জনম জনম-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

জনম জনম
জনম জনম-হুমায়ূন আহমেদ

তিথি এখনাে যায় নি। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জালালুদ্দিন চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তবু তাঁর মনে হচ্ছে মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। চেহারা কেমন মায়া মায়া। তবে স্বভাব কঠিন হয়েছে। বয়সকালে এই মেয়ে তার মায়ের চেয়েও কঠিন হবে।

তিথি বলল,বাবা। ও কি? 

আমি আগে কখনাে এভাবে কারাে সঙ্গে আসি নি। আমার ইচ্ছাও ছিল না। আমি একজন ফামিলি ম্যান। আমার কোন বদমত্যাস নেই। মাঝে-মধ্যে সিগারেট খাই । আগে পান খেতাম এ দিয়ে। ভাক্তার বলল ভাটা হবে জন্যে খুব খারাপ, সিগারেটের চেয়েও খারাপ, তাই পানও ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্যি এমনিতে পানটা কিন্তু খারাপ না, ভিটামিন সি আছে! ভিটামিন সি-টা শরীরের জন্য খুবই দরকার। 

তিথি বলল, আমাকে এসব কথা কেন বলছেন? লােকটি অস্বস্তিতে রুমাল দিয়ে নাক ঘষতে লাগল। যেন খুব ধীধায় পড়ে গেছে। কি করবে—কি বলবে বুঝতে পারছে না। তুমি গান জান? 

না, জানি না আর জানলেও আপনি নিশ্চয়ই চান না এখানে আমি একটা গান শুরু করি। না-কি চান? 

 না না, তা চাই না : সব কিছুই একটা সময় আছে। তুমি বস আমি সিগারেট নিয়ে আসি। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। 

জনম জনম-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

একজন বয়কে বললেই এনে দেবে। আপনার যেতে হবে না। ঃ না থাক, আমিই যাচ্ছি। লােকটি দ্রুত বের হয়ে গেল। তার চলে যাবার ভঙ্গি দেখে মনে হল সে আর ফিরবে না। না ফিরলে মন্দ হয় না। তিথির ঘুম পাচ্ছে। সে মনে মনে ঠিক করল মিনিট দশেক অপেক্ষা করে চলে যাব। না, লােকটি চলে যায় নি সিগারেট নিয়ে ফিরছে : মুখ ভর্তি পান তার গায়ের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবতে পানের পিত্রে দাগ। অচ এই আগেই বলছিল—পান খায় না। তিনি বলল, আপনি কি আমাকে অন্য কোথাও নির যাবেন? নাকি সারাক্ষণ খােনেই কাটাবেন? 

লোকটি খুবই অবাক হয়ে বলল, আমি তােমার কথা বুঝতে পারছি না। কোথায় নিয়ে যাব তােমাকে? 

ও সে তো আপনি ঠিক করবেন। কোন হােটেলে কিংবা আপনার বাসায়। 

কি সর্বনাশের কথা! বাসায় আমার স্ত্রী আছে—কছু মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আজিমপুর গার্লস স্কুলে, ফরিদা যদি এইসব ব্যাপারে কিছু জানতে পারে তাহলে সে আমাকে কিছু বলবে না। সােজা ছাদে উঠে ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবে। ফরি হচ্ছে এ ঐ নাম। ও বুঝতে পারছি। 

খুবই চম, মেয়ে, আদর্শ মা, আদর্শ স্ত্রী। এখন অবশ্যি শরীরটা খুবই খারাপ। বছর তিনেক ধরে বিছানায় পড়ে আছে। একেবারে কংকাল । ডাক্তার খুব খারাপ ধরনের অসুখ বলে সন্দেহ করছে। বাঁচবে না। 

জনম জনম-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

তাই নাকি? হ্যা তাই। ইয়ে তােমার নামটা কিন্তু বল নি। ও আমার নাম পরী . ও বাহ্ সুন্দর নাম : এটা আমার আসল নাম না : নকল নাম। ও নামের আবার আসল-নকল আছে নাকি? 

কেন থাকবে না। মানুষের মধ্যেও তাে আসল মানুষ নল মানুষ আছে। যেমন আমি একজন নকল মানুষ।  

তুমি আগে যাও, আমি পরে আসছি। কেউ দেখে ফেলবে সেজন্যে? 

লােকটি তার প্রাণ দিল না। তিথি বলল, আপনি কি আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেন? আমি এসএসসি পাস করেছি। 

কি রকম চাকরি? ও যে কোন চাকরি। টাইপিস্টের চাকরি বা এই জাতীয় কিছু। টাইপিং জান? : দ্বি-না। তবে আমি শিখে নিতে পারব। আমি খুব দ্রুত শিখতে পারি। 

ও আমার কাছে কোন চাকরি নেই। আমার অফিসে অল্প কিছু কর্মচারী আছে। নতুন লােক নেওয়ার অবস্থা অফিসের নাই। তাছাড়া… 

তাছাড়া কি? 

ও হঠাৎ করে সুন্দরী একটা মেয়েকে চাকরি দিলে নানান কথা উঠবে। আমার স্ত্রী শুনতে পেলে মনে কষ্ট পাবে আমাকে অবশ্যি কিছু বলবে না। 

ছাদ থেকে লাফিয়েও পড়তে পারেন, তাই না? 

