জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ৩৮ হুমায়ূন আহমেদ

জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ৩৮

তিনি অতি দ্রুত ভদকার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। এত দ্রুত খাওয়া ঠিক না। কিন্তু তার অসুবিধা হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে তার চিন্তা পরিষ্কার হচ্ছে। মাথা থেকে কুয়াশা সরে যাচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন একটি আত্মজীবনীও লিখবেন। যেখানে পূর্বপাকিস্তানকে পোষ মানানোর গল্প সুন্দরভাবে লেখা থাকবে। বইটি লেখার সময় তিনি বিনয়ী থাকবেন। বীরপুরুষরা বিনয়ী হয়। বিনয়ও বীরত্বের লক্ষণ।

আত্মজীবনীটা ইংরেজিতে লেখা হবে, যাতে সব ভাষাভাষীরা পড়তে পারে। বইটার প্রথম লাইনটা হবে–it was a monson of discontent. জেনারেল নিয়াজীর মান অতিদ্রুত আনন্দে পূর্ণ হলো। এত আনন্দ একা এক ধারণ করা যায় না। আনন্দ বিলিয়ে দিতে হয়। তিনি জেনারেল জামশেদকে টেলিফোন করলেন। তাকে একটা জরুরি নির্দেশও দিতে হবে। কী নির্দেশ তা মনে পড়ছে না, তবে মনে পড়বে। কথা বলতে বলতেই মনে পড়বে। নেশা করার এই এক আনন্দ। মানুষ একইসঙ্গে সবকিছু ভুলে যায়, আবার তায় সবকিছুই মনে পড়ে।

হ্যালো জামশেদ।

ইয়েস স্যার।

আমি একটি আত্মজৈবনিক গ্ৰন্থ লেখার পরিকল্পনা করেছি।

ভালো করেছেন স্যার।

এটি হবে পাকিস্তান রক্ষা বিষয়ক একটি প্রামাণ্য দলিল।

অবশ্যই।

বইটিকে আমি সুখপাঠ্য করার ব্যবস্থা করব।

আপনার পক্ষে কাজটা কঠিন হবে না। অসংখ্য গল্প আপনি জানেন। সেইসব গল্প নিশ্চয় বইতে পাওয়া যাবে।তা পাবে। ইস্টার্ন কমান্ডে তুমি এবং তোমার বীর সৈনিকরা যে সাহসী ভূমিকা রেখেছ–তার উল্লেখ থাকবে।স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমি সবাইকে সবার প্রাপ্য সম্মান দেব। ভালো কথা, তোমার প্রতি একটি জরুরি নির্দেশ আছে। এতক্ষণ মনে পড়ছিল না। এখন মনে পড়েছে।স্যার বলুন।চিটাগাং পোর্টে কিছু ট্যাংক খালাস করা হচ্ছে। তুমি ট্যাংকগুলো ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করো।

সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি তোমাকে নির্দেশ দিলাম, কীভাবে সম্ভব তা তোমার ব্যাপার। আমি দেখতে চাই নির্দেশ পালিত হয়েছে।জেনারেল জামশেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ছোট্ট একটা দুঃসংবাদ আছে।নিয়াজী বিরক্ত গলায় বললেন, দুঃসংবাদ শোনার মতো মানসিক অবস্থা এখন আমার নেই। তারপরেও বলো।আমাদের একটা পুরো কোম্পানি কাদের সিদ্দিকী ধ্বংস করে ফেলেছে। কয়েকজন তার হাতে ধরাও পড়েছে।

কাদের সিদ্দিকী কে? ইন্ডিয়ান আর্মির?

জি-না স্যার, একজন সিভিলিয়ান মুক্তি।

তাকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় আমার সামনে হাজির করবে। তোমার প্রতি এটি আমার আদেশ, একটি সামরিক আদেশ।জেনারেল নিয়াজী টেলিফোন রেখে দিলেন। তার মেজাজ প্ৰচণ্ড খারাপ। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরনো ফুরফুরে ভাব আবার ফিরে এলো। তিনি তার আত্মজীবনী নিয়ে ভাবতে লাগলেন।

*সূত্র : Memoir গুল হাসান খান

নদীর নাম ধলেশ্বরী। তারিখ বারই আগষ্ট।

সাতটা জাহাজের বিশাল বহর এগুচ্ছে। তাদের গন্তব্য ফুলছরিঘাট। জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্ৰ গোলাবারুদ এবং রসদ। ফুলছরিঘাটে মাল খালাস হবে। সেখান থেকে যাবে রংপুর এবং সৈয়দপুর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে।

জাহাজ বহরের দায়িত্বে আছেন ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ, সহকারী কমান্ডার লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ। জাহাজগুলি মালামাল বহন করছে, কাজেই নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত না। স্থলবাহিনীর বেশ বড় দল জাহাজে আছে। তারাই নির্বিঘ্নে জাহাজগুলি গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। জাহাজের সারেংরা সবাই বাঙালি, নদী ভালো চেনে। তারা নদীর গভীরতা দেখে দেখে এগুচ্ছে।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ আছেন এস. ইউ. ইঞ্জিনিয়ারস এলসি থ্রি জাহাজে। তাঁর সঙ্গে আছেন লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ। বিশাল আকৃতির এই জাহাজের পাশাপাশি যাচ্ছে ত্রিপল ঢাকা ট্যাংকার এস. টি. রাজন। এখানে আছেন সুবেদার রহিম খান।ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ জাহাজের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার কাছে এই প্রথম মনে হচ্ছে তিনি ছুটি কাটাতে এসেছেন। আনন্দময় নৌভ্রমণ হচ্ছে। জাহাজ বহর দেখে দুই তীরের আতঙ্কিত মানুষদের ছোটাছুটিতেও তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।

বাঙালি অতিরিক্ত মাছ খাওয়ার কারণে ভীরু স্বভাবের হয় বলে তিনি জানেন। আজ তার প্রমাণ দেখছেন। বাড়িঘর ছেড়ে লোকজন পালাচ্ছে। মাছ মারতে আসা জেলেরা নৌকা এবং জাল ফেলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে পানিতে। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ তাদের দোষ দিতে পারছেন না। সাতটা জাহাজের বহর দেখে যে-কেউ ভয় পাবে। ভীতু বাঙালির ছোটাছুটি দেখতে ভালো লাগে।

জাহাজ এগুচ্ছে ধীর গতিতে। নদী সব জায়গায় সমান গভীর না। জায়গায় জায়গায় চর জেগেছে। নদীর গভীরতা দেখে দেখে এগুতে হচ্ছে সাবধানে। জাহাজের গতি আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো।লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ ডেকে উঠে এলেন। তার হাতে ক্যামেরা। তার উদ্দেশ্য নিজের কিছু ছবি তুলবেন। দেশে পাঠাবেন। ছবি এমনভাবে তোলা হবে যেন জাহাজ বহরের অনেকটাই ছবিতে আছে। তার বৃদ্ধা মা ছেলের ছবি খুব আগ্রহ করে দেখেন।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ হাসিমুখে বললেন, হ্যালো মি. ফটোগ্রাফার, তুমি যে হারে ছবি তোল, তোমার ক্যামেরায় ফিল্ম অবশিষ্ট থাকার কথা না। যদি থাকে আমার একটা ছবি তুলে দাও।লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ বললেন, অবশ্যই স্যার।ছবিটা এমনভাবে তুলবে যেন আমাকে দেখে মনে হয় আমি ক্রিস্টোফার কলম্বাস।অবশ্যই স্যার। এখানে ছবি না তুলে চলুন ছাদে যাই। ছাদে ছবি ভালো আসবে। জাহাজ বহরের অনেকখানি পাওয়া যাবে।চল যাই।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ছাদে উঠার সিঁড়িতে পা রেখেছেন, তখনই মটারের গোলা এসে জাহাজে পড়ল। ব্যাপার কী বুঝে উঠার আগেই বৃষ্টির মতো মেশিনগানের গুলি এসে পড়তে লাগল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, What is happening? বিশাল এই জাহাজ বহর আক্রমণ করার স্পর্ধা কে দেখাচ্ছে? লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ বলল, স্যার আমরা কাদের সিদ্দিকীর এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আক্রমণ করেছে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। সে ছাড়া এই কাজ আর কেউ করবে না।

ততক্ষণে নারকীয় কাণ্ড শুরু হয়েছে। পেছনের জাহাজগুলি উল্টোদিকে চলতে শুরু করেছে। তার জাহাজটি এবং এস. টি. রাজন ছাড়া সামনের জাহাজগুলিও দেখা যাচ্ছে না। এস. টি. রাজনে যেভাবে মর্টারের গোলা এসে পড়ছে যে-কোনো মুহুর্তে এতে আগুন ধরে যেতে পারে। এই ট্যাংকারটিতে ডিজেলই আছে এক লক্ষ আশি হাজার গ্যালন।জাহাজের কন্ট্রোলরুম থেকে ওয়্যারলেসে হেড কোয়াটারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো।আমরা আক্রান্ত হয়েছি। আমরা আক্রান্ত হয়েছি। বৃষ্টির মতো মর্টারের গোলা, এসে পড়ছে। লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ নিহত। সুবেদার রহিম খান নিহত।

কী বলছ এসব?

মে ডে। মে ডে।

জাহাজ নিয়ে পিছিয়ে আসা। কোনোক্রমেই যেন জাহাজ কাদের সিদ্দিকীর হাতে না পড়ে। জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্ৰ।আমরা চড়ায় আটকা পড়েছি। সেনাবাহিনীর প্রায় সবাই নিহত। বিমানবাহিনীর সাহায্য লাগবে। অবিলম্বে বিমানবাহিনীর সাহায্য লাগবে।

বিমানবাহিনীর সাহায্য যাচ্ছে। জাহাজের অস্ত্ৰ যেন তাদের হাতে না পড়ে। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী এগিয়ে আসছে। তাদের দেখতে পাচ্ছি। হেভি মেশিনগান দিয়ে ওদের আটকে রাখ; বিমানবাহিনীর সাহায্য আসছে।মেশিন গানাররা কেউ জীবিত নেই। কথা শেষ হবার আগেই বিকট শব্দে রকেট লাঞ্চারের গোলা ফাটল। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন পানিতে।

* মাটিকাটা অঞ্চলে অসীম সাহসিকতায় যে মানুষটি জাহাজ আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর এক বীর যোদ্ধা। তাঁর নাম মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। জাহাজ দখলের পর তাঁর নাম হয়ে গেল জাহাজ মারা হাবীব। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর বিক্রম সম্মানে সম্মানিত করেন। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগদানের আগে তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার।

বরিশালের বানিয়াপাড়ায় একটি বড় দোতলা লঞ্চের দোতলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জানে রসুল শুকনা মুখে বসে আছেন। লঞ্চে ত্ৰিশজন সৈনিক, পাঁচজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ এবং কিছু রাজাকারকে উঠানো হয়েছে। জানে রসুলকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে। হেমায়েত বাহিনীকে শেষ করে দেয়া।

হেমায়েত বাহিনী বর্তমানে কোথায় আছে কীভাবে আছে–সেই তথ্য নিয়ে একজন ইনফরমার এসেছে। ইনফরমারের নাম কয়েস আলি। তার বয়স চল্লিশের নিচে। থুতনিতে ছাগলাদাড়ি। মাথায় বেতের গোলটুপি। তিনি চোখে সুরমা দিয়েছিলেন। এক চোখের সুরমা কী কারণে জানি লেস্টে গিয়েছে। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে মারামারি করে তিনি চোখে কালশিটা ফেলেছেন।

ক্যাপ্টেন জানে রসুল এই ইনফরমারের উপর খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। তাঁর কথাবার্তা থেকে তেমন কিছুই উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বরং উল্টা সন্দেহ হচ্ছে, এই লোক আসলে হেমায়েত বাহিনীরই একজন স্পাই। এর কথায় লঞ্চ নিয়ে কোথাও উপস্থিত হওয়া মানে বিপদে পড়া। অথচ উপর থেকে নির্দেশ এসেছে অভিযানে বের হতে হবে।

নদীপথের অভিযানের দায়িত্ব নৌবাহিনীর। তারা গানবোট নিয়ে বের হবে। কাজ শেষ করে গানবোট নিয়ে ফিরে আসবে। এইসব জায়গায় স্থলবাহিনীকে লক্কর লঞ্চে করে পাঠানোর মানে কী? ক্যাপ্টেন জানে রসুলের ধারণা–সেনাবাহিনী এখন চলছে হুজুগের উপর। উপরের লোকজনের যার মাথায় যা আসছে তাই করছে। ওয়ারলেস অর্ডার পাঠিয়ে দিয়ে খালাস।

কয়েস আলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে পানের ডিব্বা বের করে দুটা পান একসঙ্গে মুখে দিয়ে বলল, মেজর সাব এখন কী করবেন ঠিক করলেন? কথাগুলি সে বলল, কাজ চালাবার মতো উর্দুতে। এটা ভালো। অনেক ইনফরমার আছে যারা উর্দু বলতে পারে না। বুঝতেও পারে না। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয় দোভাষির মাধ্যমে। দোভাষিরা সব সময় নিজেদের কিছু কথাবার্তাও ঢুকিয়ে দেয়।

তোমার নাম কয়েস আলি?

জি জনাব।

উর্দু কোথায় শিখেছ?

আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঁচ বছর চাকরি করেছি।

কী চাকরি?

কিচেনে হেলপার।

চাকরি চলে গেল কেন?

রিজিকের মালিক আল্লাহ। তিনি মিলিটারি থেকে রিজিক উঠায়ে নিয়েছেন বলে চাকরি চলে গেছে।

তুমি হেমায়েত বাহিনীকে চেন?

কেন চিনব না? দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা আছে।

কার সঙ্গে আত্মীয়তা?

হেমায়েতউদিনের সঙ্গে। উনার স্ত্রীর নাম হাজেরা খাতুন। যুদ্ধের সময় গুলি খেয়ে মারা গেছে। সে এক হিন্দু মেয়েরে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে। তার নাম সোনেক রাণী রায়। তার বড় ছেলের নাম হাছিবউদ্দিন, ডাকনাম পাঞ্ছ।তুমি হেমায়েতউদ্দিনকে ধরিয়ে দিতে চাও? অবশ্যই। কারণ কী?পাকিস্তান টিকয়ে রাখতে হবে না? শুধু পাকিস্তান টিকায়ে রাখার জন্যে তাকে ধরিয়ে দেবে?

অন্য কারণও আছে। পারিবারিক।হেমায়েতউদ্দিন কোথায় আছে তুমি জানো? অবশ্যই।সেখানে গেলে আমরা তাকে পাব? সে হইল শুশুক। এইটা বিবেচনায় রাখতে হবে।শুশুক কী? শুশুক থাকে পানিতে। ভুস কইরা ভাইসা উঠে আবার ড়ুব দেয়।সে এখন যেখানে আছে–সেখানে পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?

আমারে সারেঙ্গের সাথে বসায়ে দেন, আমি নিয়া যাব। তবে খালে ঢুকতে হবে। জোয়ার-ভাটা বিবেচনা করে চলতে হবে।নদীতে জোয়ার-ভাটা আছে না-কি? কী যে বলেন, আমরার এইটা জোয়ার-ভাটার দেশ। নদীপথে চলতে হলে নদীর হিসাবে চলতে হবে।নদীর হিসাবে চলতে হলে কখন রওনা দিতে হবে? আরো এক ঘণ্টা পরে।ঠিক আছে তুমি এখন যাও, এক ঘণ্টা পরে রওনা দেব।

ক্যাপ্টেন জানে রসুল বরিশাল এলাকার একটা ম্যাপ বের করে সামনের টেবিলে রাখলেন। ম্যাপ দেখে কোনো কিছুই বোঝার উপায় নেই। মাকড়শার জালের মতো চারদিকে নদী-নালা। অতি দুৰ্গম অঞ্চল। এই অঞ্চল যে চেনে না–তার জন্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া পুরোপুরি অসম্ভব। একটা ব্যাপার। এই রকম অবস্থায় তাকে অভিযানে যেতে হচ্ছে এমন একজনকে শায়েস্তা করতে–যার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য তার কাছে নেই।

এই লোক সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার ছিল। দীর্ঘদিন এবোটাবাদ সেনাবাহিনী স্কুলে প্রশিক্ষক ছিল। এখন সে মুক্তি হয়েছে। বিদের হাডিড হয়েছে। ভারতের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই নাকি বিশালবাহিনী তৈরি করেছে। এই বাহিনী কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়াই সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

ঢুশঢাশ কয়েকটা গুলি করে পালিয়ে যাওয়া টাইপ যুদ্ধ না। সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদের গুণতির মধ্যে ধরছে–এটাও এক বিস্ময়কর ঘটনা।ব্যাটা এখন আবার হিন্দু বিয়ে করেছে। স্ত্রীর নাম সোনেকা রাণী রায়। হিন্দু বিয়ে তো করবেই, এরা এমনিতেই হাফ হিন্দু। ক্যাপ্টেন জানে রসুলের কাছে খবর আছে, পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানরা বেশির ভাগ সময় মুসলমানি করায় না।

এক ঘণ্টার জায়গায় লঞ্চ ছাড়ল দেড় ঘণ্টা পরে। লঞ্চের নাম এমডি যমুনা। কয়েস আলি সারেঙের পাশে বসে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা যাচ্ছে বানারিপাড়া থেকে স্বরূপকাঠির দিকে। হেমায়েত বাহিনীর মূল লক্ষ্য শর্ষিনার পীরসাহেবের আস্তানায় যে মিলিটারি ক্যাম্প আছে সেখানে আক্রমণ করা। তারা সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

ক্যাপ্টেন জানে রসুল কয়েস আলিকে ডেকে পাঠালেন। তথ্যগুলি ভালোমতো আবারো যাচাই করে নেয়া দরকার।হেমায়েত বাহিনী যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই জায়গাটা তুমি চেন? অবশ্যই। বিরাট পেয়ারা বাগান। জংলার মতো সেইখানে আছে।হেমায়েতউদ্দিন নিজেও কি দলের সঙ্গে আছে? উনি নিজে সব অপারেশনে থাকেন। তার স্ত্রীও থাকেন। স্ত্রী হিন্দু। নাম সোনেকা রাণী। রায় বংশ।

তার স্ত্রী যে হিন্দু এটা একবার বলেছ। নতুন কিছু থাকলে বলে।তার স্ত্রীও যুদ্ধ করে। রাইফেল চালাইতে পারে। এলএমজি চালাইতে পারে। এইটা অবশ্য শোনা কথা। আমি নিজে দেখি নাই। স্যার কি একটা পান খবেন? আমি পান খাই না।কয়েস আলি দুটা বড় পান মুখে দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে চাবাতে চাবাতে বলল, আমি সারেঙের সাথে বসি। এর বাড়ি চিটাগাং, এই অঞ্চল সম্পর্কে কিছুই জানে না।যাও।

কয়েস আলি চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লঞ্চের ইঞ্জিন থেমে গেল। একটু পর পর ঘটং ঘটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। লঞ্চ থেমে আছে মাঝনদীতে। তবে এখানে নদী তেমন চওড়া না। মাছধরার নৌক চোখে পড়ছে। ইলিশের মরসুম। জেলেরা প্ৰাণের ভয় তুচ্ছ করে মাছ মারতে বের হয়। শুধু গানবোটের বিশেষ শব্দ কানে এলে নৌকা নিয়ে দ্রুত কোনো খালে ঢুকে পড়ে।

এমভি যমুনাকে দেখে তারা সাধারণ লঞ্চই মনে করছে। লঞ্চ সাজানো হয়েছে সেইভাবেই। সৈন্যরা লুকিয়ে আছে এক তলায়। তাদেরকে বলা হয়েছে কেউ যেন জানোলা দিয়ে মুখ বের না করে। কেউ যেন তাদের দেখতে না পারে। একতলা দোতলা দুটাই মালে বোঝাই। নারিকেল, পেয়ারা, কাউফল। আলাদা করে মাল বোঝাই করতে হয় নি। মিলিটারিরা মাল বোঝাই এই লঞ্চ রিক্রুট করেছে।

ক্যাপ্টেন জানে রসুল খবর নিয়ে জানলেন, লঞ্চের ইঞ্জিনে কী না-কী সমস্যা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন ঠিক হবে। একঘণ্টা পরে জানানো হলো, ইঞ্জিন ঠিক করা যাচ্ছে না, তবে খুব কাছেই এক লঞ্চ মেকানিকের বাড়ি। ক্যাপ্টেন সাহেব অনুমতি দিলে সারেং সেই লঞ্চ মেকানিককে নিয়ে আসতে পারবে। মেকানিককে বাড়িতে না পাওয়া গেলেও অসুবিধা নেই, তার বাড়ি থেকে কয়েকটা রেঞ্জ নিয়ে এলে সে নিজেই ঠিক করতে পারবে।জানে রসুল অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, কতক্ষণ লাগবে?

সারেং জানাল, যেতে আসতে যতক্ষণ লাগে। ঊর্ধ্বে একঘণ্টা।ক্যাপ্টেন অনুমতি দিলেন। অনুমতি না দিয়ে তার উপায়ও ছিল না। দ্বিতীয় কোনো বিকল্প তার হাতে নেই। অন্য কোনো লঞ্চ নিয়ে তিনি যে ফিরে যাবেনসেই উপায়ও নেই। নদীপথে এখন লঞ্চ চলাচল করে না বললেই হয়। তার সঙ্গে ওয়্যারলেস সেট নেই। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়ার উপায় নেই।একঘণ্টার মধ্যে সারেঙের ফেরার কথা।

দুঘণ্টার কাছাকাছি হয়ে গেল সারেঙের খোঁজ নেই। বেলা হয়েছে। পাঁচটার উপর বাজে। দিনের আলো কমে এসেছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেজর জানে রসুল কয়েস আলিকে ডেকে পাঠালেন। কয়েস আলি বিনীত মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। জানে রসুল বিরক্ত মুখে বললেন, ঘটনা কী? কয়েস আলি উদাস গলায় বলল, ঘটনা ভালো না।ঘটনা ভালো না মানে কী? সারেঙ লঞ্চ ফালায়ে তার হেলপার নিয়ে পালায়ে গেছে বলে মনে হয়।এরকম মনে হবার কারণ কী?

হাবেভাবে বুঝলাম। দুই আর দুই-এ মিল করে চার বের করলাম। সহজ হিসাব, জটিল হিসাব তো না।জটিল হিসাব না? জি-না। আপনাকে আগেই বলেছি। সারেঙের বাড়ি চিটাগাং, এই অঞ্চলের কিছুই সে চিনে না। সে কীভাবে মেকানিক ধরে আনবে? এটা আমাকে আগে বলো নি কেন?

একবার ভাবলাম বলি। পরে ভাবলাম মানুষরে এত সন্দেহ করা ঠিক না। সে লঞ্চ নিয়া এই অঞ্চলেই চলাফেরা করে। মেকানিকের বাড়ি চিনতেও পারে।সারেঙ যদি সত্যি সত্যি পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের করণীয় কী?জনাব, এই বিষয়ে আমি গভীর চিন্তায় আছি। একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনুমতি দিলে বলি।বলো।আমার মন বলতেছে লঞ্চের ইঞ্জিন ঠিক আছে। ব্যাটা ইচ্ছা কইরা লঞ্চ চড়ায় উঠায়ে দিয়েছে।লঞ্চ কি চড়ায় বেধে আছে?

জি। শিকারপুরে ছোট লঞ্চ আছে। আপনি যদি আমার সঙ্গে কোনো লোক দেন। আমি নৌকাযোগে শিকারপুর যাব। সেখান থেকে লঞ্চ নিয়ে ফিরব। জায়গাটা ভালো না। রাতে এখানে লঞ্চে আটকা পড়লে বিপদ আছে। হেমায়েত বাহিনী শক্ত জিনিস।তুমি শিকারপুর থেকে লঞ্চ নিয়ে আসতে চাও?

শিকারপুরের দুই-একজন লঞ্চ মালিকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তবে আপনি যদি অন্য কাউকে পাঠাইতে চান, পাঠাইতে পারেন। আমার একটাই কথা, সন্ধ্যার পর এই অঞ্চলে থাকা অতি বিপদজনক। আমি সারেঙের ঘরে আছি। কোন সিদ্ধান্ত হয় আমাকে জানাবেন। আছরের নামাজ পড়ব। আমি সব নামাজ কাজ পড়তে রাজি আছি, আছরের নামাজ কাজ পড়তে রাজি না। ক্যাপ্টেন সাহেব কি জানেন রোজকেয়ামত হবে আছরের ওয়াক্তে?

ক্যাপ্টেন জানে রসুল জবাব দিলেন না। সরু চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার এখন সন্দেহ হচ্ছে, লঞ্চ মাঝনদীতে এনে চড়ে আটকে ফেলার পেছনে এই লোকটার ভূমিকা আছে। বেশ বড় ভূমিকা। এই লোক কাজ করছে তার পরিকল্পনা মতো। সারেঙের সঙ্গে পরামর্শ করে লঞ্চ আটকানোর ব্যবস্থা করেছে। নদীর দুপাশে ঘন নারিকেল বন। নারিকেল বনের কভার নিয়ে হেমায়েত বাহিনী সহজ যুদ্ধ করবে। তিনি লঞ্চ নিয়ে খোলা জায়গায় আছেন, তার কোনো কভার নেই।

তোমার নাম কয়েস আলি?

জি স্যার।

বিয়ে কবেছ?

জি স্যার।

ছেলেমেয়ে আছে?

দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুইজনকেই মাদ্রাসায় ভর্তি করায়ে দিয়েছি। হাফেজিয়া মাদ্রাসা। তালা কোরান মজিদ মুখস্থ করতেছে। ছোট ছেলের পাঁচ পারা মুখস্থ হয়েছে। বড়টার এক পাড়া। বড়টার মাথার তেজ কম।আমার ধারণা তুমি হেমায়েত বাহিনীরই একজন। ইচ্ছা করে আমাদের এখানে এনে ফেলেছি।আপনি যা চিন্তা করতেছেন তা ঠিক না।আমি তোমার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে যাব না। আমি তোমাকে এখন লঞ্চের ছাদে নিয়ে তুলব।

সেখানে গুলি করে ডেডবডি নদীতে ফেলে দেব।আপনি আপনার বিবেচনা মতো কাজ করবেন, তবে হায়াত মাউতের মালিক আল্লাহপাক। আমার মৃত্যু যেমন হতে পারে, আপনাদের সবার মৃত্যুও এখানে হতে পারে। একটা লঞ্চ এখানে আটকা পড়ে আছে আর হেমায়েত বাহিনী এই খবর জানবে না তা কি হয়? যে সারেং পালেয়ে গেছে–খবর তার মাধ্যমেই চলে গেছে।

তুমি ছাদে চল।কয়েস আলি বলল, জি আচ্ছা। মৃত্যুর আগে একটা পান খাওয়ার সুযোগ দিয়েন জনাব। জর্দা দিয়া ভালোমতো একটা পান খাইয়া নেই।মাথায় গুলি করলেন। গুলি করার আগমুহুর্তে কয়েস আলি পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, আপনাদের আজরাইল আসতাছে। বেশি দেরি কিন্তু নাই।সন্ধ্যার পর পরই হেমায়েত বাহিনী দক্ষিণ দিক থেকে লঞ্চ আক্রমণ করল।

তখনো কয়েস আলির মৃতদেহ লঞ্চের আশেপাশেই আছে। জোয়ারের টান শুরু হয় নি বলে মৃতদেহ ভেসে যায় নি।*

* অসীম সাহসিকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের জন্যে মোঃ হেমায়েতউদ্দিনকে বাংলাদেশ সরকার বীরবিক্রম সম্মানে সম্মানিত করেন। কয়েস আলি সম্মান স্বীকৃতি কোনোটাই পান নি। সমগ্র দেশের পক্ষ থেকে আমি এই লেখার মাধ্যমে তাঁর প্রতি সম্মান জানালাম। (কয়েস আলি নামটি ঠিক না। আসল নাম আমি ভুলে গেছি। কোনো পাঠক মূল নামটি জানালে পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে দেব।) আরেকটি তথ্য যোগ করার লোভ সামলাতে পারছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গ্রন্থে মোঃ আব্দুল হান্নান লিখছেন– যুদ্ধকালিন সময়ে মুজিবনগর সরকার মোঃ হেমায়েতউদ্দিনকে সুবেদার পদ প্রদান করেন। এবং তার ডাকনাম দেয়–হিমু।

তোমার নাম কী?

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

নাম বলো।

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

কেয়া নাম?

আবু তাহের।

Tell me your name.

Sir, my name is Abu Taher.

তোমার নাম কী?

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

কেয়া নাম?

আবু তাহের।

Tell me your nare.

Sir, my name is Abu Taher.

মোহাম্মদ আবু তাহের সম্পূৰ্ণ নগ্ন অবস্থায় একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তার মুখের উপর দুশ পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। চোখ বন্ধ করেও তীব্ৰ আলোর হাত থেকে সে বাঁচতে পারছে না। কঠিন এই আলো চোখের পাতা ভেদ করে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের গভীরে কোনো এক জায়গায় পিন ফুটানোর মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। আবু তাহের মাঝে মধ্যেই ভাবছে, শুধুমাএ বাতি জ্বলিয়ে একজন মানুষকে এত কষ্ট দেয়া যায়!

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *