের কথা নিয়ে তােমরা নাচানাচি কর কেন ? তােমরা যদি না খেয়ে মর লােকজন এসে তােমাদের খাওয়াবে ? প্রতি মাসে দেড়শাে ডলারের যে মানি অর্ডারটা পাও সেটা কি লােকজন দেয় ? বলাে দেয় লােকজন ?’
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মনসুর সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, যা যেখানে যেতে চাস। আলাউদ্দিন তিক্ত গলায় বলল, তােমরা যে ভাবছাে ছেলে ঘর ছেড়ে হােটেলে চলে যাচ্ছে, কাজেই ছেলে পর হয়ে গেল- এটা ঠিক না।
‘আমরা কিছু ভাবছি না। তুই আর ভ্যাজভ্যাজ করিস না। মাথা ধরিয়ে দিয়েছিস ।
মাথা ধরিয়ে দিয়েছি ? আমি মাথা ধরিয়ে দিয়েছি ?’
আট বছর পর ফিরে আসা পুত্রের সঙ্গে দ্বিতীয় রাতেই বাড়ির সদস্যদের খণ্ড প্রলয়ের মতাে হয়ে গেল। নাসরিন মনে-মনে বলল, বেশ হয়েছে। খুব মজা হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি ।।
ক্লারা ঝগড়ার ব্যাপারটা কিছুই বুঝল না। একবার শুধু ভ্ৰ কুঁচকে বলল, তােমরা এত চেঁচিয়ে কথা বলাে কেনাে ? বলেই জবাবের অপেক্ষা না
করে বসার ঘরে টিকটিকি দেখতে গেল ! বাংলাদেশের এই ছােট্ট প্রাণী তার হৃদয় হরণ করেছে। সে টিকটিকির একুশটা ছবি এ পর্যন্ত তুলেছে। ম্যাকরাে লেন্স আনা হয়নি বলে খুব আফসােসও করছে। ম্যাকরাে লেন্সটা থাকলে ক্লোজআপ নেয়া যেত।
খুব সঙ্গত কারণেই গভীর রাত পর্যন্ত এ পরিবারের কোনাে সদস্য ঘুমুতে পারল না। বারান্দায় বসে রাহেলা ক্রমাগত অর্ষণ করতে লাগলেন। একসময় মনসুর সাহেব বললেন, আর কেঁদো না, চোখে ঘা হয়ে যাবে। তােমার ছেলের আশা ছেড়ে দাও। বিদেশী পেতনি বিয়ে করে ধরাকে সরা দেখছে । হারামজাদা। নাসরিন আজ ওর ঘরে ঘুমুতে পারছে।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
ঘরে ঢুকে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল । কত আগ্রহ করে তারা সবাই মিলে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে তবু ভাইয়ার পছন্দ হলাে না। এই ঘরটা কি হােটেলের চেয়ে কম সুন্দর হয়েছে! মাথার পাশে টেবিল-ল্যাম্প। পায়ের দিকের দেয়ালে সূর্যাস্তের ছবি। খাটের পাশে মেরুন রঙের বেডসাইড কার্পেট । জানালা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে খুব একটা গরম কি লাগে ? কই, তার তাে লাগছে না। তার তাে উলটো কেমন শীত-শীত লাগছে।
সে টেবিল-ল্যাম্প জ্বালাল। এত বড় খাটে একা ঘুমুতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ভাইয়া থাকবে না জানলে বড় আপাকে জোর করে রেখে দিত। নাসরিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল । আজ রাতটা তাদের জন্যে খুব খারাপ রাত। আজ রাতে তাদের কারােরই ঘুম হবে না। একা একা জেগে থাকা খুব কষ্টের। | ভূত নামালে কেমন হয় ? ওইজা বাের্ড খুলে সে যদি বােতামটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকে তা হলে কি কিছু হবে ? যদি কোনাে আত্মা চলে আসে ভালােই হয়। আত্মার সঙ্গে গল্প করা যাবে। মুশকিল হচ্ছে এই আত্মগুলি আবার কথা বলে না । বােতাম ঠেলে ঠেলে মনের ভাব প্রকাশ করে।
নাসরিন দরজা বন্ধ করে ওইজা বোের্ড নিয়ে বসল। তর্জনী দিয়ে বােতামটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে নরম গলায় বলল, আমার আশপাশে যদি কোনাে বিদেহী আত্মা থাকেন তা হলে তাদের মধ্যে একজন কি দয়া করে আসবেন ? যদি আসেন তা হলে আমার মনটা একটু ভালাে হবে। কারণ আজ আমার মনটা খুব খারাপ।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
কেন খারাপ তা তাে আপনারা খুব ভালাে করেই জানেন। পুরাে ঘটনার সময় নিশ্চয়ই আপনারা আশপাশে ছিলেন। ছিলেন না ? এই পর্যন্ত বলেই নাসরিন চমকে উঠল। ডান হাতটা একটু যেন কাঁপছে।
বােতামটা কি নড়তে শুরু করেছে ? অসম্ভব, হতেই পারে না। এ কী, বােতামটা এগিয়ে গেল কীভাবে ? নাসরিন নিজেই হয়তাে নিজের অজান্তে বােতাম ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেছে । খানিকটা ভয় এবং খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে নাসরিন অপেক্ষা করছে। হচ্ছেটা কী ?
বােতাম ‘ইয়েস’ লেখা ঘরে কিছুক্ষণ থেমে আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। নাসরিন শব্দ করেই বলল, বাহ বেশ মজা তাে! পরবর্তী কিছুক্ষণ ‘ইয়েস’ এবং ‘নাে’তে বােম ঘুরতে লাগল। নাসরিনের শুরুর ভয় খানিকটা কমে গেল। যদিও তখনও বুক ধক ধক করছে ।
ওইজা বাের্ডে ‘ইয়েস’ এবং ‘নাে’ ছাড়া আরাে দুটি ঘর আছে সেগুলি হচ্ছে- আমি উত্তর দেব না’, ‘আমি জানি না’ । বােতামটা এইসব ঘরেও মাঝে মাঝে এল । প্রশ্ন এবং উত্তর এইভাবে সাজানাে যায় আপনি কি এসেছেন ?’ ‘হ্যা।। ‘আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন ? ‘না।
আপনি কোথায় থাকেন? ‘আমি উত্তর দেব না।
আজ আমাদের সবার খুব মন-খারাপ সেটা কি আপনি জানেন ? না।’ কীজন্যে আমাদের মন খারাপ সেটা কি বলব ? না। ‘শুধু না-না করছেন কেন ? একটু শুনলে কী হয় ? বলি ? ‘হা।।
তার আগে বলুন আপনার নাম কী ?
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
বােতামটা ঘুরতে ঘুরতে এক্স ঘরে গিয়ে থামল । নাসরিন বলল, এক্স দিয়ে বুঝি কারাের নাম হয় ? ঠিক করে নাম বলুন।
‘আমি জানি না।‘ ‘আপনি জানেন না মানে ? আপনার কি নাম নেই ?
‘ভূতদের নাম থাকে না ?’ ‘আমি জানি না।’
‘সে কী, আমার তাে ধারণা প্রেতাত্মারা সব জানে। আর আমি আপনাকে যাই জিজ্ঞেস করছি— আপনি বলছেন আমি জানি না। আচ্ছা বলুন তাে উনিশকে তিন দিয়ে গুণ দিলে কত হয় ?
‘আমি জানি না।
আমি জানি না। তবে আপনি যদি বলতেন তা হলে গুণ করে বের করতাম। আপনি কি গুণ অংক জানেন ?
‘হ্যা। ‘আচ্ছা আত্মাদের কি অংক করতে হয় ?
বােতাম এক জায়গায় স্থির হয়ে রইল। উত্তর দিল না। নাসরিন বলল, আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন ?
‘হঁ্যা।’
প্লিজ আমার ওপর রাগ করবেন না । কেউ আমার সাথে রাগ করলে আমার খুব মন-খারাপ থাকে। এমনিতেই আজ আমার খুব মন-খারাপ। আপনি কি জানেন আমার যে মন–খারাপ ?’
‘হ্যা। ‘কেন মন-খারাপ সেই ঘটনাটা বলি ? বলব ? ‘হ্যা।
নাসরিন আজ সারাদিনের ঘটনা বলতে শুরু করল। বলতে বলতে দুবার কেদে ফেলল। তার কাছে একবারও মনে হলাে না সে হাস্যকর একটা কাণ্ড করছে । এইসব গল্প বােতামটাকে বলার কোনাে মানে আছে ?
নাসরিন ঘুমুতে গেল রাত তিনটায়। খুব চমৎকার ঘুম হলাে। ঘুমিয়ে এত তৃপ্তি অনেকদিন সে পায়নি। তবে ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণই মনে হলাে একজন বুড়ােমানুষ তার গায়ে হাত রেখে শুয়ে আছেন। বুড়ােমানুষটার শরীরে চুরুটের কড়া গন্ধ।