লােকটি উঠে দাঁড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে নিচু গলায় বলল, এইখানে ঠিকানা আছে, দবির উদ্দিন বি.এ.। দবির ইন্ডাস্ট্রিজ ৩১/৩ জিগাতলা, তুমি মাস তিনেক পর একবার খোঁজ নিও।

জনম জনম-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ 

৪ মাস তিনেক পর খোঁজ নিতে বলছেন কেন? আপনার কি ধারণা মাস তিনেকের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর ভালমন্দ কিছু হয়ে যাবে? | লােকটি শীতল গলায় বলল, তােমাকে যতটা ভাল মেয়ে আমি ভেবেছিলাম ততটা ভাল তুমি না। তােমার মত মেয়ে যে রকম সাধারণত হয় তুমিও সে রকমই। আলাদা কিছু না ; 

তিথি হেসে ফেলল । হাসতে হাসতেই বলল, আমাকে রাগিয়ে দেয়াটা কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ হয় নি। কার্ডে আপনার বাসার ঠিকানা আছে সেই ঠিকানায় যদি হঠাৎ উপস্থিত হয়ে যাই তখন কি হবে? 

দবির উদ্দিন জবাব দিল না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।। 

তিথির ঠোটে এখন আর হাসি নেই। সে কঠিন চোখে তাকাচ্ছে দবির এই মেয়েটির দ্রুত ভাবান্তরের রহস্য ধরতে পারছে না। সব কেমন এলোেমলাে হয়ে যাচ্ছে। 

তিথি নিচু গলায় বলল, পুরাে টাকাটা জলে ফেলবেন কেন? কিছুটা অন্তত উসুল হােক—ব্লাউজ খুলে ফেলছি, আপনি আমার বুকে হাত দিন। আর যদি তাও না চান অন্তত তাকিয়ে দেখুন। আপনার অসুস্থ স্ত্রীর বুক নিশ্চয়ই আমার বুকের মত সুন্দর না । 

দবিরের চেহারা ছাইবর্ণ হয়ে গেছে। সে অল্প অল্প কাঁপছে। তিথিমুখের কঠিন ভাঁজগুলি হঠাৎ সহজ হয়ে গেল। সে বলল, আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি চমৎকার মানুষ। চলুন, আমরা যাই। 

জনম জনম-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

হীরুকে ঘন্টাখানিক ধরে একতলা একটা টিনের ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে। এই এক ঘন্টায় বাড়ির কাছাকাছি এসে কয়েকবার তীক্ষ্ণ শিস দিয়েছে। দু’বার ইটের টুকরা টিনের চালে ফেলেছে। এসব হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। চেষ্টায় কোন ফল হচ্ছে না। কেউ বেরুচ্ছে না বা জানালা দিয়ে উকি দিচ্ছে না। 

বাড়িটা ইমাইল সাহেবের। 

একটা করে মেয়ে পয়দা কর।’ বলেই ইকর মনে হল—বলাটা ঠিক হল না। তার শ্বশুর হবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা এই কোলা ব্যারে আছে। হবু শ্বশুর সম্পর্কে এমন মত । শ্বশুরনো সম্পর্কে ভালাে থাকা দরকার। তবে এই লােক তার শ্বশুর হলেও বিপদ আছে। ঈদের দিন কোলাকুলি করতে হবে। 

হারু একটা রিকশা নিয়ে নিল। মীরপুর থেকে কল্যাণপুর ফের এই সময়টায় বাসে গাদাগাদি ভিড় থাকে। এ্যানার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে ইস্ত্রী করা শার্ট পরে এসেছে। চাপাচাপিতে শার্ট ভর্তা হয়ে যাবে। রিকশা ভাড়ায় বাড়তি টাকা চলে যাচ্ছে। উপায় আর কি? 

এনার সঙ্গে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের নয়। আড়াই মাসের মত। পরিচয় পর্বটা খারাপ না। এসএসসি পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন। হীরু মীরপুর রােডে এসে দাঁড়িয়েছে-কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বহর তিন চারেক আগে এই সময় মেয়েদের স্কুলে নল সাপ্লাই করত। বয়সের কারণে এটা এখন মানায় না তন্তু পরীক্ষার সময় গম্ভীর মুখে একবার ঘুরে আসে। অনেক দিনের অভ্যাস। চট করে ছাড়া মুশকিল। 

জনম জনম-পর্ব-(৪)-হুমায়ূন আহমেদ

” হীরু ভাবছিল কোন স্কুলে যাবে। আশেপাশের সব ক’টা সেন্টার ঘুরে দেখা দরকার। রােজ 5ে এই সেক্টরে বা কােন মানে হয় না এই ম যখন তা মনের অবস্থা তখন এনাকে তার চোখে পড়ল বেচারী শাি পাচ্ছে না’ কোন রিকশা নেই। যাও আছে-াত্রী বােঝাই! মেটো ছােটাছুটি করছে রিকশার জন্যে। 

ব্যাপারটা দেখতে হয় বেশ মজাই লাগছে। মেয়েটা দারুণ ভয় পেয়েছে। তার হাত থেকে এক সময় জ্যামিতি বাক্স পড়ে গেল চত, কম্পাস এইসব ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে। সে বসে বসে এইসব তুলছে এবং চোখ মুছছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *