জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ২০ হুমায়ূন আহমেদ

জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ২০

সাফিয়া দরজা খুললেন। শাহ কলিম নামের লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন। শাহ কলিম বলল, আপনার বাড়ি খুঁজে বের করতে বিরাট পরিশ্রম হয়েছে। ঠিকানা ছিল ভুল। দুপুর একটা থেকে হাঁটাহাঁটি করছি, এখন খুব সম্ভব চারটা বাজে। এক গ্রাস পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতে কি আপনি একা?

হ্যাঁ, আমি একা।আপনি তো একা না, এই বাচ্চাটা ছাড়াও আপনার তিনটা মেয়ে আছে। আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছেন কেন? ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাওয়ার কিছু নাই। যান, পানি নিয়ে আসেন।সাফিয়া পানি আনলেন। লোকটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার মনে হলো, আসলেই ভয় পাওয়ার কিছু নাই। লোকটা বলল, আমি এসেছি আপনাদের খোঁজ-খবর নেবার জন্যে। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না তা জানার জন্য।সাফিয়া বললেন, আপনি কে?

শাহ কলিম বলল, আমি কে সেটা তো বলেছি। আমার নাম শাহ কলিম। কবিতা লেখি। নানান পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়। আপনাদের কাছে এক ভদ্রলোক আমাকে পাঠয়েছেন। উনি আপনার স্বামীর বন্ধু মানুষ। আপনার স্বামীকে খুব পছন্দ করেন। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না জানার জন্যে পাঠিয়েছেন। এখন বলেন–আছে কোনো সমস্যা?

সাফিয়া আগ্রহ নিয়ে বললেন, মরিয়মের বাবা কোথায় আপনি জানেন?

শাহ কলিম বলল, আমি জানি না।

উনি কি বেঁচে আছেন?

আমি উনার বিষয়ে কিছুই জানি না।

উনার বন্ধু কি জানেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?

শাহ কলিম বলল, উনার খন্ধুও কিছু জানেন না। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের কাছ থেকে খবর নেবার জন্য। এখন দেখি আপনারাও কিছু জানেন না। যাই হোক, অনেক কথা বলে ফেলেছি। গলা শুকিয়ে গেছে। এক কাপ চ্যা খেতে পারলে ভালো হয়। চা খাওয়াতে পারবেন?

চা খাবার সময় শাহ কলিমের দেখা হলো মরিয়ম এবং মাসুমার সঙ্গে। মাসুমাকে দেখে শাহ কলিমা খুবই বিস্মিত হলো। অতি রূপবতী মেয়ে। নাক সামান্য চাপা। এতেই যেন রূপ ফুটেছে। মেয়েটার কথাবার্তাও চমৎকার। কথা বলার এক পর্যায়ে সে ঘাড় কাত করে। চোখ পিটপিট করতে থাকে। দেখতে ভালো লাগে।মাসুমা বলল, আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি সত্যি সত্যি একজন কবি।শাহ কলিম বলল, আমি তো আসলেই কবি।মাসুম বলল, যখন চাঁদ উঠে, তখন আপনি কী করেন? হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন?

আমি জোছনা দেখি। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো জোছনা দেখা যায় না। কোনো কবিই চাঁদ দেখেন না। তারা জোছনা দেখেন।বলুন দেখি পূর্ণিমা কবে? যদি বলতে পারেন তাহলে বুঝব আপনি আসলেই কবি। জোছনার হিসােব আপনার কাছে আছে। আর যদি বলতে না। পারেন তাহলে আপনি ভু-কবি।শাহ কলিম অবাক হয়ে বলল, ভু-কবি মানে কী?

মাসুমা বলল, ভু-কবি মানে ভুয়া কবি।

ও আচ্ছা।

আপনি কি রাগ করেছেন?

না।

রাগ করা উচিত ছিল, রাগ করেন নি কেন?

তুমি এমন একটি মেয়ে–যার উপর রাগ করা একজন ভু-কবির পক্ষে খুবই কঠিন।কবি শাহ কলিম রাত আটটা পর্যন্ত থাকল। তার নিজের লেখা কবিতা মেঘবালিকাদের দুপুর গভীর আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করল। কবিতা আবৃত্তির মাঝখানে অবশ্যি মাসুমা দুইবার খিলখিল করে হেসে উঠল। এতে কবি হিসেবে শাহ কলিমের রাগ করা উচিত ছিল। সে রাগ তো করলেই না, বরং তার কাছে মনে হলো–এত সুন্দর শব্দ ও ঝংকারময় হাসি সে এর আগে কোনোদিন শুনে নি। তার মাথায় এক লাইন কবিতাও চলে এলো–

তার হাসি তরঙ্গ ভঙ্গের মতো শব্দময় ধ্রুপদী নদী

ধ্রুপদী শব্দটা যাচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না, তবে শব্দটা জুৎসই। ধ্রুপদীর শেষ অক্ষর দী, আবার নদীর শেষ অক্ষরও দী। মিলাটা ভালো।

কবি শাহ কলিম ঠিক করল, এই অসহায় পরিবারটিকে সে নিজ দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া এখন সমস্যা না। শহরে রিকশা, ঠেলাগাড়ি সবই চলছে। শহর থেকে বের হলেই নৌকা। ট্রাক আছে, বাস আছে। সামান্য চেকিং মাঝেমধ্যে হয়, সেটা তেমন কিছু না।আমার নাম গৌরাঙ্গ বিরক্ত দাস। এখন আমি নিজের বাড়িতে আছি। কী মজা কী মজা! নিজ বাড়িতে বাস করি নিজের মনে খাই। তাই তাই তাই।

গৌরাঙ্গের কাছে মনে হলো, সে আনন্দে আছে। বেশ আনন্দে আছে। তার বাড়ি-ঘর ঠিক আছে। জিনিসপত্রও ঠিক আছে। বুক শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সে একটা পুরো ওল্ড স্মাগলারের বোতল পেয়ে গেল। মুখ পৰ্যন্ত খোলা হয় নি। আধা বােতল রাম পাওয়া গেল। রাম এমন জিনিস যে নষ্ট হয় না। যত দিন যায় ততই তার স্বাদ বাড়তে থাকে। রামের স্বাদ ঠিক আছে কি-না তা দেখার জন্যে বোতল থেকে সরাসরি কয়েক ঢোক খেল। স্বাদ ভালো আছে।

শুধু যে ভালো আছে তা-না, স্বাদ জমেছে। হেভি জমেছে। গৌরাঙ্গের মনে হলো, রাম নামে এমন একটা ভালো জিনিস তৈরি হয়েছে অথচ লক্ষণ নামে কিছু তৈরি হয় নি। লক্ষণ নামে কিছু থাকলে সে দুই ভাইকে পাশে নিয়ে বসতো। এক চুমুক রাম, এক চুমুক লক্ষণ–বাহ কী আনন্দ!

সদর দরজা বন্ধ। বাড়ির জানালাগুলিও বন্ধ।। ঘর দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে আছে। এই ভালো। অন্ধকারের আলাদা আনন্দ আছে। মানুষ এমন এক জীব যে আনন্দ পেতে চাইলে আনন্দ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। এই যে গৌরাঙ্গ আনন্দ পাচ্ছে। সে বসার ঘরে কাপেটে পা ছড়িয়ে বসেছে। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, সংসার আগের মতোই আছে।

নীলিমা উপরের তলায় তার বাবার কাছে গেছে। সঙ্গে রুনিকে নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই গৌরাঙ্গের সঙ্গে কোনো ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে বাবার কাছে গিয়ে বসে আছে।মেয়েদের এই স্বভাব–ঝগড়া মাথার ভেতর রেখে দেয়। পুরুষমানুষ এই কাজ কখনো করে না। যখন ঝগড়া হবে পুরোপুরি হবে। পাঁচ-দশ মিনিটে ভুলে যাবে। মেয়েরা ভুলবে না। তারা পাঁচ-দশ বছর ঝগড়া মাথায় রেখে দিবে।

গৌরাঙ্গ রামের বোতলে আরো কয়েক বার চুমুক দিল। প্রায় খালি বোতল রেখে দেবার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া আজ দুপুরে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও নেই। এই জিনিস পেটে থাকলে ক্ষিধে লাগবে না।ঘরে পিন পিন করছে মশা। তবে মশাগুলি ভালো। তাকে কামড়াচ্ছে না। দিনের মশা কামড়ায় না। রাতের মশা কামড়ায়। ব্যথা লাগে চামড়ায়। বাহ ভালো কবিতা হয়েছে তো! দিনের মশা কামড়ায় না, রাতের মশা কামড়ায়, ব্যথা লাগে চামড়ায়।

কবিতাটা রুনিকে বললে মজা হতো। মেয়েটা কবিতা পছন্দ করে। মেয়েটা এখন আছে তার দাদুভাইয়ের কাছে। দাদুভাইয়ের নাম–হরিভজন সাহা। সমাসের ব্যাসবাক্য নির্ণয় কর হরিভজন। হরিকে যে ভজন করে হরিভজন। যা ব্যাটা হরিকে ভজন করতে থাক, এদিকে সংসার শেষ।

মশারা এখন গৌরাঙ্গকে কামড়াতে শুরু করেছে। ভালো যন্ত্রণা হয়েছে তো! আচ্ছা ঘরে কি ধূপ আছে? ধূপের ধোঁয়ায় মশা থাকে না। আছে তো বটেই। নীলিমা যেমন ধর্ম-কৰ্ম করা মহিলা, প্রতি সন্ধ্যাবেলায় মহাদেবের পটে সে ধূপের ধোঁয়া দেয়। পটে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রার্থনা করে। কী প্রার্থনা করে? হে দেবাদিদেব মহাদেব।

তুমি আমার সংসার সুখে রাখো। মহাদেবকে এত ধোয়া খাইয়েও লাভ হয় নি। সংসার মিলিটারি ছারখার করে দিয়েছে। সব শেষ করে একজনকে বাঁচিয়ে রেখেছে মশার কামড় খাওয়ানোর জনো। গৌরাঙ্গ বোতলে লম্বা চুমুক দিয়ে মনে মনে বলল, খা মশা খা। হিন্দুর রক্ত খা।

গৌরাঙ্গ চিন্তিত বোধ করছে। চিন্তা-ভাবনা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। মাতাল অবস্থায় কষ্টের কথা ভাবলে কষ্ট দশগুণ বেড়ে যায়। আবার আনন্দের কথা ভাবলে আনন্দ বাড়ে মাত্র দুইগুণ। এই বিচার ঠিক হয় নাই। কষ্ট দশগুণ বাড়লে অনিন্দ ও দাশগুণ বাড়া উচিত; গৌরাঙ্গ আনন্দের ভাবনা ভাবতে শুরু করল।

যেন তার পেছনে তার পিঠে হেলান দিয়ে রুনি বসে আছে। (রুনি প্রায়ই এ রকম করে। বাবার পিঠে হেলান দিয়ে নিজের মনে পুতুল নিয়ে খেলে। গুটি গুষ্ট করে কথা বলে। এই সময় সে রুনির মুখ দেখতে পায় না।) এখনো যেন সে রকম হচ্ছে।ও রুনি, কী করো মা?

গৌরাঙ্গের মনে হলো রুনি ক্ষীণস্বরে জবাব দিয়েছে। জবান্ধটা স্পষ্ট না বলে গৌরাঙ্গ শুনতে পায় নি।

মাগো, গল্প শুনবে?

হুঁ।

কিসের গল্প শুনবে মা?

মশার গল্প।

গৌরাঙ্গ চমকে উঠল। কারণ মশার গল্প এই বাক্যটা সে স্পষ্ট শুনেছে। রুনি যেমন প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে বলে, মশা শব্দটাও টেনে টেনে বলেছে–ম… শা…। সে কি পেছন ফিরে দেখবে রুনি সত্যি সত্যি তার পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে কি-না? থাকা দরকার নেই, তারচে বরং মশার গল্প করা যাক।

মাগো শোন, এই পৃথিবীতে আগে মশা ছিল না। কীভাবে মশার জন্ম হলো সেই গল্প শোন। জেলেরা সারারাত মাছ ধরে। কিন্তু রাতে তাদের খুব ঘুম পায়। প্রায়ই দেখা যায় মাছ ধরতে গিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। একদিন তারা দেবী শীতলাকে বলল, ও দেবী, তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও না যেন আমাদের রাতে ঘুম না পায়। দেবী বললেন, তথাস্তু।

বলেই নিজের বাম হাত থেকে কিছু ময়লা জেলেদের হাতে দিয়ে বললেন, এই ময়লা তোরা তোদের বাড়ির কাছের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসবি। এতেই কাজ হবে। রাতে আর তোদের ঘুম হবে না। তারা তাই করল। দেবীর হাতের ময়লা নিয়ে ডোবায় ফেলল। ওমি ডোবা থেকে পিন পিন করতে করতে হাজারে বিজারে মশা বের হয়ে এলো। এরপর কী হলো শোন। জেলেরা মাছ ধরতে যায়। মাছ ধরতে গিয়ে ঘুমুতে পারে না। তাদের সারা রাত মশা কামড়ায়।

গৌরাঙ্গ রামের বোতলের পুরোটা গলায় ঢেলে দিল। এখন তার মাথা ঘুরছে। শরীর যেন কেমন করছে। বমি হবে কি? হলে হবে। কী আর করা! দরজায় খট করে শব্দ হলো। গৌরাঙ্গ চমকে তাকাল। কী আশ্চর্য নীলিমা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে! অবশ্যই চোখের ভুল। রাম বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, নীলিমা কেমন আছ?

নীলিমা জবাব দিল না। দরজায় ওপাশে সামান্য সরে গেল! এখন আর তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে। বাতাসে যে শাড়ির আঁচল কাঁপছে তাও বোঝা যাচ্ছে। গৌরাঙ্গের হঠাৎ মনে হলো, এখন সে যা দেখছে তাই সত্যি। আগে যা ঘটেছে তা সত্যি না। সে হাড়হড় করে বলল, কয়েকদিন বাসায় ছিলাম না। শাহেদের ওখানে ছিলাম। শাহেদ ভালো আছে।

নীলিমা জবাব দিল না। গৌরাঙ্গ বলল, তুমি কি রাগ করেছে না কি? এখন সময় খারাপ। এখন রাগ করা ঠিক না। তুমি এক কাজ করো, অল্প কিছু জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নাও। তোমাকে আর রুনিকে নিয়ে বর্ডার পাস করে। আগরতলা চলে যাব। অনেকেই যাচ্ছে। সমস্যা নাই।

এই এই! কে বলল–এই এই? নীলিমা বলেছে? তাহলে তো ব্যাপারটা স্বপ্ন না। যা ঘটছে, বাস্তবেই ঘটছে। অবশ্যই বাস্তব। নীলিমার চুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে গন্ধরাজ না কী তেল মাথায় দেয়। অনেক দূর থেকে সেই গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধরাজ নাম সার্থক।কে কথা বলছে? নীলিমা তুমি?

হুঁ।

দূরে কেন? কাছে এসো?

নীলিমা বলল, তুমি কোথায় বসেছ জানো?

গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে বলল, কোথায় বসেছি?

তাকিয়ে দেখো।

গৌরাঙ্গ তাকিয়ে দেখল। সে সোফায় বসে নি। সোফায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। গৌরাঙ্গ বলল, মেঝেতে বসেছি। সামান্য ধুলা আছে।ভালো করে দেখো। কালো দাগ দেখতে পাচ্ছ না? পাচ্ছি। কিসের দাগ? কিসের দাগ তুমি জানো না? না।রক্ত শুকিয়ে গেলে কালো দাগ হয়, তুমি জান না? গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে কালো দাগ দেখছে। তার হাত-পা শিরশির করছে। বুকে চাপা যন্ত্রণা। কেমন যেন লাগছে। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব। পানি।

নীলিমা দরজায় আড়াল থেকে সরে গেল। সে কি পানি আনতে গিয়েছে? গৌরাঙ্গ পানির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বমি করল। কালো দাগগুলি এখন বমিতে ঢাকা পড়েছে। ভালো হয়েছে। বেশ ভালো হয়েছে।ঘর নষ্ট হয়েছে। তাতে অসুবিধা নেই। এই ঘরে সে তো থাকছে না। সে মেয়েকে আর স্ত্রীকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে আগরতলা যাবে। কোলকাতা যেতে পারলে ভালো হতো। আত্মীয়স্বজন আছে।

আগরতলায় পরিচিত। কেউ নেই। তাতে অসুবিধা হবে না। অনেকগুলি ক্যাশটাকা তার সঙ্গে আছে। উহু ভুল হয়েছে। তার সঙ্গে নেই। সে টাকা শাহেদের কাছে রেখে এসেছে। শাহেদের কাছে টাকা রাখা আর ব্যাংকে টাকা রাখা সমান। বরং ব্যাংকে রাখার চেয়েও ভালো। ব্যাংক ছুটির দিন বন্ধ থাকে। শাহেদকে সবদিনই পাওয়া যাবে। শুধু একটাই সমস্যা–শাহেদ সারাদিন পথে পথে ঘোরে। কখন গুলি করে মিলিটারি তাকে মেরে ফেলবে কে জানে!

গৌরাঙ্গ চাপা গলায় ডাকল, নীলিমা নীলিমা।

মনে হলো অনেক দূর থেকে নীলিমা বলল, কী?

আচাৰ্য ভবতোষ বাবুর ঠিকানা কি তোমার কাছে আছে?

হুঁ।উনার ঠিকানা লাগবে। বর্ডারের দিকে রওনা হবার সময় ভবতোষ বাবুর কাছে থেকে তিনটা রক্ষা কবচ নিব। তোমার জন্যে, রুনির জন্যে আর আমার জন্যে। রক্ষা কবচ গলায় থাকলে আর কোনো ভয় নেই।

হুঁ।তোমার বাবাকে যে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে, এতে এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে। উনি বেঁচে থাকলে উনাকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করা মুশকিল হতো। বুড়ো মানুষ হাঁটতে পারত না। তুমি তোমার বাবার মৃত্যু নিয়ে মন খারাপ করবে না। বয়স হয়েছে, মারা গেছেন। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে এইটাই সমস্যা। প্রেতিযোনী প্রাপ্ত হবেন। তাঁর নামে পিণ্ডি দিতে হবে। সব ব্যবস্থা আমি করব। মোটেই চিন্তা করবে না।

আচ্ছা।

পানি আনো। কুলি করব।

গৌরাঙ্গ দেখছে নীলিমা দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে। নড়ছে না। তার চেহারাও অস্পষ্ট। তাহলে সে কি মদের ঝোঁকে চোখে ভুল দেখছে? গৌরাঙ্গ এবার হতাশ গলায় মেয়েকে ডাকতে লাগল। রুনি! ও রুনি! রুনি!

নেশা কেটে যাবার পর গৌরাঙ্গ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। তৃপ্তি করে গোসল করল। চাল-ডালের খিচুড়ি রাধল। খিচুড়ি রাধার ব্যাপারটা সে শাহেদের কাছে শিখেছে। রান্না এত সহজ তা সে আগে বুঝতে পারে নি। আগে বুঝতে পারলে নীলিমার কাছ থেকে দুএকটা রান্না শিখে রাখত। ইলিশ মাছের পাতুরি শিখে রাখতে পারলে কাজের কাজ হতো।

গৌরাঙ্গ নিজের রান্না খুবই আনন্দ করে খেল। শাহেদের জন্যে তার সামান্য মন খারাপ হলো। শাহেদ এই খিচুড়ি খেলে মজা পেত। সে খিচুড়িতে বুদ্ধি করে তরকারির চামচে এক চামচ ঘি ঢেলে দিয়েছে। শুকনা মরিচের গন্ধের সঙ্গে ঘিয়ের গন্ধ মিলে অসাধারণ গন্ধ বের হচ্ছে। শাহেদ পাশে থাকলে গল্প করতে করতে খাওয়া যেত। সে বলত, মিতা খিচুড়ি কেমন হয়েছে?

তোরটার চেয়ে ভালো না? শাহেদ অবশ্যই বলতো, ভালো।সে বলতো, বল দেখি ভালো খিচুড়ির পেছনে কার ভূমিকা প্রধান? দশ টাকা বাজি, তুই বলতে পারবি না। তুই হয়তো ভাবছিস, তোর অবদান। আসলে তা না।তাহলে কার অবদান?

নীলিমার অবদান। সে প্রতিটা জিনিস গুছিয়ে রেখেছে বলে এত মজার খিচুড়ি খাওয়া যাচ্ছে। চাল-ডাল-মসলাপাতি-তেল-ঘি সবই আছে। মিউজিয়ামে জিনিসপত্র যে রকম যত্ন করে সাজিয়ে রাখে, সেইভাবে রাখা আছে।শাহেদ বলতো, ভাবিকে সবসময় দেখেছি, গোছানো মহিলা।

সে বলতো, গোছানো এক জিনিস, আর নীলিমা অন্য জিনিস। বল দেখি, ঘরে কয় পদের ডাল? বলতে পারলে দশ টাকা বাজি।বলতে পারব না।ডাল আছে চার পদের। মসুরি, মাষকলাই, মুগা এবং বুটের ডাল। মধু খেতে চাস? মধু আছে দুই রকমের। সুন্দরবনের মধু, হামদর্দের ওষুধ টাইপ মধু। খাবি একটু মধু? খিচুড়ি শেষ করে এক চামচ খা। ডেজার্ট হিসেবে খা।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে গৌরাঙ্গ লম্বা একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠল। সন্ধ্যা পার করে। সে কোনো বাতি জ্বালালো না। টিভি চালিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল। সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। সে খুব চেষ্টা করল নির্দেশগুলি মনে রাখতে। নির্দেশ পুরোপুরি পালন করতে হবে। যে দেশে সে বাস করে, তাকে তো সেই দেশের নিয়মই মানতে হবে।

টিভি দেখার পর সে ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে বসল। ট্রানজিস্টারের নব ঘুরানোয় মজা আছে। এই শোনা যাচ্ছে রেডিও পিকিং চ্যাও ম্যাও ক্যাও। এই বাংলা সংবাদ। এই আবার চিংমিং পিং। ট্রানজিস্টারের নব ঘুরাতে ঘুরাতেই সে আকাশবাণী শিলিগুড়ি ধরে ফেলল। সেখানে বলা হচ্ছে–স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। তারিখ দশই এপ্ৰিল।গৌরাঙ্গের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল তার পরদিন।

তাকে দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। যে কাউকে দেখলেই এগিয়ে যাচ্ছে। গলা নিচু করে। বলছে— বলুন দেখি, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নাম কী? এক মিনিট সময়। এক মিনিটের ভিতর বলতে পারলে পুরস্কার আছে। বলতে পারছেন না? সহজ প্রশ্ন করি বলেন দেখি, আমার মেয়ের নাম কী? তিনটা চান্স দেব। তিন চান্সে বলতে পারলে পাশ।ঢাকা শহরের প্রায় ফাঁকা রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিয়ে বের হয়েছে আসগর আলি এবং তার পুত্র মজনু মিয়া। মজনু মিয়ার বয়স নয়-দশ।

তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট। গা খালি। তবে মাথায় কিস্তি টুপি আছে। মজনু মুসলমান এই পরিচয়ের জন্যে মাথার টুপি বাঞ্ছনীয়। যে-কোনো কারণেই হোক মজনুর মন বড়ই বিষণ্ণ। সেই তুলনায় আসগর আলিকে মনে হয় আনন্দেই আছে। তার বয়স চল্লিশ। শক্ত-সমর্থ শরীর। বা পায়ে কিছু সমস্যা আছে বলে পা টেনে টেনে হাঁটে। তাতে ঠেলাগাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় না। পঁচিশে মার্চের পর সে দাড়ি রেখেছে।

লোকমুখে শোনা যাচ্ছে মুখে দাড়ি আছে, কলমা জানে—এরকম সাচ্চা মুসলমানদের মিলিটারিরা কিছু বলে না। চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই খবর প্রচারিত হবার ফলে অনেক হিন্দুও দাড়ি রেখেছে। বাইরে বের হবার সময় তারা মাথায় গোলটুপি দেয়। কানের ভাঁজে আতর মাখানো তুলা থাকে। এখন অবশ্যি মিলিটারিবা চালাক হয়ে গেছে। দাড়ি এবং টুপিতে কাজ হচ্ছে না। খৎনা হয়েছে কি-না, লুঙ্গি খুলে দেখাতে হচ্ছে।

আসগর আলি তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। তার খৎনা এখনো হয় নাই। মিলিটারির হাতে ধরা পড়লে কোন ঝামেলা হয়–এই চিন্তায় আসগর অস্থির হয়ে থাকে। চার কলমা বাপ-বেটা কারোরই মুখস্থ নাই। আসগর আলি একটা কলমা জানে। কলমা তৈহিদ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এক কলমায় কাজ হবে কি-না কে জানে! এই কলমা মজনুকে মুখস্থ করানোর চেষ্টা সে কয়েকদিন ধরেই করছে। মুখস্থ হচ্ছে না। দেখা গেল। কলমা জানার জন্যে এবং খৎনা থাকার কারণে মিলিটারি তাকে ছেড়ে দিল। ধরে নিয়ে গেল। মজনুকে।

মিলিটারির সঙ্গে দরবার করে কোনো লাভ হবে না। দরবার করতে গেলে উল্টা গুলি খেতে হবে। চোখের সামনে থেকে ছেলে ধরে নিয়ে যাবে। কিছুই বলা যাবে না। চোখের পানিও ফেলা যাবে না। মিলিটারি চোখের পানি দেখলে রেগে যায়। মুখে হাসি দেখলে তারা রাগে, চোখে পানি দেখলেও রাগে। বড়ই আজিব জাত।আসগর আলি ছেলের দিকে ফিরে বলল, বাপধন শইলটা কি খারাপ? শইল খারাপ হইলে গাড়ির উপরে উইঠ্যা বস। আমি টান দিয়া নিয়া যাব।

মজনু বলল, শইল ঠিক আছে।

ক্ষিধা লাগছে?

না।

ক্ষিধা লাগলে বলবা। আইজ গোছ-পর্যাটা খাব; অবশ্য রিজিকের মালিক আল্লাপাক। উনার হুকুম হইলে খাব। হুকুম না হইলে কলের পানি।মজনু কিছুই বলছে না। মাথা নিচু করে হাঁটছে। আসগর বলল, মার জন্যে পেট পুড়ে?

মজনু সঙ্গে সঙ্গে বলল,হুঁ।এইবার রোগ ধরা পড়েছে। ছেলের মন খারাপ মার জন্যে। অনেকদিন মায়েরে দেখে না। এদিকে আবার শুরু হয়েছে সংগ্ৰাম। খোঁজ-খবর নাই।বলছি তো যাব। এখন পথেঘাটে চেকিং বেশি। মিলিটারি সমানে ধরতাছে। উনিশ-বিশ দেখলেই ঠুসঠাস। তোরে নিয়াই আমার বেশি বিপদ। খৎনা হয় নাই, এইদিকে আবার কইলমাও মুখস্থ নাই। মুখস্থ হইছে?

না।

ক দেহি, ধরাইয়া দিতেছি। প্রথমে–লা ইলাহা…। তারপর কী?

জানি না।

আসগর তাকিয়ে দেখল, ছেলে চোখ মুছছে। লক্ষণ ভালো না। চোখের পানি মার জন্যে। ছেলের বয়স তো কম হয় নাই। অখনো যদি দুধের পুলার মতো মা মা করে তাইলে চলবে ক্যামনে! এখন রোজগারপতি শিখতে হবে। দুইটা পয়সা কীভাবে আসে সেই ধান্ধায় থাকতে হবে। মা মা করলে মার আদর পাওয়া যায়, ভাত পাওয়া যায় না। জগতের সারকথা কী? জগতের সার কথা মা না, বাপ না। জগতের সারকথা ভাত। হিন্দুরা বলে অন্ন।বাপরে, ক্ষিধা লাগছে? না।

খেচুড়ি খাবি, খেচুড়ি? (আসগর কী কারণে জানি খিচুড়িকে বলে খেচুড়ি। এই খাদ্যটা তার বড়ই পছন্দ। এক প্লেট আট আনা নেয়। আট আনায় পেট ভরে না।)

খেচুড়ির কথাতেও ছেলের চেহারায় কোনো পরিবর্তন হলো না। সে এখনো রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। চোখ তুলছে না। আসগর বলল, আচ্ছা যা বিষ্যুদবারে নিয়া যাব। বিষ্যুদবার দিন ভালো। রহমতের দিন। বারের সেরা জুম্মাবার কিন্তু বিষ্যুদবারও মারাত্মক। থাকিবি কিছুদিন মার সাথে। আমি চেষ্টা নিব। এর মধ্যে খৎনা করাইতে। হাজম পাইলে হয়। সংগ্রামের সময় কে কই গেছে.

মজনুর মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ভুখ লাগছে।

কী খাবি? খেচুড়ি?

ডিমের সালুন দিয়া ভাত।

আসগর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এই ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সুখাদ্য বাদ দিয়ে সে চায় ডিমের সালুন। খেচুড়ি খাওয়ার এত বড় সুযোগ সে হেলায় হারাচ্ছে। জীবনে যখন বড় বড় সুযোগ আসবে সেগুলিও হারাবে।

খেচুড়ি খাইয়া দেখ।

ডিমের সালুন খাব।

আচ্ছা যা ডিমের সালুন।

আসগর ঠেলাগাড়ি ঘুরাল। সে বেশ আনন্দে আছে। কারণ গত কিছুদিন তার রোজগার ভালো হয়েছে। লোকজন মালামাল নিয়ে ঢাকা ছাড়ছে। কেউ যাবে কমলাপুর, কেউ বাসস্টেশন। সঙ্গে দুনিয়ার জিনিস। তারা ভাড়া হিসাবে যা দিচ্ছে তার পুরোটাই লাভ। ঠেলার মালিককে কিছু দিতে হচ্ছে না। কারণ পাঁচিশে মার্চের পর ঠেলামালিকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয়।

ঘটনা ভালো না। পাঁচশে মার্চ ১৪ তে ঠেলাটা ছিল আসগারের কাছে। তার শরীর ভালো ছিল না। পা ফুলে গিয়েছিল। সে ঠেলাটা নিজের কাছে রেখে দিযে ভেবেছিল সকালে মালিকের কাছে যাবে, ঘটনা ব্যাখ্যা করবে। তারপর তো লেগে গেল ধুন্ধুমার। যাকে বলে রোজ কেয়ামত। দুদিন পর কেয়ামত একটু ঠাণ্ডা হলে সে গেল ঠেলামালিকের খোজে।

মালিক দুটা ঘর তুলে থাকে কাটাবনে। গিয়ে দেখে কোথায় ঘর কোথায় কী! বেবাক পরিষ্কার। ঘরবাড়ি কিছুই নাই। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, এক দাড়িওয়ালা আদমি এসে বলল, কারে খুঁজেন?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *