ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে 

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম 

– স্বপন বুড়াে 

আজ ক্লাসে ঢুকেই যে টেকোমাখা পঞ্চানন পন্ডিত একেবারে সরাসরি তার দিকে আঙ্গুল তুলে শব্দের রূপ’ মুখস্থ বলতে আদেশ করবে সে কথা গজানন 

জানবে কি করে? 

গজানন তাে আর জ্যোতিষ বিদ্যা জানে না। জানলে হয়তাে একদিনের জন্য ইস্কুল থেকে পলায়ন করতে। সারা ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে তাকেই কেন শব্দরূপ বলতে সরাসরি বেছে নেয়া হল, সে কথা গজানন অনেক ভেবে চিন্তেও বুঝে উঠতে পারল না। তার মুখটা কি একেবারে প্যাচার মতাে? 

‘নর’শব্দ, নদীশব্দ কোনাে কিছুই তার আয়ত্তে নেই। 

অবশেষে পঞ্চানন পন্ডিত তাকে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে একটা ইটের | টুকরাে কপালে বসিয়ে দিয়ে বললাে, এটা যেন কোনাে মতেই মাটিতে পড়ে না 

যায়। পড়লেই বেত যে কেমন মিষ্টি সেটা ভালাে করে চেখে দেখতে হবে। 

পঞ্চানন পন্ডিত সবে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে, গজানন কপালের ইটটা হাতে তুলে নিয়ে পন্ডিতের পৃষ্ঠদেশের উদ্দেশ্যে হাতের তাক করে ছুঁড়ে মারল। তারপর লম্বা লম্বা লাফে ইসুলের গন্ডি পেরিয়ে সদর রাস্তায় গিয়ে পড়ল। তখন আর তাকে পায় কে। 

সারাইস্কুলে হৈ-হৈ-রৈ রৈ শক উঠল। 

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে 

কিন্তু পঞ্চানন পন্ডিতের হাজার আদেশেও কেউ গজাননকে অনুসরণ করতে রাজি হল না। ওর হাতের অব্যর্থ তাক এই খানিকক্ষণ আগে পঞ্চানন পন্ডিত তার পৃষ্ঠদেশে বিলক্ষণ অনুভব করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবার আগ্রহ গােটা ইস্কুলের ছাত্রদের মধ্যে আর কারাে ছিল না। কাজেই গজানন পরম আরামে ও আনন্দে নদীর দিকে চলে গেল। ওখানে মাঝিদের নৌকোয় পাল ভােলা আছে। একটু দূরে একটা বিরাট ফলের বাগান আছে। আর আছে মৃদু সমীরণ আর মৌমাছিদের গুনগুনানি। সেখানে গজানন নিজেকে অতি সহজেই হারিয়ে ফেলে। 

নদীর ধারের অবারিত আনন্দ আর খােলা হাওয়া তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলাে। 

মাঝির দল তখন সবাই নিজের নিজের নৌকায় রান্না চাপিয়েছে। ওরা কেউ। নৌকায় পাল তুলে দিয়ে নদীর পথে উধাও হয়ে যেতে রাজি হল না। 

বিরক্ত হয়ে গজানন নদীর পথ ধরে নির্জন ফলের বাগানের দিকে এগিয়ে চললাে। আম, জাম, কাঠাল, লিচু, কলা সবকিছু বাগান ভর্তি। 

এমন মনােম জায়গা থাকতে ছেলেরা দুপুর বেলা গুমােট ইস্কুল বাড়ীতে বন্ধ থেকে প্যাচার মতাে মুখ করে শব্দরূপ মুখস্থ করে কেন, সে অনেক ভেবে চিন্তেও বুঝে উঠতে পারল না। 

গাছে গাছে পাকা আম ঝুলে রয়েছে। গজাননের হাতের টিপে দু’একটা টুপটাপ পড়ল তলায়। তাই আমেজ করে চুষতে চুষতে এগিয়ে চললাে গজানন। চোখ বুজে মিঠে হাওয়ায় পাখীর মিঠে বােল শুনতে শুনতে আপন মনে ভাবলাে, আহা এমন মধুর আনন্দে যদি জীবনটা কেটে যায় তাহলে আর কিসের পরােয়া।

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে 

দূরে পড়ে থাক পঞ্চানন পন্ডিতের বেত, আর শব্দরূপের কচকচি। সারা জীবনের পথ যদি এই ফলের বাগানের ভেতর দিয়ে চলে, তাহলে সে অমরের মতেই গুনগুন করে পরম আমেজে তুড়ি মেরে এগিয়ে যেতে পারে। 

হঠাৎ গজানন তাকিয়ে দেখে তার উল্টো দিক থেকে এক ফকির লাঠি হাতে গান গাইতে গাইতে আঁকা বাঁকা পথ ধরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ফকিরের পিঠে ঝুলছে একটা ঝোলা। ফকিরের অনেক বয়স হয়েছে। মাথাটা একেবারে নেড়া। সাদা দাড়ি গোঁফ হাওয়ায় দুলছে। আর সেই সঙ্গে দুলছে তার নেড়া মাথা। গজাননকে ঐভাবে একা একা এগিয়ে আসতে দেখে ফকির ফোকলা দাঁতে ফিক ফিক করে হেসে উঠল।

তারপর মাথা নেড়ে কইলে, হু। বুঝতে পেরেছি। ইস্কুল পালিয়ে এই ফলের বাগানে ঢুকেছু থােকা। কিন্তু সারা জীবন তাে এইসব ফল পেকে ঝুলে থাকবে না। তখন রস জুটবে কোথায় শুনি?  গজানন ফকিরের কথা গায়ে মাখল না। সেও খিলখিল করে হেসে উঠল। । কইলে, শােন ফকির ভাই, আমি খােকা নই। আমার নাম জানন। ইস্কুল থেকে সরে পড়েছি, একথা সত্যি। এমন মজাদার রসালাে বাগান থাকতে — কে আর 

শব্দরূপ’ মুখস্থ করে বলাে? 

তারপর ফকিরের কাছাকাছি এসে আবদারের সুরে কইলে, ফকির ভাই, আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেবে? 

ফকির মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগল। জবাব দিলে, গান আমি তােমায় শেখাতে পারি। তার আগে তােমায় বলতে হবে — আমার এই ঝােলার মধ্যে কি আছে? 

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে 

ফকিরের কথা শুনে গজানন ভারী মজা পেল। মাথা নেড়ে কইলে, হু। বলতে | পারি তােমার ঝােলার ভেতর কি আছে। আচ্ছা, আমায় একটু ভাবতে দাও। তােমার খােলার ভেতর রয়েছে রং বেরঙের একটি পিরান, দুটি সরু পায়জামা, একটি গানের খাতা, যাদুর খেলা দেখার জন্যে একটি হাড়ের কৌটো। 

ফকির হাসতে হাসতে উত্তর দিলে, হােল না খােকা, হল না। আমার ঝুলি থেকে ঝেড়ে তােমায় সৰ দেখাচ্ছি। ফকির তার কাধ থেকে ঝুলিটা তুলে নিয়ে গজাননের চোখের সামনে উপুর করে ধরল। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাে পাকা কলা, পাকা লিচু, পাকা আম, আর রাশি রাশি পাকা কালাে জাম। 

দেখে শুনে গজানন মহাখুশী। কইলে, আচ্ছা ফকির, তুমি কি যাদুর খেলা। জাননা? আমারও দারুণ খিদে পেয়েছে। আগে তােমার পাকা ফলগুলি খেয়েনি। তারপর গাছের ছায়ায় বসে গান শিখবাে। ফকির কিন্তু স্বসি মুখে মাথা দোলাতে লাগলাে। 

উহু। সেটি হচ্ছে না খােকাবাবু। আমার আনা পাকা ফল – তুমি যে টপা করে মুখে পুরে দেবে – সেটি আমি কিছুতেই হতে দেব না। গজানন একবার রুলগুলির দিকে তাকিয়ে চােখ দুটি নামিয়ে কইলে, তােমার ফলগুলি দেখে মনে হচ্ছে — এ বাগানের ফল একটিও নয়।

ফকির ভাই, নিশ্চয়ই তুমি যাদুর খেলায় এই মজার ফলগুলি মুহর্তের মধ্যে আমদানি করেছ। আমায় এইরকম যাদুর খেলা শিখিয়ে দাও না। | ফকির তার নেড়া মাথা দুলিয়ে কইলে, যাদু তােমায় শিখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু তার আগে তােমায় এই টলটলে পুকুরের জলে একটা ডুব দিয়ে আসতে হবে। 

-এ আর বেশী কথা কি? 

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে

মহানন্দে তিড়িং মিভিং লাফাতে লাফাতে গজানন পাশের পুকুরের জলে ঝাপিয়ে পড়ল। 

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প 

ফলের বাগান ছেড়ে গজানন এগিয়ে চললাে। পথে তার সঙ্গে দেখা হল — ইস্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে। 

তারা দু’হাত তুলে গজাননকে কত ডাকতে লাগলঃ 

—- গজানন, আমাদের সঙ্গে চলে আয়। ইস্কুলে ফিরে যেতে হবে না? আর সাত দিন পরই তাে পরীক্ষা শুরু হবে। আমরা সবাই একসঙ্গে পরীক্ষা দেব। নিশ্চয়ই আমরা পাস করবাে। 

গজানন বন্ধুদের ডাক শুনালাে না, দ্রুতপদে সামনের দিকে এগিয়ে চললাে। 

ইস্কুলের পড়ুয়ারা চীৎকার করে কইলে, গজানন, অমন করে আমাদের ছেড়ে চলে যাসনে। পঞ্চানন পন্ডিত মশাই তােকে আর কিছু বলবে না। আমরা সবাই। মিলে তাকে অনুরােধ করব। | গজানন কিন্তু কারাে অনুরােধে কান পাতল না। নিজের গােতে এগিয়ে চললাে। এইভাবে গজানন বন্ধুদের, অভিভাবকদের, শুভানুধ্যায়ীদের কারাে কোন কথা শুনলাে না। শিক্ষকরা ওর সম্পর্কে একেবারে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। 

ধীরে ধীরে গজাননের বয়স বেড়ে গেল। ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলে গজানন। 

বন্ধুরাও ওকে আর কেউ ডাকে না। একা একা এখানে ওখানে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় গজানন। 

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে 

গজাননকে কেউ খেলতে ডাকে না। একেবারে জংলী হয়ে গেল গজানন। কিন্তু পেটের খিদে তাে কোনমতেই যাবার নয়। 

গজানন কোন বাড়ীতে গিয়ে খাবার চাইলে তারা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। এক জায়গায় ভাত চাইতে বাড়ীর লােকে তাকে তেড়ে মারতে আসল। বললে, জোয়ান মরদ ছেলে, খেটে খেতে পারাে না? ভাত চাইতে এসেছু? লজ্জা করে তােমার? 

গজানন ভাবলে, ঠিক কথাই তাে। ভাত চেয়ে খাবে কেন? সে চাকরী করবে। এক অফিসে গিয়ে গজানন চাকরি চাইলে। 

অফিসের বাবুরা বললে, কি লেখাপড়া শিখেছ তুমি? কটা পাস দিয়েছ যে চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছ? 

গজানন সে কথার কোন উত্তর দিতে পারে না। অফিসের বাবুরা রসিকতা করে বলে, যা ধাড়দের সঙ্গে রাস্তা সাফ করগে—ভদ্রলােকের ছেলে। গজানন সে কাজ তাে করতে চায় না। তখন সে এক গেরস্ত বাড়ীতে গিয়ে চাকরের কাজে বহাল হল। 

দিনরাত তাকে বাসন মাজতে হয়, ঘর-দোর সাফ করতে হয়। হাজার বার করে বাজারে ছুটতে হয়। ফাইফরমাসের অন্ত নেই। 

দিনের শেষে কড়কড়ে কাকড় মেশানাে ঠান্ডা ভাত, কড়ায়ের ডাল দিয়ে ভাত খায়। সে ভাত মুখে তুলতে পারে না। ওর পেট ভরে না। খাটতে খাটতে গজানন কাহিল হয়ে পড়ল। 

আর আগের মতাে বাসন মাজতে পারে না। ঘর-দোর সাফ করতে পারে না। 

ফাইফরমাস খাটতে পারে না। একটুকুতেই হাঁপিয়ে পড়ে। বাড়ীর গিন্নি তখন। ওকে তাড়িয়ে দিল। | ধরতে ঘুরতে গজানন এক দোকানে গিয়ে কাজ নিলে। খাবারের দোকান। সেখানেও উদয়অ খাটতে হয়। 

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে 

তবে একটা সুবিধে এই যে, দু’বেলা পেট ভরে খেতে দেয়। সেই খাবারের দোকানে আরও যেসব ছােকরা কাজ করে তারা সবাই মিলে শলা পরামর্শ করে গভীর রাত্রে খাবার চুরি করে খায়। | ছােকরার দল একদিন বলল, গজানন আমাদের সঙ্গে যদি খাবার চুরি করিস তাহলে তােকও ভাগ দেব। 

গজানন কিন্তু চুরি করতে রাজি হয় না। দোকানের মালিক দু’বেলা তাকে যে খাবার খেতে দেয় তাতেই সে খুশী। 

দোকানের ছােকরাগুলাে কিন্তু ভারী শয়তান। তারা যে শুধু নিজেরা দোকান থেকে খাবার চুরি করে খায়, তাই নয়। এই দোকানের খাবার বাইরে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে। 

তাতেও ছােকরাদের অনেক পয়সাকড়ি লাভ হয়। একদিন ছােকরার দল দেখলে, দোকানে অনেক রকম খাবার তৈরি হয়েছে। পরদিন বিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হবে। 

দোকানের মালিক বারবার সাবধান করে গেছে, কোন জিনিষ যেন খােয়া না যায়। সারা রাত জেগে দোকানে পাহারা দিতে বলে গেছে মালিক। সেজন্যে আলাদা বকশিস দেয়া হবে, সেকথাও ছােকরাদের জানিয়ে দিয়ে গেছে। 

কিন্তু মালিক বাড়ী চলে যেতেই ছােকরার দল সেই সব খাবার বাইরে চালান ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প | করে দেবে ঠিক করলে। গজাননকে বললে, ওদের সঙ্গে মাল বয়ে নিয়ে যেতে।  কিন্তু গজানন কিছুতেই সে কাজ করতে রাজি হল না। 

পরদিন দোকানের মালিক খাবারগুলাে দেখতে না পেয়ে সবাইকে গালাগাল শুরু করে দিল। | তখন ছােকরার দল এক জোট হয়ে গজাননের কঁাধে দোষ চাপিয়ে দিলে। বললে ওরা যখন সবাই ঘুমুচ্ছিল, তখন গজানন বাইরে থেকে লােক এনে সব খাবার পাচার করে দিয়েছে। 

ঠিক দুপুরে আকাশ কুসুম -স্বপন বুড়াে

দোকানের মালিক রেগেমেগে থানা থেকে পুলিশ ডেকে এনে গজাননকে চোর বলে ধরিয়ে দিলে। পাহারাওলা গজাননের হাতে হাতকড়া পরাতে এলাে। 

গজানন চীকার করে কইলে, আমি চুরি করিনি। আমি চোর নই। 

হঠাৎ এমন সময় গজানন ভুস করে পুকুর থেকে মাথা তুলে হাঁফাতে লাগল। দেখলে ফকির পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে তার ন্যাড়া মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। | গজানন হাঁফাতে হাঁফাতে কইলে, ফকির ভাই, কতক্ষণ আমি পরের জলে ডুব দিয়ে ছিলাম? এসৰ কি কান্ড ঘটল বলত? সারাটা জীবন কি আমার এমনিভাবে ভিক্ষে করে কাটবে? 

ফকির ফোকলা দাঁতে হেসে উঠে উত্তর দিলে, মাত্র দু’মিনিট তুমি পুকুরের জলে ডুব দিয়েছিলে? তাতেই এই সব ভুতুড়ে কান্ড দেখতে পেলে। তােমার জীবনটা সিনেমার মতাে তােমার চোখের সামনে দেখতে পেলে তাে? এখন বুঝতে পারলে জীবনের পথ পাকা ফলের মতাে রসে টুলটুলে নয়? পরিশ্রম করে তােমায় মানুষ হতে হবে। 

গজানন মাথা নীচু করে কইলে, ফকির ভাই, আমি আমার ভুল বুঝতে || পেরেছি। কালই আমি ইস্কুলে ফিরে যাবাে। 

হঠাৎ গজানন তাকিয়ে দেখে তার সামনে কে ফকির তার ঝুলিৰােলা শুদ্ধ একেৰারে উধাও হয়ে গেছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *